রবিবার, ০২ নভেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


হাসান আরিফ

প্রকাশিত: নভেম্বর ২, ২০২৫, ০১:৩২ এএম

কাটছে না জটিলতা চ্যালেঞ্জে সরকার

হাসান আরিফ

প্রকাশিত: নভেম্বর ২, ২০২৫, ০১:৩২ এএম

ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

বিরল ঐক্যের নজির স্থাপনের দোরগোড়ায় থেকেও শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক বিভাজনে সমাধান হলো না। অর্ধশতাধিক বৈঠক, ছয় কমিশনের পরিশ্রম আর কয়েক মাসের আলোচনার পরও বিতর্কের মধ্য দিয়েই ৩১ অক্টোবর শেষ হয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম। ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ নামের ঐতিহাসিক দলিলে ২৫টি রাজনৈতিক দল স্বাক্ষর করলেও, তার বাস্তবায়ন পদ্ধতি ও গণভোটের সময়কাল নিয়ে তীব্র মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে- যা এখন জাতীয় ঐকমত্যকেই প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এখনো অনিশ্চিত জুলাই সনদের ভবিষ্যৎ। নভেম্বর মাসে গণভোটের সিদ্ধান্ত না এলে নির্বাচন-পূর্ব উত্তেজনা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশনের এই অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। এখানে দেখা গেছে- ঐক্যের আহ্বান যতই শক্তিশালী হোক, বাস্তবায়নের প্রশ্নে দলীয় অবস্থানই তাদের শেষ কথা।’

সাড়ে আট মাসের এই যাত্রা রাষ্ট্র সংস্কারের ইতিহাসে এক বিরল অধ্যায়। রাজনৈতিক বিভাজনের দীর্ঘ ইতিহাসে এই প্রথম এত দল একই টেবিলে বসেছিল এক নতুন রাষ্ট্র পরিচালনার রূপরেখা তৈরির লক্ষ্যে। কিন্তু সেই ঐক্যের ভেতরেই ফুটে উঠেছে নতুন বিভাজন, নতুন সন্দেহ।

এ বিষয়ে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, ‘ঐকমত্য কমিশনের কাজ শেষ হলেও ঐকমত্যের প্রক্রিয়া চলবে। রাষ্ট্র সংস্কারের এই অগ্রযাত্রা থামবে না।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন সবার দৃষ্টি এক জায়গায়Ñ প্রধান উপদেষ্টার সিদ্ধান্তের দিকে। গণভোট হবে কি না, হলে কবে- এই প্রশ্নের উত্তরই নির্ধারণ করবে জুলাই সনদের ভবিষ্যৎ এবং সম্ভবত বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনের গতিপথও।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ঘটে এক যুগান্তকারী ঘটনা- জনতার অভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ। এরপর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার, যার অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কার। সেই প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা করেন ছয়টি সংস্কার কমিশনের- সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, জনপ্রশাসন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন।

এই ছয় কমিশনের প্রতিনিধিদের নিয়ে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের বৃহত্তর ঐকমত্য গঠনের লক্ষ্যে ১৩ ফেব্রুয়ারি গঠিত হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন (এনসিসি)। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছিলেন এর সভাপতি এবং সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ ছিলেন সহসভাপতি।

মোট ৭২ বৈঠকের মধ্য দিয়ে কমিশনের কাজ চলে ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। তিন ধাপে অনুষ্ঠিত এসব বৈঠকে অংশ নেয় ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোট। প্রথম চার মাসে আলোচনা হয় সংবিধান সংস্কার, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, দুর্নীতি দমন, প্রশাসনিক জবাবদিহি ও মানবাধিকার প্রশ্নে। এর ফলেই জুলাই মাসে তৈরি হয় ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’, যা রাষ্ট্র সংস্কারের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা হিসেবে ইতিহাসে স্থান পায়।

গত ১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় এক ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা ও ২৫টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি সই করেন জুলাই সনদে। এতে ছয়টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়- গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ ও নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সংসদীয় অনুমোদনে বিচারপতি নিয়োগ। দুর্নীতি প্রতিরোধে সাংবিধানিক স্বায়ত্তশাসন। প্রশাসনিক জবাবদিহি ও নাগরিক সেবা নীতিমালা। মানবাধিকার রক্ষায় স্বাধীন কমিশন এবং পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর পেশাগত সংস্কার। এসব সনদের লক্ষ্য ছিল ২০২৫ সালের মধ্যেই রাষ্ট্রকাঠামোর মৌলিক সংস্কার সম্পন্ন করা।

তবে ঐকমত্যের ভেতরে ভাঙন শুরু হয় ‘নোট অব ডিসেন্ট’ ইস্যুতে। বিএনপি, গণফোরাম ও গণঅধিকার পরিষদ সংবিধান সংশোধনের পদ্ধতি নিয়ে লিখিত আপত্তি দেয়। তারা মনে করে, সংবিধান পরিবর্তনের প্রস্তাব সংসদীয় আলোচনার মাধ্যমে পাস করতে হবে, কমিশনের মাধ্যমে নয়।

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ চায় অবিলম্বে গণভোটের মাধ্যমে জনগণের অনুমোদন নেওয়া হোক। এই অবস্থানগত পার্থক্যই পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক বিভাজনকে তীব্র করে তোলে।

২৮ অক্টোবর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে সনদ বাস্তবায়নের দুটি বিকল্প সুপারিশ জমা দেয়। সুপারিশে বলা হয়, প্রথমে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫’ জারি করা হবে। এরপর জনগণের সম্মতি নিতে গণভোট আয়োজন করতে হবে এবং একটি ‘জাতীয় বাস্তবায়ন বোর্ড’ গঠন করে পর্যবেক্ষণ করতে হবে সংস্কার প্রক্রিয়া।

তবে কখন গণভোট হবে, সে বিষয়ে কমিশন নির্দিষ্ট কোনো সময় উল্লেখ করেনি। সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, গণভোটের সময় নির্ধারণ করা সরকারের কাজ, কারণ লজিস্টিক ও প্রশাসনিক প্রস্তুতি কমিশনের আওতায় ছিল না।

এখানেই দেখা দেয় নতুন সংকট। বিএনপি বলছে, জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে দুই ব্যালটে হবেÑ ‘এর বাইরে কোনো পথ নেই।’ জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী আন্দোলন চায় নভেম্বরে আলাদা গণভোট হতে হবে, জাতীয় নির্বাচনের আগে। তাদের যুক্তি, একই দিনে ভোট হলে সহিংসতা ও বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে। এনসিপি বলছে, সংবিধান সংস্কারে নতুন সংসদকে ‘গাঠনিক ক্ষমতা’ দিতে হবে; এর আগেই গণভোট করা ‘জাতির সঙ্গে প্রতারণা।’

বিএনপি অভিযোগ করেছে, ঐকমত্য কমিশনের প্রতিবেদনে তাদের নোট অব ডিসেন্ট বাদ দেওয়া হয়েছে। গত বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, নোট অব ডিসেন্টগুলো কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে নেই। জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য এটা একটা রাজনৈতিক প্রতারণা।’

একই দিনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘যেহেতু প্রধান উপদেষ্টা নিজেই কমিশনের সভাপতি ও স্বাক্ষরকারী, তাই এই সুপারিশ সরকার-সমর্থিত একধরনের অনুমোদনই হতে যাচ্ছে।’

অন্যদিকে এনসিপি অভিযোগ করেছে, বিএনপি ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। দলের মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, ‘বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে ভাইয়াগিরি করার জন্য। নতুন বাংলাদেশে এমনটা হতে দেওয়া হবে না।’

আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘বিরোধ এখন দুই স্তরে- বাস্তবায়নের পদ্ধতি ও গণভোটের সময়। সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধান উপদেষ্টা এবং তা খুব শিগগিরই।’

তবে তার কণ্ঠেও ফুটে উঠেছে হতাশা। রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে জুলাই অভ্যুত্থানের পক্ষে থাকা শক্তিগুলোর এই বিভাজন হতাশাব্যঞ্জক। তারা যদি ঐকমত্যে না আসে, সরকার কী করবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।

ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় দ্বিতীয় ধাপের পাঁচ সংস্কার কমিশনের (স্বাস্থ্য, গণমাধ্যম, নারী, শ্রম অধিকার, স্থানীয় সরকার) প্রস্তাব পর্যাপ্ত গুরুত্ব না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট কমিশনপ্রধানরা। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের বৈষম্যবিরোধী সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় সামাজিক সংগঠনগুলো হতাশা জানিয়েছে।
কমিশন সরকারকে তিন স্তরে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছে সংবিধানবহির্ভূত বিষয়গুলো অধ্যাদেশের মাধ্যমে।

প্রশাসনিক বিষয়গুলো অফিস আদেশের মাধ্যমে এবং সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কারগুলো দুই বিকল্প পদ্ধতিতে : জুলাই সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ জারি করে গণভোটে অনুমোদন। আর নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে গঠিত সংবিধান সংস্কার পরিষদের হাতে বাস্তবায়ন দায়িত্ব।

Link copied!