ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২৫

পুরান ঢাকায় মামুন হত্যা

অন্তর্কোন্দলে ২ লাখ টাকায় খুন করে ভাড়াটে খুনিরা

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৩, ২০২৫, ১২:৫৮ এএম

অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্বে পুলিশের তালিকায় থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে পুরান ঢাকায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। সন্ত্রাসী রনির নির্দেশে ২ লাখ টাকার বিনিময়ে মামুনকে গুলি করে হত্যা করেন ফারুক ও রবিন। জামিনে মুক্ত হয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন ফের অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এমন পরিপ্রেক্ষিতেই অন্তর্কোন্দলে মামুনকে হত্যা করা হয়।

গতকাল বুধবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার শফিকুল ইসলাম এসব কথা বলেন। রাজধানীর মিন্টো রোডের ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

মামুন হত্যার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৫ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে দুজন শুটারÑ ফারুক ও রবিন। অন্য তিনজন হলেনÑ শামীম, রুবেল ও ইউসুফ। হত্যাকা-ে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল, অস্ত্র, অব্যবহৃত গুলি ও নগদ ১ লাখ ৫৩ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। এই টাকা রবিন ও ফারুককে হত্যার পারিশ্রমিক হিসেবে দিয়েছিলেন রনি।

ডিএমপির ডিবিপ্রধান বলেন, গতকাল (মঙ্গলবার) রাতে ফারুক, রবিন, শামীম ও রুবেলকে নরসিংদী থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। হত্যার পর তারা ঢাকা থেকে সিলেট হয়ে ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সিলেট থেকে ভারত প্রবেশ করতে না পেরে সাতক্ষীরা হয়ে সীমান্ত পার হওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন তারা। সিলেট থেকে আসার পথে নরসিংদীতে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

শফিকুল ইসলাম বলেন, হত্যার পর ফারুক ও রবিন তাদের ব্যবহৃত অস্ত্রসহ অব্যবহৃত গুলি রনির নির্দেশে রুবেলের হেফাজতে রাখেন। রুবেল ভাড়ায় গাড়ির ব্যবসা করেন। পরে রুবেল অস্ত্র ও গুলি ইউসুফের হেফাজতে দেন।

রুবেলকে ধরার পর তাকে সঙ্গে নিয়ে রাজধানীর রায়েরবাজারে গত মঙ্গলবার রাতে অভিযান চালায় পুলিশ। অভিযানে ইউসুফ গ্রেপ্তার হন। ইউসুফ পেশায় একজন দরজি। পরে তার ঘরের মেঝে থেকে দুটি বিদেশি পিস্তল, ৬টি গুলি ও দুটি ম্যাগাজিন উদ্ধার করা হয়।

হত্যার পরিকল্পনা সম্পর্কে ডিএমপির ডিবিপ্রধান বলেন, একসময়ের আন্ডারওয়ার্ল্ডের আলোচিত জুটি ইমন-মামুনের মধ্যে সম্প্রতি দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে। কিছুদিন ধরে রনি একাধিকবার মামুনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। ফারুকের সহযোগিতায় করা এসব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। রনি শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনের ঘনিষ্ঠ। সবশেষ গত সোমবার হিমেল হত্যা মামলায় হাজিরা দিতে আদালতে আসেন মামুন। মামুনকে হত্যার জন্য এই দিনটিকেই বেছে নেওয়া হয়।

হত্যার বর্ণনা দিয়ে শফিকুল ইসলাম বলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী, ৯ নভেম্বর সন্ধ্যার দিকে রনি তার বাসায় রবিনকে ডেকে নেন। রনি তাকে জানান, তার সঙ্গে ফারুক, সুমন, কামালসহ আরও কয়েকজন থাকবেন। তারা মামুনকে মেরে ফেলবেন। তিনি রবিনকে সঙ্গে থাকতে বলেন। তাকে টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দেন। এতে রবিন রাজি হন। ঘটনার দিন সকালে রনি ফোন দিয়ে সবাইকে আদালত এলাকায় যেতে বলেন। রবিন তার বন্ধু শামীমের সঙ্গে মোটরসাইকেলে করে আদালত এলাকায় গিয়ে হত্যায় অংশ নেন। অন্যরাও সে সময় আদালত এলাকায় অবস্থান করছিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমে সুমন ও ফারুকের গুলি করার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ফারুক ও রবিন গুলি করেন।

সংবাদ সম্মেলনে শফিকুল ইসলাম বলেন, মামুনের গতিবিধি অনুসরণ করে ফারুক ও রবিনকে খবর দেন কামাল। সংকেত পেয়ে তারা গুলি ছুড়ে মামুনের মৃত্যু নিশ্চিত করেন। হত্যার পর তারা বেড়িবাঁধ হয়ে রায়েরবাজার যান। সেখানে রনির নির্দেশে অস্ত্র ও গুলি ইউসুফের কাছে রাখা হয়। পরে রনির নির্দেশে ফারুক ও সুমনকে দুই লাখ টাকা দেন রুবেল। ফারুক ও সুমন এক লাখ টাকা করে ভাগ করে নেন।

পাঁচ আসামি ৪ দিনের রিমান্ডে :

এদিকে মামুন হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার পাঁচজনকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি পেয়েছে পুলিশ। তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের শুনানি নিয়ে গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় ঢাকার মহানগর হাকিম পার্থ ভদ্র তাদের চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন বলে প্রসিকিউশন বিভাগের এসআই মিজানুর রহমান জানান।  আসামিরা হলেনÑ মো. ফারুক হোসেন ফয়সাল ওরফে কুত্তা ফারুক (৩৮), রবিন আহম্মেদ ওরফে পিয়াস (২৫), মো. রুবেল (৩৪), শামীম আহম্মেদ (২২) ও মো. ইউসুফ ওরফে জীবন (৪২)। পুলিশ বলছে, এদের মধ্যে ফারুক ও রবিন সরাসরি হত্যায় অংশ নেন; তারাই গুলি করেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালি জোনাল টিমের ইন্সপেক্টর মো. সাজ্জাদ হোসেন আসামিদের ১০ দিনের রিমান্ড আবেদনে বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। আসামিরা সংঘবদ্ধ সশস্ত্র অপরাধী চক্রের সক্রিয় সদস্য। পরস্পর সহযোগিতায় দীর্ঘদিন ধরে ‘টাকার বিনিময়ে’ ঢাকা মহানগরীসহ আশপাশের এলাকায় ‘হত্যা, ডাকাতি আর ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধ করে আসছিলেন’।  আবেদনে আরও বলা হয়, আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে আরও তথ্য, অস্ত্রের সন্ধান ও সহযোগীদের ব্যাপারে তথ্য জানা ও তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে। মামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায় বিচারের স্বার্থে তাদের ১০ দিনের রিমান্ডের প্রয়োজন।

রাষ্ট্রপক্ষে আইনজীবী জামাল উদ্দিন রিমান্ডের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘ফারুক ও রবিন কোর্টের পাশে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের সামনে দিনেদুপুরে মামুনকে গুলি করে পালিয়ে যায়। তারা তাকে প্রকাশ্যে হত্যা করে। সন্ত্রাসীদের কোনো ছাড় নেই।’

এ আইনজীবী আরও বলেন, ‘যেহেতু তারা চিহ্নিত সন্ত্রাসী, তাদের বিষয়ে রাষ্ট্র কঠোর অবস্থানে। দেশে ‘হযবরল’ অবস্থা। তারা আরও কী করে, না করে। তাদের সর্বোচ্চ রিমান্ড মঞ্জুরের প্রার্থনা করছি।’

আসামিদের পক্ষে অ্যাডভোকেট নিয়াজ মোর্শেদ রোমান রিমান্ড আবেদন বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন।  তিনি বলেন, ‘খুনের বিষয়ে থানায় অভিযোগ বা পদক্ষেপ নেয়নি পরিবার। গত ১০ নভেম্বরের ঘটনা। আজ (গতকাল) ১২ নভেম্বর। তারা গ্রেপ্তার গতকাল (মঙ্গলবার)। এর মধ্যে তারা আবার ঢাকা থেকে ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় গেল আবার এলো। এতেও দুই দিন সময় লাগে। আর অস্ত্র উদ্ধার হয়ে গেছে। এ ঘটনায় অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে এমন প্রমাণও হয়নি। অস্ত্র উদ্ধার হয়ে গেছে। রিমান্ডের প্রয়োজন নেই। রিমান্ড বাতিল করে জামিনের প্রার্থনা করছি।’

এরপর রাষ্ট্রপক্ষের আরেক আইনজীবী কাইয়ুম হোসেন নয়ন বলেন, ‘ভিকটিম বা পরিবারের কেউ মামলা না করলে রাষ্ট্র বাদী হয়ে মামলা করতে পারে। কোর্ট অঙ্গনে এমন দুঃসাহস। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের ইন্ধন আছে কি না জানা দরকার।’ শুনানি নিয়ে আদালত প্রত্যেকের চার দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন।

প্রসঙ্গত, পুরান ঢাকার আদালতপাড়ার কাছে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের ফটকে গত সোমবার বেলা ১১টার দিকে গুলি করে হত্যা করা হয় শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুনকে।