২০১২ সালে শেষের দিকে আমি কিছুদিন বার্মিংহামের উলভারহ্যাম্পটন ইউনিভার্সিটিতে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অধিকারী টেলফোর্ড ক্যাম্পাস মন ছুঁয়ে যায়। ঘাসের কার্পেটে মোড়া ক্যাম্পাসের চারদিকে বৃক্ষরাজির সমাহার। ঘন সুনিবিড় ছায়াবীথি এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে ক্যাম্পাসের মধ্য দিয়ে। মাঝেমধ্যে বনের ভিতরে অজানা দুয়েকটি পাখির ডাক সৌন্দর্যের অনুভূতিকে আরও গভীর করে দেয়। চকিতে নাম না জানা পাখির দেখাও মেলে, আবার হারিয়ে যায় বনের মধ্যে। তবে দোয়েল চিনতে ভুল হয় না। আমাদের দোয়েলের তুলনায় ব্রিটিশ দোয়েলের আকার একটু বড় হলেও স্বভাব-চরিত্রে আমাদের মতোই।
আমাদের কোর্স পরিচালক ছিলেন র্যাচেল রোল্যান্ড। ভদ্রমহিলার বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ দেখে অবাক হই। যখন আমি ফেসবুকে পাখির ছবি ‘আপলোড’ করি তখন তিনি অবাক হয়ে বলেন, ‘ব্রিটিশ পাখিরা বাংলাদেশের পাখিদের মতো রঙে এত বৈচিত্র্যময় না হলেও রাজনীতিতে বড় পাকা, কে কাকে টেক্কা দিবে তা নিয়ে ব্যস্ত থাকে।’ আমি বলি, ‘হ্যাঁ, তা তো বটে। ব্রিটিশদের কাছ হতে কীভাবে টেক্কা দিতে হয় শিখেছে!’
যা হোক আসল কথায় আসি। আমি মাঝেমধ্যে খুলনায় গেলে গ্রামীণ পরিবেশে থাকতে পছন্দ করি। সেখানে চারদিকে প্রাচীর-বেষ্টিত গাছ-গাছালির মধ্যে পাখিদের বাস। আমি পাখিদের অনুসরণ করতে ভালোবাসি। পাখিদের খাদ্য নিয়ে ঝগড়া, কোলাহল, বাসা তৈরির অভিনব কৌশল, প্রজনন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি আমাকে ভীষণ কৌতূহলী করে।
কিছুদিন আগে আমবাগানের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখি হঠাৎ একটি অদ্ভুত পাখি মাটি থেকে উড়ে দূরে বসল। পাখিটি ইতোপূর্বে কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না। গায়ের রঙ খয়েরি এবং হালকা খয়েরি দাগ কাটা। মাথাটি একটু চেপ্টা ও তার উপরে খয়েরি রঙের দাগ। গলার নিচে সাদা দাগ রয়েছে। চোখটি লম্বা এবং কালো। লেজটি লম্বা। শুকনো পাতার মধ্যে বসে থাকলে গায়ের রঙ ও পাতার রঙ একই রকম বলে হঠাৎ করে শনাক্ত করা কঠিন।
পাখিটি সাধারণত মাটিতে বসে থাকে। তাড়া দিল উড়ে একটু দূরে গিয়ে আবার মাটিতেই বসে পড়ে। ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখি পাখিটির নাম ল্যাঞ্জা রাতচরা (লার্জ টেইলড নাইটজার)।
কয়েকদিন পর আবার পাখিটি আমাকে দেখে মাটি থেকে উড়ে যায়। এগিয়ে গিয়ে দেখি, মাটির মধ্যে দুটি হালকা খয়েরি রঙের মধ্যে ছোপ ছোপ গাঢ় খয়েরি দাগ বিশিষ্ট দুটি ডিম পড়ে আছে। খুবই কৌতূহল নিয়ে ডিম দুটি দেখলাম। কেউ যাতে ডিমটি স্পর্শ না করে সেদিকে সকলকে সতর্ক করলাম। পরের দিন বিকেলবেলা বাগানে পরিচিত একজন এসে দুটি ডিম মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে হাতে করে নিয়ে আসেন। তিনি মনে করেছে আমরা হয়তো দেখিনি। আমরা তাকে বকাবকি করলে তিনি আবার রেখে আসেন। একটু পর গিয়ে দেখি দুটি ডিমের একটি ভাঙা। পাখিটিকে আশপাশে দেখা গেল না। আমি খুব হতাশ ও বিরক্ত হলাম।
প্রায় এক মাস পরে আবার বাগানের মধ্যে হাঁটতে গিয়ে একইভাবে পাখিটি আমার সামনে দিয়ে মাটি থেকে উড়ে চলে যায়। এবার ওড়াটা কেমন একটু অস্বাভাবিক মনে হয়। কারণ উড়ে আবার আগের জায়গায় আসার চেষ্টা করে ভয়ে পালিয়ে যায়। আমি তার বসে থাকার স্থানে গিয়ে দেখতে পাই একটি বাচ্চা ফুটেছে ও আরও একটি ডিম রয়েছে ফোটার অপেক্ষায়। আমি শুধু ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে ওই জায়গা হতে দ্রুত প্রস্থান করি। এবার আর কাউকে কিছু বলিনি।
পাখিটি লম্বায় ৩০-৩৩ সে.মি. পর্যন্ত হয়ে থাকে। এরা সাধারণত দিনের বেলা ঘুমায় এবং রাতের বেলা ওড়াউড়ি করে। ফসলের পোকা-মাকড় এদের খাদ্য। দিনের বেলা খুব একটি দেখতে পায় বলে মনে হয় না। সন্ধ্যা রাতে এদের ডাকে এক ধরনের ভয়ার্ত পরিবেশের সৃষ্টি হয়। পাখিটির নিবাস বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে। একসময় প্রচুর সংখ্যক দেখতে পাওয়া যেত। সাধারণত বাঁশঝাড়, গোরস্তান, পোড়ো বাড়ি এরকম নির্জন স্থানে থাকতে ভালোবাসে। প্রজনন ও খাদ্য সংকটের কারণে এখন আর তেমন দেখা যায় না। মাটিতে ডিম পাড়ায় বিভিন্ন ধরনের পশু, পাখি ও মানুষের উপদ্রবে এরা বংশ বিস্তার করতে পারে না। বিপন্ন প্রজাতির এই পাখিটি হয়তো একদিন বাংলাদেশ হতে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
লেখক : সাবেক সিনিয়র সচিব ও বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন