ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার অপেক্ষা ছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। বলা হচ্ছিল, সম্ভাব্য সুদিন দেখতে পাচ্ছিল দলটি। তবে দিন যত যাচ্ছে, ভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় দলটি। রাজনীতিতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ এখন কঠিন সংকটে। তবে সেই স্থান দখল করেছে তাদের দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াত। রাজনীতিতে একসময়ের জোটসঙ্গী বিএনপি-জামায়াত এখন মুখোমুখি। সাপে নেউলে সম্পর্ক এখন তাদের মধ্যে। এ ছাড়া মনোনয়ন নিয়ে স্থানে স্থানে দল ঘোষিত প্রার্থী ও প্রত্যাশীদের মধ্যে বিরোধ এবং যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গীদের সঙ্গে আসন বণ্টন নিয়েও দেখা দিয়েছে সংকট। সব কিছু মিলিয়ে বর্তমান সময়ে চ্যালেঞ্জের মুখেই পড়েছে বিএনপি।
বিএনপি ও জামায়াতÑ দেশের রাজনীতির দুই মিত্র। কিন্তু দল দুটির মধ্যে নেই আগের সেই মিত্রতার বিন্দুমাত্র আভাস। দেড় যুগ আগে ৫ বছর একসঙ্গে সরকারে থাকা দল দুটির নেতাদের মধ্যে প্রায়শই দেখা যাচ্ছে বাকযুদ্ধ। শক্তিশালী ‘শব্দের তীর’ ছুড়ছেন পরস্পরের প্রতি। গত সোমবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ জামায়াতকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘ধর্মের নামে ট্যাবলেট বিক্রি করে প্রতারণা করছে একটি দল।’ জবাবে জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘আমরা ধর্ম নিয়ে কাজ করি, ব্যবসা করি না।’ তাদের এই প্রতিযোগিতার নেপথ্য নিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, এর মূলে অবশ্যই ‘ক্ষমতা’। এদিকে গণভোট, জুলাই সনদ বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধের মধ্যেই দেশজুড়ে নির্বাচনি প্রস্তুতি শুরু করেছে বিএনপি।
যতটা স্বস্তি নিয়ে রাজনীতির দৌড়ে এগিয়ে যেতে চেয়েছিল বিএনপি, সেই পথে বারবার কাঁটা বিছিয়েছে সাম্প্রতিক সময়ের প্রতিপক্ষ জামায়াত। সঙ্গে লাগাম টেনে ধরেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এদিকে জামায়াতের সঙ্গে যোগ দিয়েছে ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন নিয়ে বিএনপিকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে জামায়াত ও দলটির সঙ্গে যোগ দিয়ে বেশ কিছু রাজনৈতিক দল। কিন্তু হালে পানি না পেয়ে পরে পিআর থেকে সরে এসে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবি তোলেন তারা। তবে তাদের কোনো আন্দোলনকেই পাত্তা দেয়নি বিএনপি। এ ছাড়া একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটের সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। যদিও সম্প্রতি আটটি ইসলামিক দলের সঙ্গে বৈঠক করে সে পথ থেকেও সরে আসে জামায়াতসহ ইসলামিক দলগুলো।
আপাতদৃষ্টিতে বিএনপি স্বস্তিতে থাকলেও আসলেই কি আগামীর পথ পরিষ্কার? বিশ্লেষক ও নেতাকর্মীদের মধ্যে নানা মত বিরাজ করলেও বিষয়টি এত সহজভাবে দেখতে চায় না বিএনপি। দুই দফায় ২৭২ আসনে প্রার্থী দেওয়ায় বিএনপির পুরোনো মিত্র বাংলাদেশ লেবার পার্টি অনেকটা অভিমান থেকেই ছেড়েছে বিএনপির সঙ্গ। ১২ দলীয় জোটও প্রকাশ করেছে ক্ষোভ। এনসিপির সঙ্গে জোট করার গুঞ্জন থাকলেও ভোটের হিসাব না মেলায় সেটিও গেছে ভেস্তে। তবে ধীরে ধীরে বিএনপি জোট থেকে অন্য দলগুলোকে সরিয়ে নিতে জামায়াত কাজ করছে বলেই বিশ্বাস বিএনপির। এ ছাড়া তপশিল ঘোষণার পর অন্য রাজনৈতিক জোটগুলোকে ভুল বুঝিয়ে নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলেও শঙ্কা করছে বিএনপি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরামের এক নেতা রূপালী বাংলাদেশকে জানিয়েছেনÑ পরিস্থিতি এমনটা হলে সামনে কঠিন বিপদ অপেক্ষা করছে। তবে তিনি মনে করেন, পরিস্থিতি তৈরি করে নির্বাচন পেছানোর দাবি উঠলে সেটি মেনে নেবে না দেশের মানুষ। মানবে না বিএনপিও। তিনি মনে করেন, বিরোধী শিবিরে বিরোধিতাই শুধু নয়; মনোনয়নবঞ্চিতদের চাপা ক্ষোভ নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে দুইশর বেশি আসনে জয় পাওয়া মুশকিল হবে। কোন্দল থামাতে না পারলে সেই সুবিধা নেবে জামায়াত। তখন বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে বিএনপি। এ ছাড়া দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থাও গুরুতর।
এত কিছুর মধ্যে আজ বুধবার নির্বাচনি তপশিল ঘোষণার জন্য সিইসির ভাষণ রেকর্ড করতে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারকে ঢাকা হয়েছে নির্বাচন কমিশনে। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার জন্য নির্বাচন কমিশন (ইসি) এরই মধ্যে ভাষণের সব কিছু চূড়ান্ত করেছে। গতকাল মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাসউদ জানিয়েছেন, আজ বুধবার সন্ধ্যায় অথবা আগামী ১১ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার এই নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করা হতে পারে। এ ছাড়া আজ বুধবার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে কমিশন তপশিল ঘোষণা করতে পারে। এ ঘোষণায় রাজনৈতিক দলসহ সবার সহযোগিতার বিষয়ে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেবেন সিইসি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এত প্রতিকূলতার মধ্যে এবারের নির্বাচনে সুস্থ গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতায় নামতে হবে বিএনপিকে। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দল নিয়ে ইসলামী ফ্রন্ট এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্র-তরুণদের নতুন দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হবে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দলটিকে। যদিও পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে ভোটের মাঠে নামছে বিএনপি। সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে নির্বাচনি ইশতেহারও চূড়ান্ত করছে দলটি। ঘোষিত রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা এবং জুলাই জাতীয় সনদের সমন্বয়ে এবারের ইশতেহার তৈরি হবে। এ ছাড়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাম্প্রতিক নানা বক্তব্যের মূল দিকনির্দেশনাও এতে প্রতিফলিত হবে। বিশেষ করে ৮টি খাতে সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে দলটি। সেগুলো হলোÑ ফ্যামিলি কার্ড, কৃষক কার্ড, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ক্রীড়া, পরিবেশ, কর্মসংস্থান ও ধর্মীয় নেতাদের উন্নয়ন সেবা।
রাজনীতির বাইরেও বিএনপির জন্য নির্বাচনি আইন নিয়েও চ্যালেঞ্জ। আরপিও সংশোধনের কারণে জোটবদ্ধ দলগুলো নিজেদের প্রতীকে নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে। বিএনপির দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করার সুযোগ হারানোয় এরই মধ্যে বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (বিএলডিপি) চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বিএনপিতে যোগ দিয়ে মনোনয়ন বাগিয়ে নিয়েছেন। গত সোমবার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর হাতে ফুল দিয়ে বিএনপিতে যোগ দেন তিনি। এ সময় লক্ষ্মীপুর-১ আসনে শাহাদাত হোসেন সেলিমকে ধানের শীষের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে বলে জানান আমীর খসরু।
সার্বিক বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আগামী নির্বাচন বানচাল করতে দেশি বিদেশি শক্তি কাজ করছে। যাদের জনপ্রিয়তা নেই, ভোট করে জয় লাভ করতে পারবে না, তারাই নির্বাচন বানচাল করতে চায়। আগে সেটি চাইত আওয়ামী লীগ, এখন চায় আরেকটি দল। তারা চায় ছলেবলে কৌশলে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে। অন্তর্বর্তী সরকারকে তারা কবজা করেছে। ছোট রাজনৈতিক দলগুলোকে তারা ভুল বুঝিয়ে নির্বাচন পেছানোর পাঁয়তারা করছে। তবে নির্বাচন পেছালে দেশের যে ক্ষতি হবে, সেটা ভাবছে না কেউ। এমনকি তার দায় নেবে কে, সে বিষয়েও তাদের বোধোদয় নেই।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন