যথাযথ বাজার তদারকি ব্যবস্থার অনুপস্থিতি, কৃত্রিম সংকট, নি¤œমানের পণ্য, পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি ও নিরাপত্তাহীনতা রয়েছে। শুধু তাই নয়, পণ্য আমদানি প্রক্রিয়ার জটিলতা, স্টোরেজ সুবিধার অপ্রতুলতা এবং পণ্য ব্যবস্থাপনায় প্রতিযোগিতার স্বল্পতার কারণে স্থানীয় বাজারে বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভোক্তার পাশাপাশি ব্যবসায়ী সমাজ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বলে মত প্রকাশ করেছেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) নেতারা। গতকাল শনিবার ডিসিসিআই আয়োজিত এক অংশীজন সংলাপে অংশগ্রহণকারী আলোচকেরা এসব কথা বলেন।
‘কার্যকর বাজার তদারকির মাধ্যমে ভোক্তা ও ব্যবসায়ের স্বার্থ সুরক্ষা’বিষয়ক অংশীজন শীর্ষক সংলাপটি অনুষ্ঠিত হয় ডিসিসিআই মিলনায়তনে। সভায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য (খাদ্য শিল্প ও উৎপাদন) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শোয়েব, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের সদস্য ড. মো. আখতারুজ্জামান তালুকদার এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাজিব এইচ চৌধুরী বলেন, দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা- ক্রমাগত সম্প্রসারিত হলেও বাজারে পণ্যের মূল্য কারসাজি, কৃত্রিম সংকট, নি¤œমানের পণ্য, জটিল নিয়মনীতি এবং নানাবিধ হয়রানির কারণে ভোক্তাসহ বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা প্রতিনিয়িত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন, ফলে ভোক্তাদের আস্থা কমে যাচ্ছে এবং সৎ ব্যবসায়ীরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছেন। বিদ্যমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় তিনি বাজার তদারকির সমন্বিত কাঠামোর রূপরেখা প্রণয়ন ও কার্যকর বাস্তবায়ন এবং জবাবদিহিতাপূর্ণ ও প্রতিযোগিতামূলক বাজারব্যবস্থা গঠনের ওপর জোরারোপ করেন।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান বলেন, মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে অনেক ক্ষেত্রে বাজারে পণ্যের দাম বাড়ে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারী সংস্থাসমূহের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। তিনি বলেন, বাজার তদারকির বিষয়টি অতীব জরুরি হলেও জনবলের অভাবের কারণে দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ১৯টিতেই ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের কোনো কার্যালয় নেই, ফলে কার্যকর বাজার তদারকি সম্ভব হচ্ছে না। ভোক্তা অধিকারবিষয়ক বিভিন্ন আইন ও অধ্যাদেশের মধ্যকার সমন্বয় বৃদ্ধি ও বৈসাদৃশ্য পরিহার একান্ত অপরিহার্য বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পণ্যের দাম সরকার কর্তৃক নির্ধারণের পরিবর্তে তা চাহিদ ও জোগানের ভিত্তিতে নির্ধারিত হওয়া সমীচীন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া বলেন, পণ্য পরিবহন ও বাজার ব্যবস্থাপনায় মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে বাজারে বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উচ্চ মূল্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। তিনি বলেন, স্বল্পসংখ্যক অসাধু ব্যবসায়ীর জন্য বৃহৎ বেসরকারি খাতের সুনাম নষ্ট হচ্ছে, তাই এই অসাধু ব্যবসায়ীদের রোধে সর্বস্তরের সৎ ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসতে হবে। তিনি আরও বলেন, সমন্বিতভাবে কাজ করার মাধ্যমে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন করা সম্ভব।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শোয়েব বলেন, ভোক্তাদের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে তার প্রতিষ্ঠান নিয়মিতভাবেই অভিযান পরিচালনা করে আসছে, তবে সমন্বিতভাবে বাজার মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করা প্রয়োজন বলে অভিমত জ্ঞাপন করেন। এ ক্ষেত্রে ডিজিটাল পদ্ধতি কাজে লাগানো সম্ভব হলে ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের সদস্য ড. মো. আখতারুজ্জামান তালুকদার বলেন, বাজারে একটি সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা থাকা কেবল ভোক্তাই নয়, ব্যবসায়ীদের জন্যও সুফল বয়ে আনবে। পণ্য সরবরাহসংশ্লিষ্ট পর্যাপ্ত তথ্যপ্রাপ্তি ও গবেষণা বাজারে অসম প্রতিযোগিতা রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
মতবিনিময় সভায় মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজি মোহাম্মদ গোলাম মওলা, বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের ঊর্ধ্বতন সহসভাপতি খন্দকার মনির আহমেদ, চিনি ও তেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজী আবুল হাসেম, বাংলাদেশ সুপার মার্কেট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেন এবং ডিপার্টমেন্ট অব পেটেন্টস, ডিজাইন অ্যান্ড ট্রেডমার্কসের উপপরিচালক মির্জা গোলাম সারওয়ার প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন।
হাজি মোহাম্মদ গোলাম মওলা বলেন, দেশে সরকারি চিনিকল ১৮টি থাকলেও এগুলোর বেশির ভাগই এখন কার্যকর নয়। এ ছাড়া ভোজ্যতেল রিফাইনারির সংখ্যা ক্রামন্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। ফলে কিছুসংখ্যক আমদানিকারকরের ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানিনির্ভর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে অসম প্রতিযোগিতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায়ে পণ্য বিক্রিতে অতিমুনাফা রোধকল্পে খুচরা পর্যায়ে পণ্য বিক্রির মুনাফার হার নির্ধারণ করা যেতে পারে বলে তিনি প্রস্তাব করেন।
এ সময় খন্দকার মনির আহমেদ বলেন, ডিমের চাহিদা বছরের সব সময় একই রকম থাকে না, তাই ডিম সংরক্ষণে কেন্দ্রীয়ভাবে সংরক্ষণাগার স্থাপন করা গেলে এই খাতের উদ্যোক্তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হ্রাস পাবে। তিনি জানান, দেশের পোলট্রি খাতে বর্তমানে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে, যেখানে প্রায় ৬০ লাখ লোক কর্মরত রয়েছেন। এমতাবস্থায় বৃহৎ এই শিল্প খাতকে সরকারের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন।
হাজি আবুল হাসেম সরকারি বন্ধ চিনিকলসমূহে সরকারি উদ্যোগে অথবা বেসরকারি খাতের সহযোগিতায় চালু করার আহ্বান জানান, ফলে আমাদের আমদানিনির্ভরশীলতা কমবে, বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। খুচরা পর্যায়ে চিনির মূল্যহ্রাসে তিনি চিনির ওপর আরোপিত ট্যাক্স কমানোর প্রস্তাব করেন। পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি ও ট্রাক ছিনতাইয়ের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয় এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কার্যকর মনিটরিং সেল স্থাপন করা প্রয়োজন উল্লেখ করে মো. জাকির হোসেন বলেন, পণ্য আমদানি কার্যক্রমে নজরদারি বাড়ানো গেলে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
এ সময় মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি কাজী মোহাম্মদ বশির উদ্দিন বলেন, বাজার তদারকির কার্যক্রম চলছে, তবে তা গোছানো নয়। তিনি বলেন, ডলারের সংকটের কারণে ব্যবসায়ীদের ঋণপত্র খোলার জটিলতার কারণে আমদানিনির্ভর নিত্যপণ্যের সংকটে বাজার পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এ বছর আলুর দাম তুলনামূলকভাবে কম থাকায় কৃষক ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দাবি করে এ সময় বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক গোলাম সারওয়ার বলেন, কৃষক যদি আলু চাষে নিরুৎসাহিত হয়, তাহলে আগামী বছর ফলন হ্রাস পেলে ভোক্তাদের উচ্চমূল্যে আলু কিনতে হবে, তাই তিনি আলুর সঠিক মূল্য নির্ধারণে সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
ডিসিসিআইয়ের সাবেক সহসভাপতি এম আবু হোরায়রাহ্ বলেন, সিটি করপোরেশনের আওতাধীন বিভিন্ন বাজার বা মার্কেটের ইজারা ব্যবস্থাকে কঠোর নজরদারির আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। কেননা, বর্ধিত ইজারামূল্যের প্রভাব পরিশেষে ভোক্তাকেই বহন করতে হয়।
এ ছাড়া মুক্ত আলোচনায় ডিসিসিআইয়ের পরিচালক মোহাম্মদ জমশের আলী, এনামুল হক পাটোয়ারী এবং প্রাক্তন ঊর্ধ্বতন সহসভাপতি আলহাজ আব্দুস সালাম প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন।
ডিসিসিআইয়ের সহসভাপতি মো. সালিম সোলায়মান, পরিচালনা পর্ষদের সদস্যবৃন্দসহ সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডাররা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।