বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এমন এক ভয়াবহ বাস্তবতায় উপনীত হয়েছে, যেখানে নেতৃত্বের আহ্বান আর জনগণের জীবনের নিরাপত্তা পরস্পরবিরোধী হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গোপালগঞ্জসহ নানা জেলায় রাতের অন্ধকারে জ্বলছে ট্রাক, বাস, পিকআপÑ কিন্তু আসলে পুড়ছে জনগণের বিশ্বাস, রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও জাতির ভবিষ্যৎ। আরও উদ্বেগের বিষয়, এসব অগ্নিকা-ের নির্দেশ আসছে হাজার মাইল দূরে বসে থাকা কিছু প্রবাসী পলাতক নেতার কাছ থেকে, যারা সামাজিক মাধ্যমে ‘অবরোধ’, ‘লকডাউন’ বা ‘প্রতিরোধ’ নামে সহিংসতার আহ্বান জানাচ্ছেন। প্রশ্ন জাগেÑ এ কেমন রাজনীতি, যেখানে নেতৃত্ব বিদেশে নিরাপদ আশ্রয়ে বসে, আর মাঠে পুড়ে যায় দেশের শ্রমজীবী মানুষ? একসময় প্রবাসী রাজনীতি ছিল স্বাধীনতার সংগ্রামের সহযোদ্ধা। লন্ডন, কলকাতা, দিল্লি কিংবা আগরতলায় গঠিত হয়েছিল মুক্তির কূটনৈতিক ফ্রন্ট, যারা দেশের জন্য কাজ করেছিল। অথচ আজকের প্রবাসী রাজনীতি তার ঠিক উল্টো রূপ নিয়েছেÑ দেশের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার বিরুদ্ধে এক ধরনের ভার্চুয়াল ষড়যন্ত্রে পরিণত হয়েছে।
বিদেশে বসে তারা যেসব ‘বিপ্লবের ডাক’ দিচ্ছেন, তা বাস্তবে পরিণত হচ্ছে সাধারণ মানুষের দুঃখে, ব্যবসায়ীর ক্ষতিতে, কৃষকের কান্নায়। বিদেশের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে বসে কেউ যখন আগুন লাগানোর আহ্বান দেন, তখন তার হাতের কীবোর্ডে লেগে থাকে শ্রমিকের ঘামের রক্ত। রাজনীতি কখনোই ধ্বংসের ভাষায় টিকে থাকতে পারে না। যে আন্দোলনের উদ্দেশ্য হয় রাষ্ট্রকে বিব্রত করা, সেটি জনগণের নয়Ñ তা এক প্রকার প্রতিহিংসার প্রকাশ। পেট্রোলবোমা, অবরোধ, যানবাহনে আগুনÑ এসব কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়; বরং এগুলো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক কার্যক্রম। প্রবাসে থাকা কিছু নেতা হয়তো মনে করেন, আগুন দিয়ে সরকারকে চাপ দেওয়া যায় বা আন্তর্জাতিক সংবাদে উঠে আসা মানেই সাফল্য।
কিন্তু বাস্তবতা হলোÑ এই আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের অর্থনীতি, বিনিয়োগ, শিক্ষাব্যবস্থা ও সাধারণ মানুষের জীবন। এভাবে রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষা করা যায় না; বরং হারিয়ে যায় জনগণের আস্থা, রাজনীতির নৈতিক ভিত্তি। আজ রাজনীতি যেন পরিণত হয়েছে ভার্চুয়াল কমান্ড সেন্টারে। বিদেশে থাকা নেতারা ফেসবুক লাইভে ঘোষণা দেন, টুইটারে উসকানি দেন, আর দেশে সৃষ্টি হয় আতঙ্ক। কেউ বলেন, ‘দেশে বিপ্লব শুরু হয়েছে’; অথচ সেই বিপ্লবের আগুনে পুড়ে যায় নিরীহ চালক, দোকানদার বা স্কুলগামী শিশু। এই ডিজিটাল নির্দেশনাভিত্তিক রাজনীতি শুধু রাষ্ট্রবিরোধী নয়, এটি মানবিকতারও পরিপন্থি। যে নেতারা নিজের দেশে ফিরতে ভয় পান, তারা কি করে জনগণের জন্য জীবন দিতে পারবেন?
রাজনীতির মূল ভিত্তি হলো জনগণের বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস ভেঙে গেলে রাজনীতি হয়ে যায় ক্ষমতার লড়াইয়ের যন্ত্র। যারা জনগণের আস্থা হারায়, তারা শেষমেশ ধ্বংসাত্মক পথেই হাঁটে। প্রবাসী নেতাদের এ আগুন-নির্দেশের রাজনীতি আসলে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার শেষ চেষ্টামাত্র। জনগণ এখন রাজনীতি চায় না সহিংসতায়, তারা চায় উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও শান্তি। তারা জানেÑ রাজনৈতিক সংঘাতে প্রথম মারা যায় সাধারণ মানুষই। এই সহিংসতা শুধু অর্থনীতির ক্ষতি করছে না, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দেশের ভাবমূর্তি কলঙ্কিত করছে। বিদেশি সংবাদমাধ্যমে যখন বাংলাদেশের সড়কে আগুনের ছবি ছড়ায়, তখন বিনিয়োগকারীরা পিছিয়ে যায়, পর্যটন থেমে যায়, প্রবাসী আয়ের প্রবাহে প্রভাব পড়ে। অথচ এসবের দায় কোনো বিদেশি নয়Ñ আমাদের নিজেদেরই। যারা প্রবাসে বসে দেশের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছেন, তারা ভুলে যাচ্ছেনÑ তাদের সন্তানও একদিন এই দেশের পরিচয়ে বাঁচবে। রাজনীতি মানে আত্মত্যাগ, জনস্বার্থ, দায়িত্ববোধ।
কিন্তু আজ তা পরিণত হয়েছে প্রতিহিংসার প্রতিযোগিতায়। ক্ষমতা হারানোর প্রতিশোধ, মামলা খাওয়ার প্রতিশোধ, ব্যর্থতার প্রতিশোধÑ সব মিলিয়ে রাজনীতি এখন নৈতিকতা হারানো এক সংঘর্ষময় ক্ষেত্র। অথচ রাষ্ট্র টিকে থাকে ন্যায়ের ওপর, নয় প্রতিশোধের ওপর। তাই এখন দরকার যুক্তিনির্ভর রাজনীতিÑ যেখানে বিরোধিতা হবে আলোচনার মাধ্যমে, ভোটের মাধ্যমে, আগুন দিয়ে নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন উন্নয়নের পথে, অবকাঠামোগত পরিবর্তন দৃশ্যমান। কিন্তু এই অগ্নিসন্ত্রাস সেই পথকে বাধাগ্রস্ত করছে। এক্সপ্রেসওয়েতে আগুন মানে শুধু একটি গাড়ি জ্বলা নয়, এটি রাষ্ট্রের কোটি টাকার ক্ষতি। বিদেশে থাকা পলাতক নেতারা হয়তো ভিডিও দেখে উল্লাস করেন, কিন্তু দেশের মায়েরা হারান সন্তান, ব্যবসায়ীরা হারান পুঁজি, শ্রমিক হারান দিনমজুরি। এ কি রাজনীতি, নাকি প্রতিহিংসার নামান্তর? এখন সময় এসেছে আত্মসমালোচনার। যারা রাজনীতির নামে ধ্বংস ছড়াচ্ছেন, তাদের থামাতে হবে নৈতিক শক্তি দিয়ে।
রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে হবে যুক্তির আলোয়, সংলাপের টেবিলে। সরকারকেও বুঝতে হবেÑ সহিংসতা দমনে কেবল কঠোরতা যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা ও অংশগ্রহণমূলক পরিবেশ। অন্যদিকে বিরোধীদলকেও বুঝতে হবেÑ অগ্নিসন্ত্রাস নয়, বিকল্প চিন্তাই জনগণের মন জয় করতে পারে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়Ñ যারা দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, তারা টেকেনি। পাকিস্তানের সহযোগী রাজনীতি যেমন ইতিহাসে নিন্দিত, তেমনি আজ যারা দেশের উন্নয়নকে আগুনে পুড়িয়ে নিজেদের বৈধতা খোঁজেন, তারাও একদিন হারিয়ে যাবেন ইতিহাসের অন্ধকারে।
রাজনীতি যদি আত্মবিনাশের পথে হাঁটে, তবে তা কোনো মতাদর্শ নয়Ñ তা এক প্রকার নৈতিক আত্মহত্যা। বাংলাদেশ আজ এক সন্ধিক্ষণে। একদিকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথ, অন্যদিকে ধ্বংসাত্মক রাজনীতির গহ্বর। কোন পথে যাবে দেশÑ তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রজ্ঞা ও জনগণের সচেতনতার ওপর। এখন প্রয়োজন আগুন নয়, আলো; ধ্বংস নয়, সংলাপ; প্রতিশোধ নয়, দায়িত্ব। প্রবাসী নেতাদের উচিত দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানো, দেশের ভাবমূর্তি রক্ষা করা। বিদেশের নিরাপদ আশ্রয়ে বসে আগুন জ্বালানো নেতৃত্ব নয়Ñ এটি পলাতক মানসিকতার পরিচয়। রাজনীতি মানে জনগণের কণ্ঠস্বর, তাদের আশা ও নিরাপত্তা। যারা সেই নিরাপত্তা কেড়ে নেয়, তারা নেতৃত্ব নয়, তারা ইতিহাসের দায়ভাগী। তাই আজ আমাদের সবাইকে একসঙ্গে বলতে হবেÑ দেশ নয়, সম্পদ নয়, মানুষ নয়Ñ আমরা আর আগুনে জ্বলতে দেব না। রাজনীতি ফিরুক যুক্তির আলোয়, মানবিকতার পথে, দায়িত্বের রাজপথে।
এস এম হাসানুজ্জামান
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও কলাম লেখক

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন