আবেদ আল-আজিজ আবু হাবিশাল। ১৫ বছর বয়স। সে এমন দৃশ্য দেখেছে, যা কোনো কিশোর-কিশোরীর কখনো দেখা উচিত নয়। আবেদ বলেছে, ‘আমরা গাজা শহরের একটি বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছিলাম, যখন ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আক্রমণ করে। তারা আমাকে একটি ট্যাংকের কাছে টেনে নিয়ে যায় এবং একজন সৈন্য তার বন্দুক আমার মাথায় তাক করে।’ গাজার অনেকের কাছেই এটা স্পষ্ট যে ইসরায়েলের যুদ্ধ কখনোই শেষ হবে না। এমনকি যদি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি অবরুদ্ধ উপত্যকাটিতে ইসরায়েলের ভয়াবহ আক্রমণ বন্ধ করতে সফলও হয়, তবুও দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধে বেঁচে থাকা ফিলিস্তিনিদের মনে বোমা বিস্ফোরণের তীব্র আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হবে। তার বাড়ির কাছে যে ‘গণহত্যা’র দৃশ্য সে দেখেছিল, তা হয়তো কখনোই সে ভুলতে পারবে না। সে বলেছে, বোমা বিস্ফোরণে সে মানুষের দেহের খ-াংশ উড়ে যেতে দেখেছে। এমনকি নিজের প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ানোর সময় লাশের ওপর পা দিয়েছে, মাথাবিহীন নারীর লাশ দেখেছে। মানসিক আঘাতের ফলে তার শরীরে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। যার ফলে উচ্চ রক্তচাপ, দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়া এবং সম্প্রতি তার কিডনি বিকল হয়ে গেছে। একইভাবে, আট বছর বয়সি লানা আল-শরীফের ওপর মানসিক আঘাতের স্পষ্ট চিহ্ন রয়েছে। খান ইউনিসের বাস্তুচ্যুত শিবিরের অন্য বাসিন্দারা তাকে ‘বৃদ্ধ শিশু’ বলে ডাকে, কারণ তার একসময়ের কালো, ঘন চুল এখনই সাদা হতে শুরু করেছে। তার বাবা খলিল আল-শরীফ বলেন, ইসরায়েলি বিমান হামলায় তাদের বাড়ির ছাদ ভেঙে পড়ার পরও লানা বেঁচে যায়। ক্ষেপণাস্ত্রের ধোঁয়া ও রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসায় সে ভিটিলিগো নামে একটি দীর্ঘস্থায়ী ত্বকের রোগে আক্রান্ত হয়েছে। ফলে তার ত্বক, চুল ও চোখের রঙ নষ্ট হয়ে গেছে। তার বাবা বলেন, ‘অনেক ডাক্তার তার চিকিৎসা করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। প্রতিবার বিস্ফোরণের শব্দ শুনলেই সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।’
মনোবিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেছেন, গাজার ৮০ শতাংশেরও বেশি শিশু এখন গুরুতর মানসিক আঘাতে ভুগছে। মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত শিশুদের চিকিৎসা করা থেরাপিস্ট সাবরিন আবু রহমান বলেন, মানসিক আঘাতের লক্ষণগুলোর মধ্যে প্রায়ই মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা, হাড়ের ব্যথা, চুল পড়া, ভিটিলিগো ও দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে।
জাতিসঙ্ঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফের মতে, গাজায় ৬৪ হাজারেরও বেশি শিশু নিহত বা আহত হয়েছে। ঘরবাড়ি, হাসপাতাল ও স্কুল ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পরিষেবা ভেঙে পড়েছে। ইউনিসেফের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার আঞ্চলিক পরিচালক এডুয়ার্ড বেগবেডার বলেন, ‘প্রতিদিন ১০ লাখ শিশু বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থানে বেঁচে থাকার ভয়াবহতা সহ্য করছে। তাদের মধ্যে ভয়, ক্ষতি ও শোকের ক্ষত থেকে যাচ্ছে।’
রেড ক্রসের মাধ্যমে গাজা থেকে আগের রাতে পাওয়া তিনটি লাশ ফিলিস্তিনি ভূখ-ে আটক ব্যক্তিদের নয়। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী শনিবার এ কথা জানিয়েছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এএফপিকে জানিয়েছে, ফরেনসিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে মার্কিন মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে যে ১১ জন নিহত বন্দিকে এখনো হস্তান্তর করা হয়নি, এগুলো তাদের লাশ নয়। যুদ্ধবিরতি শুরুর পর থেকে ইতিমধ্যেই ১৭টি লাশ ফেরত দেওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ১৫ জন ইসরায়েলি, একজন থাই ও একজন নেপালি নাগরিকের লাশ। ১০ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি শুরুর পর, হামাস তাদের হেফাজতে থাকা ২০ জন জীবিত জিম্মিকে ফেরত দেয় এবং মৃত বন্দিদের লাশ ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে। ইসরায়েল হামাসের বিরুদ্ধে চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ এনেছে। তবে ফিলিস্তিনি দলটি বলছে যে, গাজার ধ্বংসাবশেষে চাপা পড়া লাশ খুঁজে পেতে সময় লাগবে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রধান আইন কর্মকর্তা মেজর জেনারেল ইয়াফাত তোমের-ইয়েরুশালমি পদত্যাগ করেছেন। গাজা যুদ্ধ চলাকালে এক ফিলিস্তিনি বন্দিকে নির্যাতনের ভিডিও ফাঁসের ঘটনায় তার অনুমোদনের কারণে শুরু হওয়া ফৌজদারি তদন্তের দায়ে শুক্রবার তিনি এ সিদ্ধান্ত নেন। ২০২৪ সালের আগস্টে ওই ভিডিও ফাঁসের অনুমোদন দেন তিনি। এরপর সেনা সদস্যদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে এবং পাঁচজন সেনার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের হয়। ঘটনাটি ইসরায়েলের রাজনীতিতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ডানপন্থি রাজনীতিবিদরা তদন্তের সমালোচনা করেন এবং ক্ষুব্ধ সেনাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাওয়ায় দুটি সামরিক ঘাঁটিতে হামলাও চালান বিক্ষোভকারীরা। বিক্ষোভকারীদের অনুপ্রবেশের এক সপ্তাহ পর ইসরায়েলের এন১২ নিউজ চ্যানেলে নিরাপত্তা ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিওটি ফাঁস হয়। এতে দেখা যায়, সেনারা এক বন্দিকে আলাদা করে নিয়ে যাচ্ছে এবং একত্রিত হয়ে তার চারপাশে ভিড় করছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ কুকুর ধরে রাখে এবং দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণের সরঞ্জাম ব্যবহার করে দৃষ্টির আড়ালে নির্যাতনের কাজটি ঢেকে রাখে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ বুধবার জানান, ভিডিও ফাঁসের ঘটনাটি নিয়ে এখনো ফৌজদারি তদন্ত চলছে এবং তোমের-ইয়েরুশালমিকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামাসের অভিযোগ, দখলদার বাহিনী গাজায় আগ্রাসন চালিয়ে যেতে মিথ্যা অজুহাত তৈরি করছে। সর্বশেষ হামলার আগে তারা এ পর্যন্ত ১২৫ বার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে। ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলি আক্রমণ আরও দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা করছেন। কারণ, ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান এবং গোয়েন্দা বিমান আগের মতোই আকাশে ঘোরাফেরা করছে।
গাজা উপত্যকায় নতুন করে ইসরায়েলি বিমান হামলায় অন্তত তিনজন নিহত হয়েছেন। একই দিনে ইসরায়েল ফেরত দিয়েছে ৩০ ফিলিস্তিনি বন্দির মরদেহ, যাদের অনেকের শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের মাধ্যমে শুক্রবার এই মরদেহগুলো গাজায় ফেরত দেওয়া হয়। সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও ইসরায়েলি বাহিনী গাজা সিটির শুজাইয়া এলাকা, জাবালিয়া শরণার্থী শিবির ও খান ইউনিসে হামলা চালায়। ওয়াফা সংবাদ সংস্থার বরাতে জানা যায়, গুলিতে একজন নিহত ও আরেকজন আহত হন; জাবালিয়ায় গোলাবর্ষণে আরও একজন মারা যান। এর বাইরে, আগের এক হামলায় আহত আরেক ব্যক্তি মারা গেছেন। গাজার কেন্দ্রে বেসামরিক উদ্ধারকর্মীরা আবু মেদেইন পরিবারের ধ্বংসস্তূপ থেকে আরও একজনের মৃতদেহ উদ্ধার করেছেন। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, ফেরত আসা মরদেহগুলোর মধ্যে অনেকের হাত বাঁধা ও চোখ বাঁধা ছিল, কিছু দেহে পুড়ে যাওয়ার চিহ্ন, আবার কিছু দেহ বিকৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। এখন পর্যন্ত ইসরায়েল থেকে মোট ২২৫টি মরদেহ ফেরত এসেছে।
ইসরায়েলের আগ্রাসনের শিকার ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতির ফলে কিছু কিছু ব্যাংক খুলেছে। তবে নগদ অর্থের ঘাটতির কারণে বড় সমস্যায় পড়েছেন গাজাবাসী। নগদ অর্থসংকটের কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে তাঁদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। সার্বিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা সব কিছুর দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গতকাল শুক্রবার টানা চতুর্থ দিনের মতো গাজা উপত্যকায় হামলা চালিয়ে অন্তত তিন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের বরাতে জানা গেছে ওই তথ্য। এতে আবারও নড়বড়ে হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় অর্জিত যুদ্ধবিরতি চুক্তি। গত শুক্রবার উত্তর গাজার বিভিন্ন এলাকায় ইসরায়েল হামলা চালিয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। ইসরায়েল দাবি করছে, তারা এখনো ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় হওয়া যুদ্ধবিরতির প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু তাদের পদক্ষেপ বলছে ভিন্ন কথা। রয়টার্স এ বিষয়ে তাদের কাছে মন্তব্যের অনুরোধ জানিয়েছিল। কিন্তু ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী কোনো মন্তব্য করেনি।

