ঢাকা রবিবার, ০২ নভেম্বর, ২০২৫

সাফল্যের মাপকাঠি কাজের ঘণ্টা নয়

জয়া মাহবুব
প্রকাশিত: নভেম্বর ২, ২০২৫, ০২:৩৭ এএম

ব্যবসার জগতে এমন একটি সম্পদ আছে যা সবার জন্য সমান; হোক সেটা ছোট একটি উদ্যোগ বা বহুজাতিক কোম্পানি। সেই সম্পদ হলো সময়। অর্থ জোগাড় করা যায়, টিম গঠন করা যায়, আইডিয়া বদলানো যায়। কিন্তু একবার যে সময় চলে যায়, তা আর ফেরানো যায় না। আজকের প্রতিযোগিতামূলক ও অনিশ্চিত বাজারে উদ্যোক্তাদের সাফল্য কিংবা ব্যর্থতার অন্যতম কারণ হলো- সময়কে কীভাবে তারা বোঝে, মূল্যায়ন করে এবং ব্যবহার করে। পুরোনো একটি প্রবাদ আছে, ‘সময় নিন, কিন্তু সময় নষ্ট করবেন না।’ প্রথমে শুনতে এটি পরস্পরবিরোধী মনে হতে পারে। কিন্তু উদ্যোক্তাদের জন্য এ ভারসাম্যই কার্যকর নেতৃত্বের মূল শিক্ষা।

উদ্দেশ্যপূর্ণ অপেক্ষা
সময় নেওয়া মানে অলস থাকা নয়। বরং ধৈর্যের সঙ্গে সঠিক উদ্দেশ্যে এগোনো। সফল উদ্যোগ রাতারাতি তৈরি হয় না। বাজার বোঝা, গবেষণা করা, পরিকল্পনা করা-এসবই সময়ের বিনিয়োগ। উদ্যোক্তারা যখন সময় নেন, তখন তারা মূলত নিচের এ কাজগুলো করেন-
গ্রাহকের চাহিদা ও আচরণ বোঝা, ছোট আকারে পণ্য বা সেবা পরীক্ষা করা, ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন কৌশল সাজানো। এভাবে নেওয়া সময় আসলে ঝুঁকি কমায়। তাড়াহুড়ো করে পণ্য বাজারে ছাড়লে সুনামের ক্ষতি হতে পারে। যাচাই ছাড়া বিনিয়োগ নিলে মূলধন নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই উদ্যোক্তাদের জন্য সময় নেওয়া মানে দেরি নয়-বরং ভবিষ্যতের জন্য শক্ত ভিত্তি তৈরি।

সময় নষ্ট করা: অদৃশ্য হুমকি
সময় নষ্ট করা এক ধরনের নীরব ক্ষতি। অনেক সময়ই তা বোঝা যায় না, যতক্ষণ না এর ফল ভোগ করতে হয়। পরিকল্পনা করতে করতে কোনো সিদ্ধান্তে না আসা, অপ্রয়োজনীয় মিটিং, বা মনোযোগহীনভাবে অন্য কাজে ডুবে থাকা-এসবই সময় নষ্টের উদাহরণ। অনেক উদ্যোক্তা এত বেশি বিশ্লেষণ করেন, কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয় না। কিন্তু বাজার কারো জন্য অপেক্ষা করে না। গ্রাহকের চাহিদা দ্রুত বদলায়, প্রতিযোগীরাও তৎপর থাকে। ফলে দেরিতে নেওয়া সিদ্ধান্ত প্রায়ই ব্যবসার জন্য মারাত্মক হয়ে দাঁড়ায়। ধৈর্য যদি উদ্দেশ্যহীন হয়, তবে তা হয়ে যায় কালক্ষেপণ। আর কালক্ষেপণ উদ্যোক্তার সবচেয়ে বড় ক্ষতি।

কখন থামবেন, কখন এগোবেন
মূল চ্যালেঞ্জ হলো কখন সময় নেবেন আর কখন দ্রুত কাজ করবেন তা বোঝা। বেশি তাড়াহুড়ো করলে ভুল বাড়ে, আর বেশি দেরি করলে সুযোগ হাতছাড়া হয়। সফল উদ্যোক্তারা সাধারণত কিছু নীতি মেনে চলেন:
ড় শুরুর দিকে সময় নিন, পরে দ্রুত কাজ করুন। গবেষণা, গ্রাহক বোঝা, বাজার যাচাই-এসব প্রথমে সময় নিয়ে করতে হয়। কিন্তু একবার স্পষ্টতা পেলে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হয়।
ড় সিদ্ধান্তকে সুযোগ-খরচ দিয়ে মাপুন। প্রতিটি দেরি মানে কিছু হারানো। উদ্যোক্তারা ভাবেন-এখন পদক্ষেপ না নিলে আমি কী হারাচ্ছি? যদি দেরির ক্ষতি ঝুঁকির চেয়ে বেশি হয়, তবে সময় নষ্ট করা যাবে না।
ড় সময়কে শৃঙ্খলায় আনুন। অপ্রয়োজনীয় মিটিং কমানো, প্রতিদিনের কাজের অগ্রাধিকার ঠিক করা-এসবের মাধ্যমে সময়কে প্রকৃত অর্থে কার্যকর করে তোলা সম্ভব। লক্ষ্য হলো বেশি কাজ করা নয়, বরং গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা।

সময় ব্যয় নয়, বিনিয়োগ
সময়কে ব্যয়ের পরিবর্তে বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে পারলে উদ্যোক্তাদের মানসিকতায় বড় পরিবর্তন আনা সম্ভব। যেমন, উচ্চ রিটার্ন সময় হলো-পণ্য উন্নয়ন, গ্রাহক প্রতিক্রিয়া গ্রহণ করা, নতুন দক্ষতা শেখা, গুরুত্বপূর্ণ নেটওয়ার্ক তৈরি। নি¤œ রিটার্ন সময় হলো-অতিরিক্ত মিটিং, কাগজপত্রের জট, অথবা যে কাজগুলো সহজেই ডেলিগেট করা যেত। সময়কে যদি বিনিয়োগ করা যায়, তবে প্রতিটি ঘণ্টাই উদ্যোক্তার ভবিষ্যৎ তৈরি করে।

গ্লোবাল ও দেশীয় অভিজ্ঞতা, উদ্যোক্তাদের অনুপ্রেরণা
বিশ্বব্যাপী স্টার্টআপগুলোর অভিজ্ঞতা দেখায় যে সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, এয়ারবিএনবি বা ড্রপবক্স দীর্ঘ সময় ধরে তাদের ব্যাবসায়িক মডেল পরীক্ষা ও পরিমার্জন করেছে। তারা বাজারে তাড়াহুড়ো করে না ঢুকলেও, যখন সঠিক মুহূর্ত এলো, তারা দ্রুত সম্প্রসারণ করেছে। ফলাফল হিসেবে তারা টেকসই সাফল্য অর্জন করেছে। অন্যদিকে, অনেক স্টার্টআপ পরিকল্পনা না করে দ্রুত বাজারে প্রবেশ করেছে, ফলে প্রতিযোগীর কাছে সুযোগ হারিয়েছে। বাংলাদেশের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমেও একই শিক্ষা পাওয়া যায়। যেমন, পাঠাও বা বিকাশ তাদের প্রযুক্তিনির্ভর সেবা শুরু করার আগে যথেষ্ট সময় নেওয়া পরিকল্পনা করেছে। তারা বাজারের চাহিদা ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা যাচাই করেছে এবং পরে দ্রুত সম্প্রসারণ করেছে। ফলে তারা টেকসই সাফল্য অর্জন করেছে। অন্যদিকে, যারা তাড়াহুড়ো করে বাজারে প্রবেশ করেছে, তারা প্রায়ই প্রতিযোগীদের পেছনে পড়ে গেছে। পরিকল্পনার জন্য সময় নেওয়া জরুরি, কিন্তু সুযোগের সঠিক মুহূর্তে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া তার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অনেক দেরি বা অতিরিক্ত তাড়াহুড়ো, উভয়ই ব্যর্থতার কারণ হতে পারে।

সময়ই কৌশল
‘সময় নিন, কিন্তু সময় নষ্ট করবেন না’ শুধু প্রেরণাদায়ক উক্তি নয়। এটি উদ্যোক্তাদের জন্য এক কৌশলগত নীতি। উদ্যোক্তাদের জন্য সময় হলো একই সঙ্গে ক্যানভাস ও তুলি। সঠিকভাবে ব্যবহার করলে এটি টেকসই সাফল্য আঁকে। অপচয় করলে সুযোগগুলো মুছে যায়। সাফল্যের মাপকাঠি কাজের ঘণ্টা নয়, বরং কত ঘণ্টা সঠিকভাবে ব্যবহার করা হলো। তাই উদ্যোক্তাদের ধৈর্য থাকতে হবে উদ্দেশ্যপূর্ণ, আর পদক্ষেপ নিতে হবে যথাসময়ে।