বাংলাদেশ, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা এখন বিশ্বের সবচেয়ে বায়ুদূষিত শহরগুলোর একটি। এই অবস্থা শুধু আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিংয়ের জন্য উদ্বেগজনক নয়, এটি দেশের জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ হুমকি।
বায়ুদূষণের প্রধান উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া, নির্মাণকাজের ধুলাবালি এবং শিল্প-কারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য। ইটভাটা, সার কারখানা, চিনিকল, কাগজকল, পাটকল, বস্ত্র কারখানা, স্পিনিং মিল, ট্যানারি শিল্প, গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি, রাসায়নিক এবং ওষুধ শিল্প, সিমেন্ট কারখানা, মেটাল ওয়ার্কশপ, করাতকল প্রভৃতি শিল্প-কারখানা প্রধানত বায়ুদূষণ ঘটাচ্ছে। বায়ুদূষণের এসব উৎস থেকে প্রচুর পরিমাণে ধোঁয়া, বাষ্প, গ্যাস ও ধূলিকণা উৎপন্ন হয়, যা কুয়াশা ও ধোঁয়াচ্ছন্ন পরিবেশ সৃষ্টি করে।
এসব শিল্প-কারখানা থেকে প্রতিনিয়ত হাইড্রোজেন সালফাইড, অ্যামোনিয়া, ক্লোরিনসহ আরও কয়েক প্রকার গন্ধহীন রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করছে যেগুলো একদিকে যেমন বিষাক্ত তেমনি অন্যদিকে স্থানীয় জনগণের বিরক্তি ও পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এসব দূষণ নানাবিধ স্বাস্থ্যগত সমস্যা সৃষ্টি করছে। অধিক হারে নগরায়ণের কারণে নগরে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে অত্যাধিক বায়ুদূষণ ঘটছে। বায়ুদূষণের কারণে সর্বাধিক ক্ষতির শিকার হয় শিশুরা। বায়ুতে অতিরিক্ত সিসার উপস্থিতি শিশুদের মানসিক বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে। প্রতিবছর ঢাকা মহানগরীর বায়ুতে প্রায় ৫০ টন সিসা নির্গত হচ্ছে।
এ দূষণের ফলে শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, ফুসফুসের ক্যানসার, হৃদরোগ, স্ট্রোকসহ নানা জটিল রোগ বাড়ছে। সেই সঙ্গে রয়েছে অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি। বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ এবং অসুস্থ ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। শুধু স্বাস্থ্যের ক্ষতি নয়, এর কারণে শিক্ষার্থী ও শ্রমজীবী মানুষের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যসেবার ওপর বাড়তি চাপ ও চিকিৎসা খরচ অর্থনীতির জন্য বোঝা হয়ে উঠছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিবছর বিশ্বে বায়ুদূষণের কারণে মৃত্যু হয় প্রায় ৭০ লাখ মানুষের। এসব মৃত্যুর প্রধান কারণ হলোÑ স্ট্রোক, হৃদরোগ, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসকষ্ট (সিওপিডি), ফুসফুসের ক্যানসার এবং শ্বাসযন্ত্রের তীব্র সংক্রমণ। এর মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বায়ুদূষণ প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ৫২ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ বলে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে (বিএমজে) প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় তুলে ধরা হয়। এনভায়রনমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় জানা যায়, প্রতিবছর প্রায় ৩২ লাখ মানুষ রান্নাবান্না ও গৃহস্থালিজনিত বায়ুদূষণের শিকার হয়ে মারা যায়।
বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন বয়স্ক, শিশু ও জটিল রোগে আক্রান্ত মানুষ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিশেষ যতœবান হতে হবে।
সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের মধ্যে বায়ু অন্যতম। আমাদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন দূষণমুক্ত পরিবেশ ও নির্মল বাতাস। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, আমাদের দেশে দিন দিন নির্মল বায়ু কমছে।
শিল্প-কারখানা দেশের সম্পদ, জনগণের সম্পদ। এটি ধারাবাহিক কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস। শিল্প-কারখানা কাঁচামালকে পণ্যে রূপান্তর করে, মানুষের অভাব পূরণ করে, দেশের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করে। অগ্রণী ভূমিকা রাখে দেশের অর্থনীতিতে। তাই এর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু আমাদের নজর রাখতে হবে, কতটা কম দূষণ করে এ শিল্প-কারখানা পরিচালনা করা যায়।
আমরা আশা করব, বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তর তাদের তদারক কার্যক্রম আরও কঠোর করবে। অনুমোদনহীন ইটভাটা বন্ধ, পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে ভুমিকা রাখবে। সেই সঙ্গে নির্মাণস্থলে ধুলা নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। যানবাহনে আধুনিক নির্গমন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু ও গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই।
এ ছাড়া সামাজিক সচেতনতা বায়ুদূষণ রোধে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। গাছ লাগানো, ছাদবাগান সম্প্রসারণ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সরকারে সংশ্লিষ্ট মহল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
পরিবেশ হচ্ছে আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তি। একে অবহেলা করার অর্থ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক মৃত্যুপরিবেশ তৈরি করা। তাই এখনই সময় নীতিনির্ধারক, নাগরিক এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্মিলিতভাবে বায়ুদূষণ প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের। বিলম্ব মানেই ক্ষতির মাত্রা আরও বাড়ানো।
আপনার মতামত লিখুন :