বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের ঠিক এক বছর পরেও পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া। দীর্ঘ ৫০ বছরের একনায়কতান্ত্রিক বাথ শাসন এবং ১৪ বছরের গৃহযুদ্ধ শেষে দেশটি নতুন যুগে প্রবেশ করলেও বাস্তবতা এখনো কঠিন, অনিশ্চিত এবং জটিল।
গত বছরের ৮ ডিসেম্বর দামেস্কের উপকণ্ঠে কুখ্যাত সেদনায়া কারাগার থেকে মুক্তি পান মোহাম্মদ মারওয়ান। ছয় বছর বিনাবিচারে বন্দি থাকার পর বিদ্রোহী বাহিনী রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুক্ত হন তিনি। তবে স্বাধীনতার স্বাদ পেলেও শারীরিক ও মানসিক আঘাত কাটিয়ে উঠতে হিমশিম খাচ্ছেন এ তরুণ। বুকে ব্যথা, নিশ^াসকষ্ট, উদ্বেগ ও অনিদ্রায় ভুগছেন। এখন যক্ষ্মার চিকিৎসা নিচ্ছেন। সাবেক বন্দিদের জন্য মানসিক থেরাপি চালু হলেও তা যথেষ্ট নয়।
মারওয়ানের গল্পই আজকের সিরিয়ার প্রতিচ্ছবিÑ দশকের পর দশক শোষণ, দুর্নীতি ও যুদ্ধের ক্ষত থেকে মুক্ত হলেও দেশটির পুনরুদ্ধার এখনো কঠিন।
দ্বিতীয় স্বাধীনতা কিন্তু বাস্তবতা কঠিন
বর্তমান শাসক আহমেদ আল-শারা ৮ ডিসেম্বরকে ‘স্বাধীনতা দিবস’ ঘোষণা করেছেন। দিনটি সরকারি ছুটিও পেয়েছে। অনেকেই দিনটিকে বাথ-শাসনের অবসান হিসেবে চিহ্নিত করছেন। তবে স্বাধীনতার অনুভূতি থাকা সত্ত্বেও দেশের অবস্থা এখনো দুর্বল।
যুদ্ধ ও দমন-পীড়নে গত এক দশকে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ নিহত এবং লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ২০২৪ সালের নভেম্বরে আলেপ্পোতে বিদ্রোহীদের আকস্মিক সশস্ত্র অভিযান দ্রুত সরকারের পতন ঘটালেও সরকারি বাহিনীর এমন অপ্রত্যাশিত ভেঙে পড়া বিশ্লেষকদের কাছে এখনো বিস্ময়।
দ্রুত ক্ষমতায় এলেও সমস্যায় জর্জরিত আল-শারা প্রশাসন
আহমেদ আল-শারা অল্প সময়ের মধ্যেই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেন। পশ্চিমা বিশে^র চোখে একসময় যাকে ‘জঙ্গি’ বলা হতো, সেই আল–-শারা এখন বৈদেশিক কূটনীতিতে সবচেয়ে সক্রিয় নেতা হিসেবে পরিচিত।
গত নভেম্বরে তিনি সিরিয়ার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন এবং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র তাকে সন্ত্রাসী তালিকা থেকে বাদ দেয় এবং সিরিয়ার ওপর আরোপিত বহু নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে।
এরপর সৌদি আরবের রিয়াদ সম্মেলনে সিরিয়ার আরব লিগ সদস্যপদ পুনর্বহাল হয়। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান পুনর্নির্মাণে এক বিলিয়ন ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন। কাতার ও মিশরের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনর্গঠনে উদ্যোগী হয়েছেন আল-শারা।
একই সময়ে তিনি ইরানকে ‘কৌশলগত হুমকি’ আখ্যা দিয়ে সিরিয়ার ভেতর থেকে ইরানপন্থি আধাসামরিক বাহিনী ও হিজবুল্লাহ-সংশ্লিষ্ট সদস্যদের বহিষ্কার শুরু করেছেন। তবে কূটনৈতিক সাফল্যের তুলনায় অভ্যন্তরীণ সংকট এখনো ভয়াবহ।
গোত্র সংঘাত ও বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা
দেশের দক্ষিণাঞ্চল সোওয়েইদায় দ্রুজ সম্প্রদায় নিজেদের স্বতন্ত্র প্রশাসন গড়ে তুলেছে। তারা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি অনুগত নয়। এদিকে সুন্নি সরকারপন্থিদের হাতে দ্রুজ ও আলাবি নৃগোষ্ঠীর বহু বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। এক বছরেও সীমান্ত, গোত্র এবং আদর্শগত বিভাজন কমেনি।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কুর্দি বাহিনীর সঙ্গে চুক্তি হলেও এখন পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি। দেশজুড়ে সংঘাত ও আস্থাহীনতা বাড়ছে।
ইসরায়েলের হামলা নতুন নিরাপত্তা হুমকি
আসাদের পতনের পর ইসরায়েল আরও বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা কাউকে ‘ইসলামপন্থি’ আখ্যা দিয়ে নতুন সিরিয়া সরকারের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। যদিও আল-শারা সংঘর্ষ চান না, তবুও ইসরায়েল দক্ষিণ সিরিয়ার জাতিসংঘ নিয়ন্ত্রিত একটি এলাকা দখল করেছে এবং নিয়মিত বিমান হামলা চালাচ্ছে। ফলে সম্ভাব্য নতুন যুদ্ধে জড়ানোর ভয় এখনো কাটেনি।
ধ্বংসস্তূপে অর্থনীতি
ট্রাম্প প্রশাসন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করলেও সিরিয়ার অর্থনীতি এখনো স্থবির। উপসাগরীয় দেশগুলোর বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়নি। বিশ^ব্যাংকের হিসাবে, পুনর্গঠনে দরকার কমপক্ষে ২১৬ বিলিয়ন ডলার। বাস্তবে এখন পর্যন্ত বাড়িঘর মেরামতের মতো ছোট পরিসরের প্রকল্প ছাড়া বড় কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
দামেস্কের দন্ত চিকিৎসক বাসাম দিমাশকি বলেন, ‘দেশ এখন আগের চেয়ে ভালো, কিন্তু নিরাপত্তাহীনতা ও অর্থনৈতিক সংকট ভয়াবহ।’
মারওয়ানও বলেন, ‘আসাদের আমলের সঙ্গে এখনকার সিরিয়ার আকাশ-পাতাল পার্থক্য। কিন্তু জীবনযাত্রা এখনো কঠিন।’ স্থায়ী কাজ পাচ্ছেন না তিনি। কোনোদিন ৫০ থেকে ৬০ হাজার সিরিয়ান পাউন্ড আয় হয়, আবার কোনোদিন কিছুই নয়। চিকিৎসা শেষ করেই লেবাননে কাজের খোঁজে যাওয়ার পরিকল্পনা তার।
এক বছর পর মূল্যায়ন
আসাদের পতন নিঃসন্দেহে সিরিয়ার জন্য নতুন সূচনা। কিন্তু ভঙ্গুর প্রশাসন, গোত্র সংঘাত, অর্থনৈতিক দুরবস্থা এবং ইসরায়েলের আগ্রাসন মিলে দেশটিকে এখনো অস্থির করে রেখেছে। জনগণ স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু স্থায়ী শান্তি, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতি এখনো অধরা।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন