মাত্র দেড় দিনে ধারাবাহিক হামলা, হুমকি-বিস্ফোরণের কবলে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী তিন দেশ। নিরাপত্তা পরিস্থিতির আচমকা এমন অবনতি কী বার্তা দিচ্ছে এই অঞ্চলকে? আফগানিস্তান-নেপালসংলগ্ন ভারত সীমান্তে ক্রমশ তৎপরতা বাড়ছে সন্ত্রাসীদের। ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর অসমর্থিত সূত্রের দাবি, প্রতিবেদনটি প্রকাশের পরপরই ঘটে দিল্লিতে বিস্ফোরণ ও ইসলামাবাদে হামলার ঘটনা। চলতি বছরেই পাকিস্তানে ছয় শতাধিক হামলা চালিয়েছে টিটিপি।
নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদে বিস্ফোরণের ঘটনাস্থল ঐতিহাসিক ও প্রশাসনিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। সন্ত্রাসী হামলার শঙ্কায় উভয় দেশ অন্য রাজ্যেগুলোতেও সতর্কতা জারি করেছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বিস্ফোরণের পেছনে ভারতীয় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলেছেন। অন্যদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, এর পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র আছে। প্রশ্ন হলোÑ প্রক্সি-যুদ্ধ কী, প্রতিবেশী দুই দেশে একই ধাঁচে বিস্ফোরণের ঘটনা কি কাকতালীয়? কেন ‘গ্রেট গেম’ ফিরে আসার কথা বলা হচ্ছে? পরিস্থিতিই বা কোন দিকে যাচ্ছে? আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী পোর্টাল দ্য খোরাসান ডায়েরিÑ এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ইফতেখার ফেরদৌস। আল জাজিরাকে তিনি বলেন, দিল্লিতে ভয়াবহ গাড়ি বিস্ফোরণের ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে হওয়া ইসলামাবাদের ঘটনাটি একধরনের ‘প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ’। এগুলো কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) নামের একটি সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে আফগানিস্তানে অবস্থান করে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান এলাকায় হামলা চালাচ্ছে। গত মাসে এই সংগঠনের শীর্ষ এক নেতাকে লক্ষ্য করে কাবুলে ইসলামাবাদ বিমান হামলা চালায় বলেও অভিযোগ ওঠে। সম্প্রতি আফগান সীমান্তে সংঘাতের পর হওয়া একাধিক শান্তি আলোচনার বৈঠকেও পাকিস্তানের পক্ষ থেকে টিটিপিকে আশ্রয় না দেওয়ার দাবি জানানো হয়। কিন্তু এসব শান্তি আলোচনা কার্যকর ফল আনেনি। ইফতেখার ফেরদৌস বলছেন, টিটিপিকে আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে তালেবানের অবস্থান না বদলানো এবং ভারতের সঙ্গে তালেবান সরকারের নিরাপত্তা স্বার্থ রক্ষাসংক্রান্ত সমঝোতা হওয়ার পর থেকেই নতুন এক প্রক্সি-যুদ্ধ শুরু হয়েছে। তৃতীয় কোনো শক্তি যখন সরাসরি সংঘাতে না জড়িয়ে পরোক্ষ সমর্থন দেয়; তখন সেটিকে প্রক্সি-যুদ্ধ বলে। খোরাসান ডায়েরির সহপ্রতিষ্ঠাতা বলছেন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যকার সংঘর্ষ কেবল দুই দেশের সংঘাত মনে হলেও এটি আসলে মধ্যপ্রাচ্যের নতুন ভূরাজনৈতিক পুনর্গঠনের অংশ। বেশির ভাগ দেশ তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তকে মধ্যপ্রাচ্য-উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে। এই সংঘাতের বিভাজনরেখাগুলো চোখে দেখা বাস্তবতার চেয়েও অনেক গভীর। ন্যাটো, ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাসিস্ট্যান্ট ফোর্স (আইএসএএফ) ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন আফগান বংশোদ্ভূত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরামর্শক সামি ওমারি। অস্ট্রেলিয়ান ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ারসের এক নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, নতুন রূপ ও কৌশলে ‘দ্য গ্রেট গেম’ আবার ফিরে এসেছে। আফগানিস্তান আবারও ভারত-পাকিস্তানের ‘প্রক্সি’ বা ছায়াযুদ্ধের মঞ্চে পরিণত হয়েছে। যেখানে পুরোনো সাম্রাজ্যবাদী অস্ত্রগুলোর জায়গা নিয়েছে ড্রোন, প্রক্সি-গোষ্ঠী ও কূটনীতি। পাকিস্তান-আফগান সীমান্তে সংঘর্ষ বাড়ছে, অন্যদিকে দূতাবাসও চালু হচ্ছেÑ এসব কিছুই নতুন বাস্তবতার ইঙ্গিত।
মাত্র দেড় দিনে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী তিন দেশে নিরাপত্তা পরিস্থিতির আচমকা এমন অবনতি কী বার্তা দিচ্ছে? ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর অসমর্থিত এক সূত্রে ভারতের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত এক প্রতিবেদনে উদ্বেগ জানিয়ে বলা হয়, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপালসহ দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমশ তৎপরতা বাড়ছে সন্ত্রাসীদের।
ভারতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ধারাবাহিক হামলার পরিকল্পনা ছিল সন্ত্রাসীদের। দিল্লির লালকেল্লার কাছে বিস্ফোরণের ঘটনায় গ্রেপ্তার একজন এমনটা জানিয়েছেন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে। দিল্লির লালকেল্লার কাছে গাড়ি বিস্ফোরণের ঘটনায় সতর্ক অবস্থানে পুরো ভারত। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত তিন চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা হলেনÑ শাহিন সাঈদ, মুজাম্মিল শাকিল গানালে ও আদিল রাথের। গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। আত্মঘাতী হামলাকারী উমরের সহযোগী মুজাম্মিলকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, ধারাবাহিক হামলার অংশ হিসেবে আগামী ২৬ জানুয়ারি ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে লালকেল্লায় হামলার পরিকল্পনা ছিল তাদের। এ জন্য লালকেল্লার আশপাশের এলাকা পরিদর্শন করেছিলেন তারা। এ ছাড়া এ বছর দিওয়ালিতে দিল্লির ব্যস্ত এলাকায় হামলার পরিকল্পনা থাকলেও পরে তা বাতিল করা হয়। তদন্তে জানা গেছে, ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বরে মুম্বাই হামলার আদলে দিল্লিতেও ধারাবাহিক হামলা চালানোর পরকল্পনা ছিল সন্ত্রাসীদের। হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল লালকেল্লা, দিল্লি গেট, শপিংমলসহ বিভিন্ন স্থাপনা।
ইসলামাবাদে বোমা হামলার জেরে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান-টিটিপি জঙ্গি দমনে আফগানিস্তানে আবার সেনা অভিযানের হুমকি দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ। এদিকে, ক্যাডেট কলেজে জিম্মি পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়ে হত্যা করা হয়েছে টিটিপির পাঁচ জঙ্গিকে। পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে আদালতের বাইরে আত্মঘাতী বোমা হামলায় অন্তত ১২ জনকে হত্যার দায় মঙ্গলবারই স্বীকার করে নিষিদ্ধ জঙ্গিগোষ্ঠী টিটিপি। পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের অভিযোগ, টিটিপিকে সমর্থন দিচ্ছে আফগানিস্তানের তালেবান সরকার ও ভারত। এ ঘটনায় আফগানিস্তানের শোকবার্তা নাকচ করে স্থানীয় সম্প্রচারমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ। তিনি বলেছেন, টিটিপি জঙ্গিদের আশ্রয় না দিতে তালেবান সরকারকে বারবার অনুরোধের পরও কাজে আসছে না। পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করতে আফগানিস্তান ও ভারতের অপচেষ্টার জবাব একই কায়দায় দেয়ার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন তিনি। এমন পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানের সীমান্ত এলাকায় জঙ্গিদের সম্ভাব্য ঘাঁটিতে অভিযানের হুমকিতে ব্যাপক হতাহতের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। দুই প্রতিবেশীর মধ্যে দ্বিতীয় দফা যুদ্ধবিরতি শেষ হয়েছে গত শুক্রবার। এদিকে, পশ্চিম ওয়াজিরিস্তানের ওয়ানা জেলায় ক্যাডেট কলেজে জিম্মি পরিস্থিতির সমাধান করেছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। বোমা বহনকারী এক আত্মঘাতী আর চার জঙ্গিকে হত্যার করে সব শিক্ষার্থীকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, সোমবার থেকে ক্যাডেট কলেজটি জিম্মি করে রেখেছিল টিটিপি জঙ্গিরা। চলতি বছরেই পাকিস্তানে ছয় শতাধিক হামলা চালিয়েছে টিটিপি, যার বেশির ভাগই হয়েছে আফগান সীমান্তবর্তী খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে। সম্প্রতি টিটিপির সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের অস্থিতিশীলতা দেশটিকে নিরাপত্তার সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ইসলামাবাদের অভিযোগ, টিটিপি যোদ্ধাদের আশ্রয় ও সশস্ত্র সহায়তা দিচ্ছে আফগানিস্তান। প্রশিক্ষণ নিয়ে কাবুল থেকে পাকিস্তানে হামলার নীলনকশা তৈরি করছে তারা। যদিও অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে তালেবান সরকার।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ অভিযোগ করেছেন, ইসলামাবাদের আত্মঘাতী বোমা হামলায় দিল্লির হাত আছে। তবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে ভারত। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছেন, ‘নিশ্চিতভাবেই উন্মাদ হয়ে যাওয়া পাকিস্তানের নেতৃত্ব যে ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলেছেন, তা ভারত সর্বতোভাবে খারিজ করছে।’ তিনি বলেন, ‘দেশের অভ্যন্তরে যখন সেনাবাহিনীর মদদে সাংবিধানিক কাঠামোকে ভেঙে দেওয়ার এবং ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা চলছে, তা থেকে তাদের নিজেদের জনগণের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে ভারতের বিরুদ্ধে মিথ্যা আখ্যান তৈরি করা পাকিস্তানের পরিচিত কৌশল। আন্তর্জাতিক মহল ভালো করেই জানে বাস্তবতা কী। পাকিস্তান মরিয়া হয়ে নজর ঘোরানোর যে চেষ্টা করছে, তাতে তারা বিভ্রান্ত হবে না।’ গতকাল মঙ্গলবার পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে একটি আদালতের বাইরে শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটে। পুলিশ জানিয়েছে, বিস্ফোরণে অন্তত ১২ জন নিহত এবং ২৭ জন আহত হয়েছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ঘটনার জন্য ভারতের দিকে আঙুল তুলেছিলেন। তবে দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ ঘটনার পেছনে আফগানিস্তানের মদদ থাকতে পারে বলে ইঙ্গিত করেছিলেন। প্রাথমিক তদন্তে ওই বিস্ফোরণ আত্মঘাতী হামলা বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইসলামাবাদের জেলা আদালতের প্রবেশপথের পাশেই বিস্ফোরণটি ঘটে। আদালতে কোনো কাজের জন্য এলে সাধারণ মানুষ এই পথই ব্যবহার করেন।

