ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২৫

আজও দ্যুতিময় হুমায়ূন

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৩, ২০২৫, ০১:০৪ এএম

বাংলা সাহিত্য অঙ্গনের কালজয়ী নক্ষত্র হুমায়ূন আহমেদ। সন্দেহাতীতভাবে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের জনপ্রিয়তম লেখক। শুধু সুবিশাল পাঠকগোষ্ঠীই নয়; নাটক ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমেও তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন এ দেশের ঘরে ঘরে। তিনি যেখানেই নিজের সোনালি হাতের স্পর্শ করেছেন, সেটাই বাংলার মানুষ গ্রহণ করেছে পরম মমতা ও ভালোবাসায়। নন্দিত এই লেখকের আজ ৭৭তম জন্মবার্ষিকী। বেঁচে থাকলে তিনি আজ ৭৮ বছরে পা রাখতেন। ১৯৪৮ সালের আজকের দিনে হুমায়ূন আহমেদ নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পারিবারিক ডাক নাম ছিল কাজল। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ও মা আয়েশা ফয়েজ। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। তার এক ভাই কথাসাহিত্যিক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। অন্য ভাই আহসান হাবীব কার্টুনিস্ট ও রম্যলেখক।

ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন এবং নর্থ ডাকোটা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পলিমার রসায়ন শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। বিদেশে পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে এসে হুমায়ূন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে দীর্ঘকাল কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীকালে লেখালেখি এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বার্থে অধ্যাপনা ছেড়ে দেন।

১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয় হুমায়ূন আহমেদের প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’। ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় উপন্যাস ‘শঙ্খনীল কারাগার’। এই উপন্যাস দুটির কারণে তখনকার সাহিত্যবোদ্ধা মহলে বেশ প্রশংসিত হন তিনি। এরপর দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছরের লেখক জীবনে নিজেকে বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তায় শীর্ষে নিয়ে যান। গল্প বলার অসামান্য ভঙ্গির কারণে ‘গল্পের জাদুকর’ হিসেবে তাকে গণ্য করা হয়। তার লেখা গল্প-উপন্যাসে মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনধারার নিঃসংকোচ বর্ণনা পাওয়া যায়। ৬৩ বছরের জীবন কাটিয়ে ২০১২ সালে তিনি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান হুমায়ূন আহমেদ। কিন্তু চলে যাবার আগে যে সমৃদ্ধ, বর্ণিল জগত সৃষ্টি করে গেছেন, তা ধ্রুবতারার মতো দ্যুতি ছড়ায় আজও।

বাংলাদেশের একটি প্রজন্মকে বইয়ের প্রতি আগ্রহী করে তোলার দায়ভার হুমায়ূন আহমেদ তুলে নিয়েছিলেন নিজের কাঁধে এবং মৃত্যুর আগে রেখে গেছেন নিজের লেখার এক বিশাল পাঠকগোষ্ঠী। এ দেশের আনাচে-কানাচে খুঁজলে এমন অনেক মানুষেরই সন্ধান পাওয়া যাবে, যারা জীবনে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে শুধু একজনের বই-ই পড়েছেন; সেই একজনটিই হলেন হুমায়ূন আহমেদ।

হুমায়ূন আহমেদ নিজের পরিচয়কে কেবল ঔপন্যাসিকের গ-িতেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। উপন্যাসের পাশাপাশি ছোট গল্প তো লিখেছেনই, সেইসঙ্গে আত্মপ্রকাশ করেছেন নাট্যকার, গীতিকার, চিত্রনাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবেও। শিল্প-সংস্কৃতির যে অঙ্গনেই তিনি হাত দিয়েছেন, সেখানেই অনুমিতভাবে সোনা ফলিয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। কিন্তু তুমুল জনপ্রিয় এই লেখকের সাহিত্যকর্মের প্রাতিষ্ঠানিক পর্যালোচনা প্রায় শূন্যের কোঠায়।

বহুমাত্রিক হুমায়ূন আহমেদ গল্পের প্রাণ ছিল পাত্র-পাত্রীদের মিথস্ক্রিয়া। ছোট ছোট সংলাপকে প্রাধান্য দিয়ে গল্প লিখতেন তিনি। অতি সাধারণ কথাকে অসাধারণভাবে প্রকাশের এক অন্যরকম ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিলেন এই বাংলা সাহিত্যের বরপুত্র, শব্দের জাদুকর।

১৯৯০ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতি বছরের একুশে বইমেলায় সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের লেখক ছিলেন তিনি। শুধু এ ঘটনাটিই তার তুমুল পাঠকপ্রিয়তার এক উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। তার বেশকিছু বই বিভিন্ন বিদেশি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। তার বেশকিছু গল্প স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচিরও অন্তর্ভুক্ত।

বাংলার তরুণদের ওপর হুমায়ূন আহমেদের ছিল জাদুকরি প্রভাব। তার সৃষ্ট চরিত্র হিমুকে অনেক সময় লেখক হুমায়ূন আহমেদের চেয়েও বেশি জনপ্রিয় মনে করা হয়ে থাকে। অনেক তরুণই তাদের কৈশোরের কোনো না কোনো সময়ে নিজেকে হিমু হিসেবে কল্পনা করে থাকেন। হিমুর হলুদ পাঞ্জাবি, খালি পা; ভবঘুরে জীবন যুবকদের দারুণভাবে উদ্বেলিত করেছিল। এ ছাড়াও মিসির আলীর মতো রহস্যময় চরিত্র, শুভ্রর মতো অতি পবিত্র চরিত্র এবং রুপার মতো মায়াবতী প্রেমিকা হুমায়ূন আহমেদের শ্রেষ্ঠ চরিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। আধুনিক বাংলা কল্পবিজ্ঞানের অন্যতম পথিকৃতও তিনি।

হুমায়ূন আহমেদের প্রথম টিভি নাটক ‘প্রথম প্রহর’। নাটকটি তাকে দেশব্যাপী রাতারাতি জনপ্রিয় করে তোলে। এ ছাড়াও ‘এসব দিন রাত্রি’, ‘বহুব্রীহি’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘আজ রবিবার’, ‘তারা তিনজন’, ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’Ñ এমন বেশকিছু জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটকের রচয়িতা তিনি। তার পরিচালিত ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের প্রধান চরিত্র বাকের ভাইয়ের ফাঁসির আদেশ হলে সেই রায়ের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ মিছিল নিয়ে নেমে পড়েছিল। ঢাকার গলিতে গলিতে পোস্টার লাগানো হয়েছিল। একজন মানুষের সৃষ্টি কতটা প্রভাব বিস্তার করলে এমন ঘটনা ঘটা সম্ভব তা সহজেই অনুমেয়।

তার প্রথম চলচ্চিত্র ছিল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক। চলচ্চিত্রের নাম ছিল ‘আগুনের পরশমনি’। তার নির্মিত ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রটি বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রগুলোর মাঝে একটি। হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্যামল ছায়া’ চলচ্চিত্রটি ২০০৬ সালে সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে অস্কার পুরস্কারের জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। তার পরিচালনায় সর্বশেষ সিনেমা ‘ঘেটুপুত্র কমলা’। তার সিনেমাগুলো বেশ কয়েকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে বেশকিছু বিভাগে পুরস্কার জিতেছিল। তিনি সেভাবে গান রচনা করতেন না। শুধু নিজের সিনেমা এবং নাটকের জন্যই গান লিখতেন। গানগুলো সে সময় বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

৯০ বিঘা জমির ওপর স্থাপিত নুহাশপল্লী নামের একটি বাগান বাড়ি তৈরি করেছিলেন জীবদ্দশায়। এই নুহাশপল্লীর লিচুতলায় তাকে সমাহিত করা হয়। হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে নেই কিন্তু আজও তার সৃষ্টি অমর। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক মুকুটহীন সম্রাট।

হুমায়ূন আহমেদ তার দীর্ঘ চার দশকের সাহিত্য জীবনে উপহার দিয়েছেন সাড়া জাগানো সব উপন্যাস। বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। তার মধ্যে একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, হুমায়ূন কাদির স্মৃতি পুরস্কার, লেখক শিবির পুরস্কার, মাইকেল মধুসূদন দত্ত পুরস্কার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও বাচসাস পুরস্কার উল্লেখযোগ্য।