বৃহস্পতিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৫, ০২:৩৭ এএম

ডেঙ্গুতে দিশাহারা নগরবাসী, বেড়েই চলছে মৃত্যু

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৫, ০২:৩৭ এএম

ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

‘মশা মারতে কামান দাগাও’ কথাটাকে বাস্তবে রূপ দিতে বছর দুয়েক আগে একজন নারী নেত্রী ফগার মেশিনকে কামানের মতো ব্যবহার করে আলোচনায় এসেছিলেন। মূলত দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে তার এই কর্মকাণ্ড হলেও এডিস মশা নিধনে একটা বার্তা পেয়েছিল জনগণ। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময় স্থানীয় সরকারে কোনো জনপ্রতিনিধি না থাকায় প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। শুধু চলতি সেপ্টেম্বরের ১৭ দিনেই আক্রান্ত ছাড়িয়েছে ১০ হাজারের বেশি। মোট আক্রান্তের ঘর পেরিয়েছে ৩৬ হাজার। ১৭ দিনে মৃত্যু হয়েছে ৪৩ জনের। এমন আশঙ্কাজনক বা জ্যামিতিক হারে ডেঙ্গুর ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা অক্টোবরেও অব্যাহত থাকবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। যদি না মশা মারতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এমনকি গতকাল বুধবার এক দিনেই মারা যায় পাঁচজন। আক্রান্ত হয় ৬২২ জন। 

সাধারণত জুন-জুলাই মাসকে বলা হয় ডেঙ্গুর প্রজনন মৌসুম। তবে বর্ষাকাল আরেকটু বিস্তৃত হলে আগস্ট-সেপ্টেম্বরেও থাকতে পারে এর প্রভাব। কিন্তু চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে আক্রান্তের হিসাব পাল্টে দিয়েছে যেন সব চিত্র। এ মাসে এক দিনে সর্বোচ্চ ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে। প্রতিদিনই আক্রান্ত হচ্ছে নতুন নতুন রোগী। হাসপাতালে ভর্তিদের মধ্যে কেউ কেউ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও বেশির ভাগই কাতরাচ্ছে জ্বরে। সিটি করপোরেশন লোক দেখানো পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করলেও কার্যত মশা নিয়ন্ত্রণ কিছুই হচ্ছে না বলে অভিযোগ নগরবাসীর।

সিটি করপোরেশন বলছে, নগরবাসীর অসচেতনতার কারণেই অনেক চেষ্টায়ও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টা থেকে বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টা পর্যন্ত (একদিনে) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও ৬২২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। একই সঙ্গে এই সময়ে ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে নতুন করে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালে নতুন ভর্তিদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ১৩১ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৯৮ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১০৪ জন, ঢাকা উত্তর সিটিতে ১০০ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ৯৯ জন, খুলনা বিভাগে ১৪ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ১৯ জন, রাজশাহী বিভাগে ৫১ জন এবং রংপুর বিভাগে ৬ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে। এদিকে গত এক দিনে সারা দেশে ৫০৮ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ছাড়পত্র পেয়েছে ৩৭ হাজার ৬৮৮ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৩৯ হাজার ৮১৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তবে বছরের এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ১৬১ জনের। 

চলতি বছর সেপ্টেম্বর শেষ হতে চললেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে না আসায় আশঙ্কা প্রকাশ করছেন খোদ চিকিৎসকেরা।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এখন যে পরিস্থিতি আমরা দেখছি, তাতে এটাকে সারা বছরের স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করাই সমীচীন। এই রোগ সংক্রমণ ও বিস্তারের প্রকৃতি লক্ষ করলে এটা এড়ানোর কিছু উপায় আমরা সহজেই অবলম্বন করতে পারি। সেটা হলো বাসাবাড়ির ভেতরে ও আশপাশে পানি জমতে না দেওয়া, যাতে এডিস মশার বংশবিস্তার ঠেকানো যায়। দ্বিতীয়ত, মশার কামড় এড়ানোর জন্য সতর্ক থাকা, বাসা মশামুক্ত রাখার চেষ্টা করা, ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করা। বিশেষভাবে সতর্ক থাকা প্রয়োজন শিশুদের ব্যাপারে। তাদের খালি গায়ে না রাখা। কেননা, এডিস মশা সাধারণত শরীরের উন্মুক্ত অংশে বসে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সতর্কতার পাশাপাশি সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগও বিশেষভাবে প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের ভূমিকাও কম নয় বলে উল্লেখ করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী। 

তিনি বলেন, ‘আমরা বরাবরই বলে আসছি, ডেঙ্গু প্রতিরোধে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা জরুরি, যা বছর শুরুর আগেই করতে হয়। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে আমরা তা দেখছি না। ২০১৯-এর ডেঙ্গু মহামারির পরে এটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এটি এখন শুধু নগরের রোগ নয়। এটি সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ায় এখন সারা বছরই থাকছে। এ কারণেই কিন্তু কিউলেক্স মশার প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের একটি জায়গায় ৯ শতাধিক কিউলেক্স মশার প্রজননস্থল পাওয়া গেছে। প্রতি বছরই আমরা দেখছি নগরপিতারা মশা প্রতিরোধে নানা ধরনের লম্ফঝম্ফ করছেন। কিন্তু এ বছর তো নগরপিতাদেরও কেউ আর দায়িত্বে নেই। তাই মশা মারার ক্ষেত্রে একটা উদাসীনতা আমরা সবার ক্ষেত্রে লক্ষ করছি। এ সময়টায় সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় নিয়মিত মশা নিধন অভিযান পরিচালনা করা। আমি সিটি করপোরেশনের প্রশাসকদের কাছে বিনীত অনুরোধ জানাব, যেন তারা এ ব্যাপারে একটু সিরিয়াস হন।

৯ বছরে ৭০৭ কোটি টাকা ব্যয়, তবু ঢাকায় ডেঙ্গুর ভয়াবহতা অব্যাহত পুরাতন কৌশল, দুর্বল পরিকল্পনা ও সমন্বয়হীনতা

গত ৯ বছরে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মশক নিয়ন্ত্রণে প্রায় ৭০৭ কোটি টাকা ব্যয় করলেও রাজধানীবাসী ডেঙ্গু ও অন্যান্য মশাবাহিত রোগ থেকে মুক্তি পায়নি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) মশা মারতে ব্যয় করেছে প্রায় ৪৬৪ কোটি টাকা (কীটনাশক, জলাশয় পরিষ্কার, যন্ত্রপাতি ইত্যাদিতে)। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ব্যয় করেছে প্রায় ২৪৩ কোটি টাকা। যেখানে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব ছিল দুই সিটির জন্য ডিএনসিসি ১৩৫ কোটি টাকা এবং ডিএসসিসির ৪৬ দশমিক ৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেশির ভাগই খরচ হয় মশা নিধনের কাজে। তবু প্রতি বছর বৃষ্টি নামলেই রাজধানীতে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহ রূপে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ব্যর্থতার মূল কারণ পুরোনো ও অকার্যকর পদ্ধতি, সমন্বয়হীন ও অপর্যাপ্ত পরিকল্পনা, আধুনিক বৈজ্ঞানিক কৌশল না নেওয়া, বছরব্যাপী পর্যবেক্ষণের অভাব।

দেশের প্রায় ১৬ হাজার হাসপাতাল-ডায়াগনস্টিক সেন্টার ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা করলেও রিপোর্টিং হয় মাত্র ১৩৯টি হাসপাতাল থেকে। ফলে প্রকৃত চিত্র অজানা। ফলে প্রতি বছরই পুরোনো পথেই হাঁটেন মশা নিধনকারীরা উল্লেখ করে কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ধোঁয়া দেওয়া, পানি জমে থাকা স্থানে কীটনাশক ছিটানো, সচেতনতামূলক প্রচারাভিযান চালানোই যেন মূল কাজ। কিন্তু আমরা দেখছি, বাজেটের বড় অংশই চলে যায় কীটনাশক কেনায়। ডিএনসিসি ১৩৫ দশমিক ৫ কোটি টাকার মধ্যে ৮০ কোটি এবং ডিএসসিসি ৪৬ দশমিক ৫০ কোটির মধ্যে ৪৫ কোটি টাকা ব্যয় করছে কীটনাশকে, যার বাস্তবতা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তিনি বলেন, মাঠ পর্যায়ে কাজের নিয়মিত মূল্যায়ন দরকার। এলাকাভিত্তিক ডেটা অনুযায়ী কৌশল নিতে হবে।

সিটি করপোরেশনের বক্তব্য

ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নিশাত পারভিন সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আমরা কীটনাশক প্রয়োগের আগে আইইডিসিআর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও নিজেদের পরীক্ষায় ৯৫ শতাংশ কার্যকারিতা নিশ্চিত হই। রোগীর তালিকা অনুযায়ী ফগিং করা হয়।’ 

তবে মাঠকর্মীদের দুষলেন ডিএনসিসি প্রশাসক মো. আজাজ।

 তিনি বলেন, ‘আমাদের আমদানি করা কীটনাশক কার্যকর। তবে সমস্যা হচ্ছে, মাঠকর্মীরা সঠিকভাবে প্রয়োগ করে না। বাড়ির ভেতরে ঢুকে অভিযান চালানো সম্ভব হয় না, যেখানে বেশি প্রজনন ঘটে।’ তিনি জানান, ‘এখন মোবাইল কোর্ট চালাচ্ছি, বাড়ির ভেতরের প্রজননস্থল ধ্বংসে অভিযান জোরদার করেছি।

এদিকে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়েও নানা জটিলতায় ভুগছেন অনেকেই। রাজধানীর মহাখালীর বাসিন্দা রিতা দেবনাথ তাদেরই একজন। গর্ভের ছয় মাসের মাথায় অক্টোবরের মাঝামাঝিতে আক্রান্ত হন ডেঙ্গুতে। রাজধানীর হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে প্রায় দুই সপ্তাহ চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হলেও এখনো শারীরিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। 

তিনি বলেন, একে তো গর্ভাবস্থা, তার ওপর ডেঙ্গু। এর প্রভাবে তখনই শরীরে খুব চুলকানি হয়েছিল। কিন্তু গর্ভের সন্তানের নিরাপত্তার জন্য ডাক্তার কোনো ওষুধ ব্যবহার করতে মানা করেন। এই অবস্থা এখনো আছে। শুধু তাই নয়, খাবারে অনীহা, শারীরিক দুর্বলতা তো রয়েছেই। এমন রোগ যেন কারোই না হয়। 

একই কথা জানান ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়া করা ৩ মাস বয়সী শিশুসন্তান আফাদের বাবা আহমেদুল হক।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!