নারী-পুরুষের সম্মেলনে সৃষ্ট এই পৃথিবীতে দুজনই অপরিহার্য। একজন আরেকজনের পরিপূরক। কিন্তু উনিশ শতকের গোড়ার দিকে মেয়েরা বাড়ির বাইরে পা রাখার কথাই ভাবতে পারত না, পড়াশোনা ছিল তো কল্পনারও বাইরে! বেগম রোকেয়াই প্রথম নারী, যিনি নারীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অগ্রযাত্রায় প্রথম সোপান হিসেবে পুরুষের পাশাপাশি নারী শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক সমাজ তিনি কল্পনা করলেও সমাজ তখন প্রস্তুত ছিল না। পদে পদে বাধা সত্ত্বেও তিনি থেমে থাকেননি। তার নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন নারী জাগরণ তথা নারীর স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায়। নারীকে মানুষ হিসেবে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন থেকেই তার চিন্তা, কর্ম এবং লেখনী সমান তালে চলেছে। তার দৃঢ়চেতা মনোবল, আত্মবিশ্বাস তাকে সফলতার দিকে নিয়ে গেছে। তিনি জেগে জেগে যে স্বপ্ন রচনা করেছিলেন তা আজ বাস্তব।
এখন নারীরা অবাধে পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন পেশায় কাজ করছে। আজ আমরা বাঙালি নারীরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, বেগম রোকেয়া তার ভিত তৈরি করে গেছেন। নারী-জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া রাতের আকাশে তারা হয়ে ফুটেছিলেন; অন্ধকারে জ্বলেছিলেন প্রদীপের মতো। নিজের ভেতরের আলোর ছটায় আলোকবর্তিকা হাতে নারী সমাজকে পথ দেখিয়েছেন।
মানুষের জীবনে বিভিন্ন রকমের আশা-আকাক্সক্ষা, উচ্চাভিলাষ থাকে। ভবিষ্যতের নানা রঙিন স্বপ্ন বুনতে গিয়ে অনেকেই সফল হয় না। কিন্তু রোকেয়া ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা; তিনি সময় থেকে অনেক দূরে দেখতে পেতেন বলেই তার স্বপ্ন বাস্তবজীবনে অভিনব রূপ নিয়ে প্রস্ফুটিত হয়েছে। নারীদের জাগ্রত করার যে স্বপ্ন বুনেছিলেন তাতে তিনি সফল হয়েছিলেন। জীবনের এক সোনালি সকালে বেগম রোকেয়া তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় নারী-জাগরণের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন; সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়ণের জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল এবং আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম। এ দুটি প্রতিষ্ঠান গড়ার সুফল তিনি জীবনকালেই দেখে গেছেন।
রোকেয়া ছিলেন শিক্ষানুরাগী বিজ্ঞানমনস্ক একজন মানুষ। ‘সুলতানার স্বপ্ন’ গ্রন্থসহ বিভিন্ন গল্প ও নিবন্ধে তিনি আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা আজ বাস্তব। আজকে আমরা তার সেই স্বপ্ন যাত্রার সুফলভোগী। ‘সুলতানার স্বপ্ন’ ১৯০৫ সালে যখন রচিত হয়, তখন এরোপ্লেন বা জেপেলিনের কোনো অস্তিত্ব ছিল না! এমনকি সে সময় ভারতবর্ষে মোটরকারও আসেনি। বৈদ্যুতিক আলো এবং পাখা ছিল কল্পনারও অতীত। এর ছয় বছর পর ১৯১১ সালে রোকেয়া কলকাতায় আসার পর হাওয়াই জাহাজ দূর হতে শূন্যে উড়তে দেখেছিলেন। তিনি নিজে কোনোদিন উড়ো জাহাজে উঠতে পারবেন, সে আশা না করলেও বাস্তবে ‘সুলতানার সেই বিচিত্র স্বপ্ন’ তার নিজের জীবনে ফলেছিল। ‘বায়ুযানে পঞ্চাশ মাইল’ ছোট গল্পে তার নিজের উক্তি, ‘২৫ বছর পূর্বে লিখিত ‘সুলতানার স্বপ্নে’ বর্ণিত বায়ুযানে আমি সত্যই বেড়াইলাম। বঙ্গের প্রথম মুসলিম পাইলটের সহিত যে প্রথম অবরোধ-বন্দিনী নারী উড়িল সে আমিই।’
সুদূর অতীতে কল্পনার চোখে যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, যার সাফল্যের আনন্দে সেদিন তার বুক ভরে উঠেছিল। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের জাদুকরী শক্তির বিকাশের চেয়েও তার বড় স্বপ্ন ছিল নারীর জাগরণ; এটিই ছিল তার আরাধনা। আনন্দের বিষয় এই যে, তার দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষা বিফলে যায়নি। তার মৃত্যুর কয়েক মাস পূর্বে রোকেয়া জীবনী রচয়িতা শামসুন নাহার একটি নারী সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। এই সম্মেলনে বেগম রোকেয়া সভানেতৃত্ব করেন। এ সময় নারীদের সাফল্যের গৌরবে তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘আজ আমি আপনাদের দেখিয়া যারপর নাই সন্তুষ্ট হইলাম। প্রায় পঁচিশ বছর হইতে আমি মুসলিম নারী সমাজকে জাগাইবার চেষ্টা করিয়া আসিতেছি; কিন্তু ঘুম তাহাদের কিছুতেই ভাঙিতেছিল না। ডাকিয়া ডাকিয়া জাগাইÑ আবার পাশ ফিরিয়া ঘুমান। বাইশ বছর ধরে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল পরিচালনা করিয়া দেখিলাম, তাহারা আগে পাশ ফিরিয়া ঘুমাইতেন, পরে উঠিয়া বসিয়া ঝিমাইতেনÑ কিন্তু গা ঝাড়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইতেন না। সুখের বিষয় এদিকে কয়েক বছর হইতে দেখিতেছি, তাহারা চোখ রগড়াইয়া জাগিয়া উঠিয়াছেন। তাহারই ফলে আজ এতগুলো শিক্ষিতা মহিলাকে দেখিতে পাইয়া চক্ষু জুড়াইল।’ সেদিন তিনি আরও বলেছিলেন, ‘যাহারা সাহস করিয়া অবরোধের নাগপাশ ছিঁড়িতে পারিয়াছেন তাহারাই এ কাজে অগ্রসর হোন।’ এই কথাগুলো বলতে বলতে আশা ও বিশ্বাসের দীপ্তিতে রোকেয়ার দুচোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। সেদিন তাকে আর নারী জাতির জন্য কাঁদার লোক খুঁজতে হয়নি। জাগ্রত নারী শক্তিতে তার চেয়ে বেশি আস্থাবান আর কেউ ছিল না। বাস্তবিক পক্ষে যাদের দায়িত্ব, তাদেরই হাতে তুলে দিতে পেরে তিনি তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলেছিলেন।
শামসুন নাহারকে বিএ পরীক্ষা দেওয়ার জন্য রোকেয়া উদ্বুদ্ধ করেন। নাহার বিএ পাস করাতে রোকেয়ার আনন্দ-উচ্ছ্বাস এতটাই বেশি ছিল যে, তিনি নাহারের বিএ পাস উপলক্ষে একটি মহিলা সভার আয়োজন করেন। সভায় অভিনন্দনপত্র পাঠ করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার সেই বত্রিশ বছর পূর্বের মতিচুরে কল্পিত লেডি ম্যাজিস্ট্রেট, লেডি ব্যারিস্টারের স্বপ্ন আজ বাস্তবে পরিণত হইতে চলিয়াছেÑ আমার এ আনন্দ রাখিবার স্থান কোথায়? অনেকেই আরদ্ধ কাজের সমাপ্তি নিজের জীবনে দেখিতে পান না। যে বাদশাহ কুতুবমিনার আরম্ভ করিয়াছিলেন, তিনি তাহার শেষ দেখিয়া যাইতে পারেন নাই। কিন্তু আমার মিনারের সাফল্য আজ আমি স্বচক্ষে দেখিতে পাইলাম।’
বাস্তবিকই রোকেয়া আজ মরণের পরপার থেকেও দেখতে পাচ্ছেন তার বড় সাধের সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলের আজ কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি বর্তমানে সরকারি হাইস্কুল হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। নারীর উচ্চশিক্ষার জন্য আজ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্রই অবারিত প্রবেশাধিকার রয়েছে। কোথাও কোথাও শুধু নারীদের জন্য পৃথক স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে। দৃঢ়চেতা রোকেয়া প্রতিকূল সমাজের মধ্যে থেকেও আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম সমিতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারীর উন্নয়নের ধারায় কর্মের যে স্রোত বইয়ে দিয়েছিলেন তাও দিনে দিনে প্রখর হতে প্রখর হয়ে বয়ে চলছে। রোকেয়ার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশেও নারীর উন্নয়ন, ক্ষমতায়ন ও অধিকার সুরক্ষায় কতশত সরকারি-বেসরকারি দপ্তর সংস্থা, সংগঠন গড়ে উঠেছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর, জাতীয় মহিলা সংস্থা, জয়িতা ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বাংলাদেশ মহিলা সমিতি, নারীপক্ষ, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ, নিজেরা করি, কন্যাশিশু এডভোকেসি ফোরাম ইত্যাদি।
বর্তমানে নারী জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখাতেই শিক্ষা লাভের পাশাপাশি বিভিন্ন চ্যালেঞ্জিং পেশায় নিয়োজিত থেকে সাফল্য অর্জন করছেন। একদিকে বিচার বিভাগের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি, অপরদিকে নির্বাহী বিভাগে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সিনিয়র সচিব, বিভিন্ন সংস্থাপ্রধান, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ পেশাসহ সব ধরনের চাকরিতে নারীরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনীতেও নারী কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালনে অসাধারণ দক্ষতা প্রদর্শন করছেন। এমনকি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে তিন বাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের নারী সদস্য নিয়োজিত থেকে বিদেশের মাটিতে গৌরবোজ্জ্বল অবদান রেখেছেন। সেনাবাহিনীতে নারী মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি সামরিক বাহিনীতে নারীর ক্ষমতায়নের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বর্ণিত প্রেক্ষাপটে প্রতীয়মান হয় যে বিভিন্ন পেশায় নারীর অংশগ্রহণ ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়ার স্বপ্নের অতিক্রমণ ঘটেছে।
কিন্তু এতসব অর্জন সত্ত্বেও এখনো প্রতিনিয়তই গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে বাংলাদেশে নারী ও শিশুধর্ষণের সংবাদ পাওয়া যায়। ঘরে-বাইরে নারীকে পারিবারিক ও যৌন সহিংসতার শিকার হতে হচ্ছে। গ্রাম-গঞ্জে অধিকাংশ নি¤œবিত্ত পরিবারে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত পরিবারে বিবাহিত নারীদের বাঁধা গৃহকর্মীদের চেয়েও খারাপ অবস্থায় জীবনযাপন করতে হয়। বিনা পারিশ্রমিকে ঘরসংসারের সব কাজ, সন্তান লালন-পালন, আত্মীয়-স্বজনের তত্ত্বাবধান ইত্যাদি সবকিছুর পরেও প্রশংসা সূচক কোনো শব্দের পরিবর্তে পান থেকে চুন খসলেই উপহার মেলে মুখ ঝামটা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শারীরিক নিপীড়নেরও শিকার হতে হয়। বেগম রোকেয়া সুলতানার স্বপ্নে দেখিয়েছেন অপূর্ব এক নারী রাজত্ব। যেখানে দুঃখ-কষ্ট, অশান্তির লেশমাত্র নেই। সেখানে চারদিকে শান্তি আর শান্তি। বাস্তবে সেসময়ের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় নারীর কর্মক্ষমতাকে ব্যবহার না করে অর্ধেক জনশক্তির অপচয় করলেও রোকেয়া কল্পিত নারীস্থানের অর্ধেক জনসম্পদ পুরুষকেও তাদের সাধ্যমতো দেশের উন্নতির কাজে লাগিয়েছেন। তিনি তার বিভিন্ন লেখনীতে ভাইদেরকে বোনদের পাশে চেয়েছেন। অতএব বলতেই পারি, নারীর প্রতি পারিবারিক ও যৌন সহিংসতা নিরসনে শুধু নারীকে জাগালেই হবে না; পুরুষদেরকেও জাগাতে হবে। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন করে তাদেরকেও নারীর সহযোগী হিসেবে পাশে থাকার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এটি এখন সময়ের দাবি।
বেগম রোকেয়ার সমগ্র জীবন-চরিত বিশ্লেষণ করলেই আমরা দেখতে পাই যে, নারীশক্তিতে তিনি পুরোপুরি বিশ্বাসী ছিলেন; তার নারীত্বের আদর্শ অনেক মহৎ ছিল। এই কিংবদন্তিতুল্য নারী তার ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে নারীর প্রতি সমাজের অন্যায় ও বৈষম্যমূলক আচরণের মূলে কুঠারাঘাত করেছিলেন। পরিবার, সমাজ ও অর্থনীতি জীবনের এই তিন প্রধান অনুষঙ্গে নারীকে আত্মমর্যাদাশীল হতে তিনি নারী সমাজকে গভীরভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। নারীরা আজ ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, অর্থনীতি সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যাচ্ছে। নারী আজ পুরুষের সঙ্গে সমানতালে চলছে। নারী আজ প্লেন চালায়, ট্রেন চালায়। তার আদর্শ যুগে যুগে বাংলার নারীদের অনুপ্রেরণা যোগাবে। রোকেয়ার স্বপ্নের নারীরা সর্বত্রই কর্মের যে স্বাক্ষর রাখছে তার সকল কৃতিত্বের দাবিদার বেগম রোকেয়া বললে অত্যুক্তি হবে না।
নাছিমা বেগম
সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও সাবেক সিনিয়র সচিব

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন