শনিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


অরণ্য পাশা

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৫, ২০২৫, ০১:২৭ এএম

চট্টগ্রাম বন্দরের শুল্ক বৃদ্ধি : বাস্তবে দ্বিগুণ বোঝা

অরণ্য পাশা

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৫, ২০২৫, ০১:২৭ এএম

চট্টগ্রাম বন্দরের শুল্ক বৃদ্ধি : বাস্তবে দ্বিগুণ বোঝা

বাংলাদেশের বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দর। দেশের মোট আমদানি-রপ্তানির প্রায় ৯০ শতাংশ পণ্য এই বন্দর দিয়ে যায়। তাই বন্দরের যেকোনো নীতি পরিবর্তন বা ফি বৃদ্ধি কেবল ব্যবসায়ী নয়, পুরো অর্থনীতির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) ঘোষণা করেছে, তাদের সার্ভিস চার্জ বা ট্যারিফ গড়ে ৪১ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। তবে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এই ‘গড় বৃদ্ধি’Ñ এর আড়ালে অনেক ক্ষেত্রেই খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ বা তারও বেশি।

বন্দরের নতুন চার্জ কাঠামো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এফসিএল (ঋঁষষ ঈড়হঃধরহবৎ খড়ধফ) বা পুরো কনটেইনারের হ্যান্ডলিং চার্জ বেড়েছে প্রায় ৬৩ শতাংশ। কিন্তু এলসিএল (খবংং ঃযধহ ঈড়হঃধরহবৎ খড়ধফ), যেখানে ছোট ব্যবসায়ীরা আংশিক কনটেইনার ব্যবহার করেন, সেখানে বৃদ্ধি হয়েছে ১৫৬ শতাংশ পর্যন্ত। অর্থাৎ যারা পুরো কনটেইনার ভরতে পারেন না, তাদেরই সবচেয়ে বেশি আঘাত করছে এই পরিবর্তন। সিপিএ বলছে, ‘গড় বৃদ্ধি ৪১ শতাংশ’, কিন্তু এই গড়ের মধ্যে ছোট ব্যবসায়ীদের বাস্তব কষ্ট ঢেকে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা খাতই দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। তারা কর্মসংস্থান তৈরি করে, স্থানীয় পণ্য সরবরাহ করে এবং রপ্তানি শৃঙ্খলেও ভূমিকা রাখে। কিন্তু এ খাতের বেশিরভাগ উদ্যোক্তা বড় কোম্পানির মতো বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি বা রপ্তানি করতে পারেন না। এলসিএল ব্যবস্থাই তাদের জন্য একমাত্র বিকল্প। এখন সেখানে যদি ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত খরচ বেড়ে যায়, তাহলে তাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।

অন্যদিকে, বড় প্রতিষ্ঠান সহজেই এই বাড়তি খরচ পণ্যের দামে যুক্ত করতে পারে। কিন্তু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তা পারেন না, ফলে প্রতিযোগিতার বাজারে তারা পিছিয়ে পড়ছেন। দীর্ঘমেয়াদে এটি বাজারের ভারসাম্য নষ্ট করবে, ছোট ব্যবসায়ীরা বাদ পড়বেন, বড়দের দাপট বাড়বে। অর্থনীতিতে যে বৈচিত্র্য ও ভারসাম্য থাকা দরকার। সেটি নষ্ট হবে।

শুল্ক বৃদ্ধি কেবল ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ নয়। এটি সরবরাহ ব্যবস্থার পুরো শৃঙ্খলে ঢেউ তুলেছে। জাহাজ পরিচালনাকারী, ট্রান্সপোর্ট অপারেটর, গুদাম মালিক, সবার খরচ বেড়ে গেছে। আর এই বাড়তি খরচ শেষ পর্যন্ত পণ্যের দামে প্রতিফলিত হয়। ফলে সাধারণ ভোক্তা বাজারে গিয়ে বুঝতেও পারেন না যে তার চাল, তেল, বা কাপড়ের দাম বাড়ার পেছনে বন্দরের ট্যারিফ বৃদ্ধিই মূল কারণ।

এভাবে এটি এক ধরনের ‘লুকানো মুদ্রাস্ফীতি, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সরকারের পরিসংখ্যানে ধরা পড়ে না। কিন্তু বাস্তবে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। কয়েকটি গণমাধ্যমে তথ্য এসেছে, কিছু ক্ষেত্রে এমন চার্জ আরোপ করা হয়েছে যা বাস্তবে ব্যবহারই হয়নি। যেমন, টাগ বোট বা টাগ হায়ার ব্যবহার না করা জাহাজকেও সেই চার্জ দিতে হয়েছে। বিশেষ করে স্ক্র্যাপ জাহাজ যারা নিজস্ব ইঞ্জিন ব্যবহার করে চলে যায়, তাদেরও ‘টাগ চার্জ’ দেওয়া হয়েছে। এসব উদাহরণ প্রশ্ন তোলে, এই শুল্ক বৃদ্ধি কি সত্যিই খরচ বৃদ্ধির কারণে, নাকি রাজস্ব বাড়ানোর উদ্দেশ্যে? বন্দর কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, নতুন ট্যারিফ কাঠামো ১৪ বছর পর হালনাগাদ করা হয়েছে। কারণ পুরোনো হার আর বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। কিন্তু ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কোনো পরামর্শ বা সংলাপ হয়নি। যারা প্রতিদিন বন্দরের সেবা ব্যবহার করেন, তাদের মতামত না নিয়েই হঠাৎ এই বৃদ্ধি কার্যকর করা হয়েছে। এতে নীতির বৈধতা যেমন প্রশ্নবিদ্ধ, তেমনি আস্থার সংকটও তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশের রপ্তানি আয় মূলত তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। এ খাত বর্তমানে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা, ইউরোপ ও আমেরিকার অর্ডার হ্রাস, এবং ডলারের ঊর্ধ্বগতির মতো চাপে আছে। এমন পরিস্থিতিতে বন্দরের শুল্ক দ্বিগুণ বেড়ে গেলে তারা আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকতে পারবে না। পোশাকশিল্প এমনিতেই ‘লো মার্জিন’ ব্যবসা, এক শতাংশ খরচ বাড়লেই বড় ক্ষতি হয়। এখন যদি লজিস্টিক খরচ ১০-১৫ শতাংশ বাড়ে, তা সরাসরি রপ্তানি আয় কমিয়ে দেবে।

এই বাস্তবতায় সরকার যদি রপ্তানি উৎসাহিত করতে চায়, তাহলে বন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় হঠাৎ শুল্ক বৃদ্ধি নয়, বরং ধাপে ধাপে বাস্তবায়নই শ্রেয়।

একটি বন্দর শুধু রাজস্বের উৎস নয়, এটি দেশের বাণিজ্য চক্রের হৃৎপি-। বন্দরের প্রতিটি চার্জের পরিবর্তন ট্রাক ভাড়া থেকে শুরু করে গুদাম খরচ পর্যন্ত প্রভাব ফেলে। তাই সিপিএ-এর সিদ্ধান্ত শুধু তাদের আয় বাড়ানোর বিষয় নয়, এটি জাতীয় অর্থনীতির স্থিতিশীলতার সঙ্গে সম্পর্কিত। এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো স্বচ্ছতার অভাব। কোনো সার্ভিসে কত শতাংশ বৃদ্ধি হলো, কেন তা প্রয়োজন, সেই তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। অথচ এই তথ্য প্রকাশ করলে ব্যবসায়ীরা প্রস্তুতি নিতে পারতেন। ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য ধাপে ধাপে বৃদ্ধি বা বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা করা গেলে আঘাতটা কিছুটা প্রশমিত হতো।

বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের করণীয় কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট। স্বচ্ছ ব্যাখ্যা প্রকাশ : সিপিএ-কে প্রতিটি চার্জ বৃদ্ধির যৌক্তিকতা বিস্তারিতভাবে জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। পরামর্শ প্রক্রিয়া পুনর্বিন্যাস : ভবিষ্যতে যেকোনো পরিবর্তনের আগে ব্যবসায়ী সংগঠন, চেম্বার, আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকদের সঙ্গে আলোচনার প্রথা চালু করা জরুরি। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য প্রণোদনা : যারা ছোট পরিসরে কাজ করে। তাদের জন্য ট্যারিফ বৃদ্ধির হার কমানো বা বিশেষ ছাড় দেওয়া যেতে পারে। সমন্বিত বাণিজ্যনীতি : বন্দর, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে যৌথভাবে দেখতে হবে, ট্যারিফ কাঠামো দেশের সামগ্রিক বাণিজ্যনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না।

চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যারিফ বৃদ্ধি এখন জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। ঘোষিত ৪১ শতাংশ বৃদ্ধির আড়ালে বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই দ্বিগুণ বা তারও বেশি খরচ বেড়েছে। এর ফলে ছোট ব্যবসায়ীর ওপর চাপ, সরবরাহ ব্যবস্থায় অস্থিরতা, এবং ভোক্তা পর্যায়ে দাম বৃদ্ধি, সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতিতে অদৃশ্য এক চাপ তৈরি করছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে প্রতিটি নীতি পরিবর্তন হাজারো জীবনের ওপর প্রভাব ফেলে। তাই অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণে প্রয়োজন সংলাপ, স্বচ্ছতা এবং ধীরগতির বাস্তবায়ন। চট্টগ্রাম বন্দর শুধু রাজস্ব সংগ্রহের জায়গা নয়, এটি দেশের বাণিজ্যিক রক্তসঞ্চালন ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় যদি হঠাৎ চাপ দেওয়া হয়, তাহলে পুরো অর্থনীতিই দুর্বল হয়ে পড়বে।

অতএব, বন্দরের ট্যারিফ বৃদ্ধি কেবল পরিসংখ্যান নয়, এটি এখন এক গভীর অর্থনৈতিক সংকেত। যদি স্বচ্ছতা ও যুক্তির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত না নেওয়া হয়, তবে এই ‘৪১ শতাংশ’ দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের ব্যবসা ও জনগণের জন্য উদ্বেগের প্রতীক হয়েই থাকবে।

অরণ্য পাশা
লেখক : সাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!