বাজার থেকে অতিরিক্ত ডলার কেনা অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই ডলার দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভে যোগ হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে এই পদক্ষেপ নেওয়া হলেও এর পেছনে রয়েছে গভীর অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট। বিশেষত, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি এবং আমদানি কমে যাওয়া পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে নিলামের মাধ্যমে মোট ২ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার কিনেছে। এই ডলার কেনা হয়েছে মূলত শক্তিশালী রেমিট্যান্সপ্রবাহ ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধির কারণে, যা টাকার বিপরীতে ডলারের দর স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি উদ্বৃত্ত ডলার কিনে নিয়েছে, যা রিজার্ভে যোগ হয়েছে। এর আগের তিন বছরে রিজার্ভ থেকে বাজারে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছিল। তবে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের কারণে দেশের বাজারে ডলারের তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়েছিল। এর পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধও বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করে। ফলে দেশের মুদ্রার মান ব্যাপকভাবে কমতে শুরু করে। শুরুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দাম কৃত্রিমভাবে ধরে রাখলেও তা দীর্ঘ সময় সম্ভব হয়নি। ৮৫ টাকা থেকে ডলারের দাম দ্রুত ১২০ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়, যা দেশের ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা।
এরপর বাজারে ডলারের সংকট কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্রুত ডলার বিক্রি শুরু করলে রিজার্ভের পরিমাণ দ্রুত কমতে থাকে। আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে নানান পদক্ষেপ নেওয়া হয়, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে আমদানি বিল পরিশোধে বিলম্বও করা হয়। রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত থাকায় তা ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে চলে যায় এবং ডলারের দাম আরও বেড়ে ১২৮ টাকা পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। এই সরকারের অধীনে হুন্ডি কার্যক্রম এবং টাকা পাচারের পরিমাণ কমে যায়। ফলে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়তে থাকে। পাশাপাশি রপ্তানি আয়ও বাড়ে। সরকারের এসব আয়ের মাধ্যমে ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগ সরকারের রেখে যাওয়া আমদানির বকেয়া পরিশোধ করা শুরু হয়। একপর্যায়ে দেশের রিজার্ভও বাড়তে থাকে। তবে, বিনিয়োগ পরিস্থিতি এখনো অনুকূলে না থাকায় মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি কমে গেছে। ফলে ডলারের চাহিদাও হ্রাস পেয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে অতিরিক্ত ডলার কিনে নেয়, যাতে বাজারে ডলারের সরবরাহ না বাড়ে এবং দাম কমে না যায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন বুঝতে পারে যে বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়ছে এবং অতিরিক্ত চাহিদা কমে যাচ্ছে, তখন তারা রিজার্ভ শক্তিশালী করার জন্য অতিরিক্ত ডলার কিনে নেয়। বিশেষত, একদিকে যখন রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বেড়েছে, অন্যদিকে তখন আমদানির পরিমাণ কমেছে। ফলে বাজারে ডলার তুলনামূলকভাবে সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে ব্যাংকগুলোর কাছে থাকা উদ্বৃত্ত ডলার কিনে রিজার্ভে যোগ করছে, যাতে ডলারের দাম আরও কমে না যায় এবং ভবিষ্যতে বাজারে কোনো অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি না হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক যখন অতিরিক্ত ডলার কিনে বাজার থেকে তুলে নিচ্ছে, তখন এটি বাজারে ডলারের সরবরাহ কমিয়ে দেয়, ফলে ডলারের দাম স্থিতিশীল থাকে। এভাবে রপ্তানিমুখী শিল্প এবং প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি হয়। কারণ, যদি ডলারের দাম কমে যায়, তাহলে রেমিট্যান্স প্রাপ্তি এবং রপ্তানি আয়ও কমে যেতে পারে, যা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তা ছাড়া, যদি একসময় বাজারে ডলারের চাহিদা বাড়ে, তখন বাংলাদেশ ব্যাংক দ্রুত এর সরবরাহ বাড়িয়ে বাজার স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করবে। গত বছর ৮৫ টাকার ডলার ১২০ টাকায় উঠে যাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক দ্রুত ডলার বিক্রি শুরু করে।
চলতি বছরের ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ বিলিয়ন ডলারের ওপর। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী, এই সময়ের রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। ২০২৪ সালের ৩০ অক্টোবর দেশের গ্রস রিজার্ভ ছিল ২৫ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার এবং বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, এক বছরে গ্রস রিজার্ভ বেড়েছে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার এবং বিপিএম-৬ অনুযায়ী বেড়েছে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার।
বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং ভবিষ্যতে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত। ব্যাংকগুলোর মধ্যে ডলারের জোগান-প্রচারণা সঠিকভাবে পরিচালনা করার মাধ্যমে তারা বাজারে ভারসাম্য বজায় রাখছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র, আরিফ হোসেন খান বলেন, দেশ থেকে অর্থ পাচার কমে যাওয়ায় বাজারে ডলারের জোগান বেড়েছে। কমেছে হুন্ডির দৌরাত্ম্য। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশ বেড়েছে এবং রপ্তানিও ইতিবাচক ফলাফল দিচ্ছে। ফলে বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বেড়েছে এবং ডলারের দাম স্থিতিশীল রয়েছে।
তিনি বলেন, যদি ডলারের দাম কমে যায়, তাহলে রপ্তানিমুখী শিল্প এবং প্রবাসী যারা রেমিট্যান্স পাঠান, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। কারণ, তারা ডলারের বিপরীতে কম পরিমাণ টাকা পাবেন। এ বাজার এখন স্থিতিশীল। যদি ভবিষ্যতে ডলারের চাহিদা বাড়ে এবং দাম আবার বাড়তে শুরু করে, সেদিকে লক্ষ্য রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক সহায়তা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বাজার থেকে ডলার কেনার ফলে দেশের রিজার্ভও বাড়ছে।

