গণভোট জাতীয় নির্বাচনের আগে নাকি একই দিনেÑ এমন প্রশ্ন যখন রাজনীতির মাঠে তখন বিষয়টি পরিষ্কার করেন খোদ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচনের দিনই হবে গণভোট। তার মতে, এতে নির্বাচন আরও উৎসবমুখর ও সাশ্রয়ী হবে। তিনি বলেছেন, এতে সংস্কারের লক্ষ্য কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত হবে না। গত বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার সেই ভাষণের পর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিএনপি-জামায়াত-এনসিপি। তবে দিনশেষে রাতেই সুর নরম হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর।
বিএনপির চাওয়া ছিল ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং একই দিনে গণভোট হোক। তবে জামায়াত চেয়েছিল নভেম্বরের মধ্যে গণভোট। কোনো রাজনৈতিক দলের পুরো আবদার না রাখলেও অন্তর্বর্তী সরকার হেঁটেছে মধ্যপথে। জাতীয় নির্বাচনের দিনেই গণভোটের ঘোষণা দেওয়ায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে ধন্যবাদ জানিয়েছে বিএনপি। গত বৃহস্পতিবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক শেষে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ সম্মেলনে ধন্যবাদ জানান।
ফ্যাসিবাদবিরোধী চেতনায় জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথে থাকলেও, সংবিধানে বহাল থাকছে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে সরকারি নথিপত্র এবং সংবিধানে যুক্ত করে গেছে তার নাম। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলছেন, বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে তার দল।
যদিও এর আগে বৃহস্পতিবার বিকেলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ প্রধান উপদেষ্টার কঠোর সমালোচনা করেছেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘ভাষণের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা নিজের সই করা জুলাই জাতীয় সনদ লঙ্ঘন করেছেন।’ রাষ্ট্রের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টির পরিবর্তে অনৈক্য সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে কি নাÑএ প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘বিভাজনের দায়দায়িত্ব কি প্রধান উপদেষ্টা নেবেন? জাতীয়ভাবে কি আমরা কোনো বিভাজন সৃষ্টি করতে যাচ্ছি?’ জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেলও আট দলের নেতাদের নিয়ে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণে জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণ হয়নি। মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, ‘একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট আয়োজনের ঘোষণায় সংকটমুক্ত স্বচ্ছ নির্বাচনের আশা করেছিলাম, কিন্তু সেখানে সেই সংকটটা রয়েই গেল।’
যদিও বৃহস্পতিবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির জরুরি বৈঠক শেষে মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘১৭ অক্টোবর ঐকমত্যের ভিত্তিতে স্বাক্ষরিত জুলাই জাতীয় সনদের ওপর জনগণের সম্মতি গ্রহণের জন্য গণভোট অনুষ্ঠান এবং যথাশিগগির জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করার জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।’ তিনি জানান, ‘জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা পুনর্ব্যক্ত করায় এবং সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়ায় স্থায়ী কমিটির সভায় তাকে ধন্যবাদ জানানো হয়েছে।’ বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
জুলাই সনদ ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই স্বাক্ষরিত হয়েছে। সনদের কপিগুলোতে প্রস্তাব এবং এর বিপরীতে দলগুলোর সম্মতি এবং নোট অব ডিসেন্ট, নোট অব ডিসেন্টের ভাষাÑসব কিছু সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ আছে। এটি কোনো প্রথাগত নোট অব ডিসেন্ট নয়, ভিন্নমত নয়। সুনির্দিষ্টভাবে এই ভিন্নমত যদি দলগুলো তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে উল্লেখ করে এবং জনগণের ম্যান্ডেট-প্রাপ্ত হয়, তাহলে তারা সেভাবে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নিতে পারবে। এখন সেই জায়গা থেকে কি সরে আসা হলো না? এ জন্যই বলছি যে, প্রধান উপদেষ্টা নিজের স্বাক্ষরিত দলিলের বাইরে গেলেন, সেটি লঙ্ঘনের শামিল বলে মনে করছেন বিএনপির নেতারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘নতুন ধারণাগুলো কেন তিনি আদেশের মধ্যে এবং এই প্রস্তাবের মধ্যে নিয়ে এলেন, সেটি আমাদের জানা নেই। কারণ, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্যই নির্বাচন কমিশন দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংবিধানিকভাবে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনও সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। এখানে (আদেশে) প্রস্তাব করা হচ্ছে, সংসদ সদস্যরা একইভাবে সংবিধান সংস্কার পরিষদের সদস্য হিসেবে শপথ নেবেন। তারা কি সংবিধান সংস্কার পরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন যে শপথ নেবেন? এই ধারণাগুলো নতুন এবং এভাবে একটা সময় নির্ধারণ করে দেওয়া এবং একটা পরিষদ নির্ধারণ করে দেওয়া তাদের মধ্য দিয়ে সংবিধান সংস্কারের জন্য প্রস্তাব করা এবং সেটি ১৮০ দিনের ভেতরে হতে হবে, সে সমস্ত প্রস্তাব করা, এগুলোর এখতিয়ার কি আসলে কারো আছে? এখন কি আমরা স্বাধীনতার পূর্ব অবস্থায় আছি যে একটা গণপরিষদ করতে হবে? আমাদের একটা সংবিধান আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সুতরাং যে ধারণাগুলো এখানে আরোপ করা হচ্ছে, সেগুলো সাংঘর্ষিক। তার পরও আমরা যদি জাতীয় ভিত্তিতে একমত হতে পারতাম কোনো বিষয়ে, তাহলে এই প্রশ্নগুলো উত্থাপিত হতো না।’ সালাহউদ্দিন আরও বলেন, ‘সংকট তো সৃষ্টি করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এবং সরকার নিজেই। ঐকমত্য কমিশনে ৯ মাস আলোচনা হয়ে সনদ স্বাক্ষরিত হলো। তার বাইরে কেন যাবে?’ তিনি বলেন, ‘তারা (জামায়াত) কি নির্বাচন চায়? নির্বাচন বিলম্বিত করতে চায় কি না, সেগুলো বুঝতে হবে তাদের কার্যক্রম দিয়ে।’
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির পরপর রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়ায় বিভেদের সুর দেখা গেলেও, ক্রমান্বয়ে সেটি আংশিক সন্তুষ্টিতে রূপ নিচ্ছে। এতে গণভোটের পক্ষে জনরায়ের প্রত্যাশা হচ্ছে ইতিবাচক। গণভোটের নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়ে পতিত স্বৈরাচার জুলাই সনদ ব্যর্থ করতে অপচেষ্টা চালাবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তবে রাজনৈতিক দলগুলো বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া পুরোপুরি মেনে নিলে, সেই অপচেষ্টা নস্যাৎ হয়ে যাবে বলে মত তাদের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এখনো যে সংকট দেখা যাচ্ছে, জাতীয় নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পর সেটি কেটে যাবে। রাজনৈতিক দলগুলো সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া পুরোপুরি মেনে নিলে, পতিত স্বৈরাচার জুলাই সনদকে ব্যর্থ করতে পারবে না। জন রায় পেলে নির্বাচিত সংস্কার পরিষদ সনদ বাস্তবায়নে নৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বাধ্য থাকবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, অনেক কিছু ছাড় দিয়ে হলেও মানুষের প্রয়োজনে দেশটা বাঁচাতে নির্বাচন চায় বিএনপি। রাজনৈতিক দলগুলোর সকল প্রত্যাশা সরকার বাস্তবায়ন করতে পারবে না এটা সত্যি, তবে আরও অনেক কিছু করা সম্ভব ছিল। সরকার আসলে কী করতে চায় আমরা ঠিক জানি না। আমরা চাই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন। যাতে মানুষ ভোট দিতে পারে। কিছু রাজনৈতিক দল দাবির পর দাবি তুলে যাচ্ছে, যাতে নির্বাচনটা বিলম্বিত হয়। কিন্তু বিএনপি চায় মানুষ ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করুক।

