২০২৬ শিক্ষাবর্ষ শুরু হতে বাকি আর মাত্র ৪৭ দিন। নতুন বছরের প্রথম দিন প্রাক-প্রাথমিক থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনা মূল্যে বিতরণের জন্য ৩০ কোটি বইয়ের মধ্যে গত ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত উপজেলা পর্যায়ে বই পৌঁছেছে প্রাথমিকে ৭২ শতাংশ আর মাধ্যমিক স্তরে পৌঁছেছে মাত্র ৩ শতাংশ। বছরের বাকি সময়ে প্রাথমিক স্তরের শতভাগ বই উপজেলায় পৌঁছে গেলেও শিক্ষাবর্ষের প্রথম মাসে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা সব বই পাচ্ছে না। এ জন্য অনেক ‘ফ্যাক্টরের’ মধ্যে মাধ্যমিক স্তরের সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির বই ছাপার জন্য প্রেসগুলোর সঙ্গে এখনো চুক্তি না হওয়া উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে মানসম্পন্ন বই নিশ্চিত করাও আরেকটি ফ্যাক্টর। আবার বই ছাপার কাজে সংশ্লিষ্ট প্রেসগুলো ডিসেম্বর মাসজুড়ে নোট-গাইড ছাপাতে ব্যস্ত থাকে। এ সময় বই বাঁধাইকারক পাওয়াও কঠিন ফ্যাক্টর। এ ছাড়া অ্যাসাইনমেন্টের (ছাপার কাজ পাওয়ার সনদ) বিপরীতে ব্যাংক থেকে লোন পাওয়া, উপজেলায় সরবরাহের পর দ্রুত বই ছাপার বিল দেওয়া এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতের দাবি রয়েছে প্রেসগুলোর পক্ষ থেকে। প্রেসগুলোর দাবি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করাও বড় ফ্যাক্টর। সার্বিকভাবে এত সব ফ্যাক্টরে ঝুলে আছে নতুন বছরের প্রথম দিন মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বই বিতরণ।
৪৭ দিনের মধ্যে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের হাতে সব বই তুলে দেওয়ার চিন্তায় নাস্তানাবুদ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এনসিটিবি ও প্রেসগুলোও নাম প্রকাশ না করে বিষয়টি স্বীকার করেছে।
নির্দিষ্ট সময়ে মানসম্পন্ন বই পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা : সূত্র জানিয়েছে, প্রাথমিক স্তরের সব বই চলতি নভেম্বরে উপজেলায় পৌঁছে যাবে। তবে মোট বইয়ের সংখ্যা গত বছরের তুলনায় কিছুটা কমলেও নির্দিষ্ট সময়ে মাধ্যমিকের ষষ্ঠ থেকে নমম শ্রেণির বই পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
আগামী বছর বিনা মূল্যে বিতরণের জন্য প্রাথমিক স্তরের মোট পাঠ্যবই ৮ কোটি ৫৯ লাখ ২৫ হাজার ৩৭৯ কপি। এর মধ্যে গত ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত ছাপা ও বাইন্ডিং সম্পন্ন হয়েছে ৭ কোটি ৬০ লাখের বেশি বই। এর মধ্যে সরবরাহ-পূর্ব পরিদর্শন (পিডিআই) সম্পন্ন হয়েছে প্রায় ৭ কোটি বই। আর উপজেলা পর্যায়ে সরবরাহ করা হয়েছে ৬ কোটি ১৬ লাখের বেশি বই। অর্থাৎ, এই স্তরের মোট বইয়ের মধ্যে এখন পর্যন্ত উপজেলা পর্যায়ে সরবরাহ হয়েছে প্রায় ৭২ শতাংশ বই। চলতি মাসের বাকি দিনগুলোয় উপজেলায় শতভাগ বই পৌঁছে যাবে।
অন্যদিকে মাধ্যমিকের ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির মোট ২১ কোটি ৪৩ লাখ ৩০ হাজার ৩০০ কপি বই ছাপানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে গত ১২ নভেম্বর পর্যন্ত এই স্তরের বই ছাপার অগ্রগতি প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে, মোট বইয়ের মধ্যে উপজেলায় পৌঁছেছে মাত্র ৩ শতাংশ।
মাধ্যমিক স্তরের চার শ্রেণির বইয়ের বাইরে মাদ্রাসার ইবতেদায়ির প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির বইও এই স্তরের মাধ্যমে ছাপা হয়। এবার ইবতেদায়ি স্তরের মোট বই ছাপা হচ্ছে ৩ কোটি ১১ লাখের বেশি। অগ্রগতি প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে, ইবতেদায়ি স্তরের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির ৫০টি লটের বই ছাপার কাজ করছে ৩৪টি প্রেস। এখন পর্যন্ত ছাপা ও বাঁধাইসহ এই স্তরের মোট বই তৈরি হয়েছে ৫৬ শতাংশ। পিডিআই হয়েছে ৩৩ শতাংশ। উপজেলা পর্যায়ে সরবরাহ হয়েছে ২০ দশমিক ৪৬ শতাংশ।
এবার ষষ্ঠ শ্রেণির বইয়ের সংখ্যা ৪ কোটি ৪৩ লাখের বেশি। সপ্তম শ্রেণির ৪ কোটি ১৫ লাখের বেশি। অষ্টম শ্রেণির মোট বই ৪ কোটি ২ লাখের বেশি। আর নবম শ্রেণির মোট পাঠ্যবই ৫ কোটি ৭০ লাখ ৬৮ হাজার ২৮ কপি। অগ্রগতি প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে, ষষ্ঠ শ্রেণির ১০০ লটের বই ছাপার কাজ পেয়েছে ২৪টি প্রেস। বর্তমানে কাজ করছে একটি প্রেস। ছাপা ও বাঁধাইসহ পিডিআই সম্পন্ন হয়েছে মাত্র ১ শতাংশ বইয়ের। উপজেলায় পৌঁছেনি কোনো বই। নবম শ্রেণির ২৩৪টি লটের মধ্যে ১৩টিতে পুনঃদরপত্র করা হচ্ছে, ২২১টি লটের কাজ পেয়েছে ৯৭টি প্রেস। ছাপা ও বাঁধাইসহ পিডিআই সম্পন্ন হয়েছে ৪ শতাংশ বইয়ের, তবে উপজেলায় পৌঁছেনি কোনো বই। আর সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির ২০০টি লটের বই ছাপার জন্য চুক্তি না হওয়ায় কাজই শুরু হয়নি। সার্বিকভাবে এই স্তরের সাড়ে ২১ কোটি বইয়ের মধ্যে উপজেলায় পৌঁছানোর জন্য প্রস্তুত হয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৯৭ শতাংশ বই। মোট বইয়ের মধ্যে প্রায় ৯৭ শতাংশ আগামী ৪৭ দিনের মধ্যে প্রস্তুত করতে পারলে বছরের প্রথম দিন বই পাবে শিক্ষার্থীরা।
জানা গেছে, আগামী শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির বই ছাপার কাজে প্রেসগুলো এনসিটিবির প্রাক্কলিত দরের চেয়ে অনেক কম দর দেওয়ায় মানসম্পন্ন বই পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। সূত্র জানিয়েছে, সিঙ্গেল (এক) কালারে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির বই ছাপতে এবার এনসিটিবির প্রাক্কলিত দর ছিল ৩ টাকা ১৫ পয়সা। এসব শ্রেণির বই ছাপতে সর্বনি¤œ দর পড়েছে যথাক্রমে ২ টাকা ২৫ পয়সা, ২ টাকা ও ১ টাকা ৮৫ পয়সা। আর নবম শ্রেণির বই ছাপার দর ছিল ৩ টাকা ১৫ পয়সা। সর্বনি¤œ দর পড়েছে ৩ টাকা ১০ পয়সা। সূত্র জানায়, কাগজ, কালি, বাঁধাইও ছাপার বর্তমান বাজার দর অনুযায়ি ন্যূনতম ২ টাকা ৪০ পয়সার নিচে উল্লেখিত স্তরের মানসম্পন্ন বই তৈরি করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে প্রেসগুলোর কাছ থেকে দরপত্রের শর্ত অনুযায়ি বই আদায় করে নেওয়া এনসিটিবির জন্য অনেক বড় ফ্যাক্টর।
মাধ্যমিক স্তরের বই নিয়ে এমন অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ার বিষয়ে জানা গেছে, চলতি বছরও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সব শিক্ষার্থীর হাতে সব বই পৌঁছাতে নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে অনেক দেরি হয়েছিল। এই অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ আগামী বছরের ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির বই তৈরির জন্য মে ও জুন মাসে দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ করে মূল্যায়নের কাজও সম্পন্ন করেছিল। কিন্তু ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে এই তিন শ্রেণির বই ছাপার দরপত্র সেপ্টেম্বর মাসে বাতিল করা হয়। এরপর আবার দরপত্র আহ্বান করে এনসিটিবি। দরপত্রের নিয়ম অনুযায়ী কার্যাদেশের পর চুক্তি হবে, আর চুক্তির পর ৪৫ থেকে ৬০ দিনের দিনের মধ্যে ওই চার শ্রেণির বই ছাপিয়ে সরবরাহের কথা। কিন্তু ষষ্ঠ ও নবম শ্রেণির বই ছাপতে কিছু প্রেসের সঙ্গে চুক্তি হয়ে কাজ শুরু হলেও সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির বই ছাপার চুক্তিই হয়নি। ফলে আগেভাগে শুরু করেও ঝুলে আছে এসব স্তরের বই ছাপার কাজ।
এনসিটিবির মতবিনিময় সভায় দ্রুত বই ছাপা শেষের আহ্বান : বই ছাপার এমন পরিস্থিতিতে গত ৬ নভেম্বর অবসরে গিয়েছেন এনসিটিবির চেয়ারম্যান পদে অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা প্রফেসর অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী। গত ৯ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের বিশ^বিদ্যালয় শাখার অতিরিক্ত সচিব মো. মাহবুবুল হক পাটওয়ারীকে এনসিটিবির চেয়ারম্যান পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। নতুন চেয়ারম্যান দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ১২ নভেম্বর বই উৎপাদন ও বিতরণের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রেসগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করে এনসিটিবি। মতবিনিমিয় সভায় শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার এবং শিক্ষাসচিবও উপস্থিত ছিলেন। সভায় শিক্ষা উপদেষ্টা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মানসম্পন্ন বই সরবরাহের জন্য প্রেসগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। অন্যদিকে প্রেসগুলোর পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবির প্রতি অনুরোধ জানায় প্রেসগুলো। এই তিন বিষয়ের মধ্যে রয়েছেÑ প্রেসগুলোকে এনসিটিবির দেওয়া অ্যাসাইনমেন্টের (কাজ পাওয়ার সনদ) বিপরীতে ব্যাংক থেকে লোন পাওয়া দ্রুত করা, উপজেলায় বই সরবরাহের পর অনলাইনে চালান আপলোড করে দ্রুত বিলের ব্যবস্থা করা এবং যেসব জায়গায় বই ছাপার কাজ বেশি হয় যেমনÑ রাজধানীর মাতুয়াইল, রূপগঞ্জ কেরানীগঞ্জ, সাভার, নোয়াখালী ও চিটাগাং ইত্যাদি অঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন বিদুৎ সরবরাহ বজায় রাখা।
বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতির শীর্ষ এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বাস্তবতা হচ্ছে, যেকোনো মূল্যে এখন সময় ব্যবস্থাপনায় জোর দিতে হবে। নবম শ্রেণির বইয়ের কাজ শুরু হয়েছে। এই শ্রেণির বই মোটা, সময় লাগবে। তাই দ্রুত এসব বই ছাপা শেষ করে হাত খালি করে ফেলতে হবে।’
মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, ‘এনসিটিবি আগেভাগেই শুরু করেছিল, তবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় দেরি হয়ে গেছে। অনেক সমস্যা আছে, বিশেষ করে প্রেসগুলো ব্যাংক থেকে সময়মতো লোন না পেলে কাজ শুরু করতে পারবে না। আবার পেপার মিলগুলো টাকা না পেলে কাগজ সাপ্লাই দিতে পারবে না। সব মিলিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে বই সরবরাহ নিশ্চিত করা কঠিন।’
সার্বিক বিষয়ে এনসিটিবির নতুন চেয়ারম্যান অতিরিক্ত সচিব মো. মাহবুবুল হক পাটওয়ারী বলেন, ‘নির্দিষ্ট সময়ে বই দেওয়ার জন্য শিক্ষা উপদেষ্টার নেতৃত্বে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। প্রেসগুলো কিছু সমস্যার কথা আমাদের জানিয়েছেন। আগামী মঙ্গলবারের মধ্যে এই সমস্যাগুলোর ইতিবাচক সমাধানের জন্য চেষ্টা করব। আশা করি সমস্যা হবে না।’

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন