আট মাস আলোচনার পর জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে সুপারিশ দিয়েছে, তাকে ‘অশ্বডিম্ব’ বলেছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি সাজ্জাদ জহির চন্দন। ‘জগাখিচুড়ি মার্কা’ কমিশনের সুপারিশের পর পরিস্থিতি জটিলতার দিকে মোড় নেওয়ার দিকটি নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আট মাস আলোচনার পর একটা অশ্বডিম্বের মতো অবস্থা।’
গতকাল শনিবার সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে এক সংলাপে ‘পলিটিকস ল্যাব : পাবলিক ডায়ালগ’ শীর্ষক সংলাপে এ কথা বলেন সাজ্জাদ জহির। এই সংলাপের আয়োজন করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)। তরুণ রাজনীতিকদের মধ্যে মতাদর্শভিত্তিক সংলাপ ও গণতান্ত্রিক চর্চা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে জার্মান ফাউন্ডেশন ফ্রেডরিখ এবার্ট স্টিফটুংয়ের (এফইএস) সহযোগিতায় ‘পলিটিকস ল্যাব’ শিরোনামে চারটি ধারাবাহিক কর্মশালা করেছে সিজিএস। তার সমাপনী অনুষ্ঠান হিসেবে গতকালের সংলাপ হয়। এতে বিভিন্ন বক্তা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈক্যের কারণেই বর্তমানে রাজনীতিতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন খোদ রাজনীতিবিদেরা। এই পরিস্থিতিতে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হলে দেশ আবার পুরোনো রাজনৈতিক অবস্থাতেই ফিরে যাবে বলেও মনে করেন তারা। আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ না হলে কোনো কিছুরই সমাধান আসবে না বলেও সংলাপে মত দেন বক্তারা।
এতে আরও বক্তব্য দেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা, সেন্টার ফর গভারন্যান্স স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক পারভেজ করিম আব্বাসী।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত মঙ্গলবার জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে হস্তান্তরের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে তা নিয়ে মতভেদ দেখা দেয়। নানা প্রশ্নে বিভিন্ন দলের আপত্তির বিষয়গুলো সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়ার তপশিলে না থাকা নিয়ে যেমন সমালোচনা হচ্ছে, আবার গণভোটের সময় নিয়েও দলগুলোর মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন বলেন, জাতীয় নির্বাচনের শাশ্বত পথে প্রবেশ না করা পর্যন্ত কোনো কিছুর সমাধান আসবে না। ঐকমত্য কমিশন অনৈক্যের একটা দলিল জাতির কাছে হাজির করেছে। এ ধরনের কাজ বিরোধ সৃষ্টির সুযোগ। তিনি বলেন, যেভাবে ঐকমত্য কমিশন কাজ করেছে, সেভাবে কমিশনের কাজই হবে যতগুলো বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে তা তুলে ধরা। যেটাতে ঐকমত্য নেই, সেটা রেখে দেওয়া।
এই সংকট তৈরির জন্য ঐকমত্য কমিশনকে দায়ী করে সাজ্জাদ জহির বলেন, ‘এটার সমাধান কী? এই গণভোটের সমাধানটা কী? জুলাই সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, সে বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা কিন্তু নেই। মানে, একধরনের হাওয়ার ওপরে সবকিছু চলছে। এখানে ৮৪টা পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ২০টাতে একমত হয়েছে, বাকিগুলোতে একমত হয়নি। তাহলে কোন বিষয়ে ভোটটা হবে?’
জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করা সিপিবি সভাপতি বলেন, ‘আমরা দেখলাম জুলাই সনদে স্বাক্ষর হলো। এরপর সর্বশেষ সংস্কার কমিশন তারা আবার আরেকটা খেলা খেলল এখানে। দেখেন কী অবস্থা! তারা বলছে যে নোট অব ডিসেন্ট কিছুই থাকবে না। ভিন্ন মত থাকবে না। আমার তো ভিন্নমত আছে, কেন থাকবে না?’
গণভোট নিয়ে তিনি বলেন, ‘সংবিধানে কোথাও গণভোটের কোনো বিধান নেই। একটা আছে যেটা ১৪২ ধারা। যেটা নির্বাচিত সংসদে যদি কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে মতভেদ তীব্রতর হয়, তাহলে সে বিষয়ের ওপরে নির্বাচিত সংসদ জনগণের আহ্বান করতে পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে গণভোট সংবিধানসম্মত নয়।’ সিপিবির সভাপতি বলেন, এসব জটিলতা এড়াতে প্রয়োজনীয় কিছু সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা নিতে গত বছরের অক্টোবর মাসে তারা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছিলেন। তবে ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে’ সরকার সেটি শোনেনি।
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘বাংলাদেশে যদি টিভি চ্যানেল না থাকত, তাহলে আমাদের রাজনীতিবিদদের সম্পর্ক আরও ভালো থাকত।’ তিনি বলেন, প্রধান দলগুলোর মতবিরোধের কারণে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি কমিশন। দীর্ঘ আলোচনার পরও ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারা রাজনীতিবিদদের জন্য দুর্ভাগ্যের।
বিএনপি চাইলেই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়টা সমাধান হয়ে যেত।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নরুল হক নুর বলেন, যাদের কাঁধে চড়ে ড. ইউনূস ক্ষমতায় বসলেন, গত এক বছরে তাদের জন্য কিছু করেননি। তরুণ উপদেষ্টারা দেখাতেই পারবেন না, তারা কিছু করেছেন কি না। সুযোগ পেলেও তরুণেরা কিন্তু ভালো উদাহরণ তৈরি করতে পারেননি বলেও মন্তব্য করেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি। রাজনীতি আগের মতো থাকবে না উল্লেখ করে তাসনিম জারা বলেন, রাজনীতিতে যে পেশিশক্তি চলছিল, সেই রাজনীতি আর চলবে না। রাজনীতি এখন বদলে গেছে। সংলাপ শেষে কর্মশালায় অংশ নেওয়া বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের তরুণ নেতাদের মধ্যে সনদ বিতরণ করেন অতিথিরা।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন