বিশ্বের আবহাওয়া ব্যবস্থায় এক মহাবিপর্যয়ের সংকেত বহু বছর ধরেই বিজ্ঞানীরা দিয়ে আসছেন। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এই সংকেত বাস্তবে রূপ নিচ্ছে আগুন, পানি, ঝড় ও মৃত্যু হয়ে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর ভবিষ্যতের শঙ্কা নয়, এটি এখনকার বাস্তবতা। ২০২৩-২৪ সালজুড়ে ইউরোপ ও আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা, দাবানল ও অস্বাভাবিক ঝড়-বৃষ্টি প্রমাণ করে দিয়েছে আমরা একটি বিপজ্জনক জলবায়ু সংকটের মধ্যে প্রবেশ করে ফেলেছি।
বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু বিপর্যয়ের চিত্র
জলবায়ু পরিবর্তনের মূল চালক হলো- বৈশ্বিক উষ্ণতা, যার প্রধান কারণ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ। শিল্পায়ন-পরবর্তী যুগে কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের নিঃসরণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। ওচঈঈ-এর (ওহঃবৎমড়াবৎহসবহঃধষ চধহবষ ড়হ ঈষরসধঃব ঈযধহমব) সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় এরই মধ্যে ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে, এবং এই হার যদি চলতে থাকে তবে ২০৫০ সালের মধ্যে তা ১.৫ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যাবে।
ইউরোপ ও আমেরিকায় সাম্প্রতিক বিপর্যয়
২০২৩ সালে ইউরোপের একাধিক দেশ গ্রিস, ইতালি, জার্মানি ও ফ্রান্সে অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহ ও দাবানল ছড়িয়ে পড়ে। গ্রিসে দাবানলের কারণে এক মাসের মধ্যে ১৫ হাজার হেক্টর বনভূমি পুড়ে যায়। একই সময়ে স্পেনের দক্ষিণাঞ্চলে তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়।
আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া, কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া প্রদেশে দাবানলে হাজার হাজার ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে দাবানলের কারণে ৩০০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয় এবং প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়। অন্যদিকে, অতিবৃষ্টির ফলে নিউইয়র্ক, টেক্সাস ও ফ্লোরিডাতে আকস্মিক বন্যায় বহু মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। ইউরোপের সেøাভেনিয়া ও নেদারল্যান্ডসও একই ধরনের বন্যার কবলে পড়ে। এই অপ্রত্যাশিত দুর্যোগ জলবায়ু পরিবর্তনেরই নির্মম প্রতিচ্ছবি।
২০২৫ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বব্যাপী যে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, তা স্মরণকালের মধ্যেই অন্যতম ভয়ানক। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস, নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, লুইজিয়ানা ও ফ্লোরিডা রাজ্যে যে ভয়াবহ বন্যা ও টর্নেডো হয়েছে, তা দেশটির অর্থনীতি, অবকাঠামো, পরিবহন ব্যবস্থা এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে চরমভাবে বিপর্যস্ত করেছে।
শুধু টেক্সাসেই রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাতের ফলে অন্তত ৪০টি কাউন্টিতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। শহরাঞ্চলে পানির উচ্চতা ৮ ফুট ছাড়িয়ে যায়। এই রাজ্যে প্রায় ১৩০ জনের মৃত্যু হয় এবং ২০ লাখ মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। নিউইয়র্ক ও নিউজার্সি রাজ্যের সাবওয়ে, বিদ্যুৎ ও হাসপাতালব্যবস্থাও ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে এ দুর্যোগে প্রায় ২৭০ জন প্রাণ হারায় এবং আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৯৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।
ইউরোপেও পরিস্থিতি একই রকম ভয়াবহ ছিল। ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডসে প্রবল বৃষ্টিপাত, নদী উপচে পড়া ও ভূমিধস দেখা দেয়। বিশেষ করে জার্মানির রাইন ভ্যালি অঞ্চল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যেখানে ৭৫ জন নিহত হয়। ইউরোপজুড়ে প্রায় ৩৫০ জন নিহত ও ১ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। আর্থিক ক্ষতি প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ইউরো। বিশ্বের এ দুর্যোগ প্রমাণ করে, উন্নত দেশ বলেও জলবায়ু বিপর্যয়ের হাত থেকে কেউ নিরাপদ নয়। এটি শুধু একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, বরং এটি একটি বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সংকট।
জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র একসময় যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেটি এখন নিজেদের জন্যই ঘোর বিপদ ডেকে এনেছে। আজকের দুর্যোগ সেই ভুল সিদ্ধান্তেরই কঠিন মাশুল।
লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি ও বাস্তুচ্যুতি
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালেই শুধু জলবায়ুজনিত দুর্যোগে বিশ্বজুড়ে ৩ লাখের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং ৪ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। জলবায়ু উদ্বাস্তু নামক নতুন শ্রেণির সৃষ্টি হয়েছে, যারা নিরাপদ ভবিষ্যতের আশায় দেশ ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট: সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণদের তালিকায় শীর্ষে
বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। একদিকে আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান, অন্যদিকে দারিদ্র্য ও জনসংখ্যার ঘনত্ব আমাদের পরিস্থিতিকে আরও বিপজ্জনক করে তুলেছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পাহাড়ি ঢল ও আকস্মিক বন্যার মাত্রা ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
২০২৪ সালে স্মরণাতীত কালের ভয়াবহ পাহাড়ি ঢল ফেনী জেলা ও আশপাশের অঞ্চলজুড়ে এক মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে। জুন মাসে ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে মুহুরী ও সিলোনিয়া নদীর পানি বিপৎসীমার অনেক ওপরে উঠে যায়। এতে ফেনী সদর, পরশুরাম, ফুলগাজী এবং ছাগলনাইয়া উপজেলার প্রায় ৪ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালের বন্যায় ৩২ জনের মৃত্যু ঘটে এবং প্রায় ১৫ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কৃষিতে ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ১৮০ কোটি টাকা।
২০২৫ সালেও জুন-জুলাইয়ে ভারী বৃষ্টি ও সীমান্তবর্তী ভারতীয় রাজ্য ত্রিপুরা থেকে নামা পাহাড়ি ঢলে একই অঞ্চলে আবারও প্লাবনের আশঙ্কা দেখা দেয়। তবে সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের আগাম সতর্কতা, বাঁধ মেরামত ও আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুতির কারণে এবার প্রাণহানি এবং বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি রোধ করা সম্ভব হয়েছে। মাত্র ৪ জনের মৃত্যুর পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ২৫ হাজার হলেও অধিকাংশ মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে সক্ষম হয়েছিল। কৃষিক্ষেত্রে ক্ষতি হয়েছে আনুমানিক ৭৫ কোটি টাকার মতো।
এই দুই বছরের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে, আগাম পূর্বাভাস ও প্রস্তুতি থাকলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব:
১. উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার বিস্তার: খুলনা, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালীর মতো জেলাগুলোয় পানিতে ও মাটিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়েছে, ফলে কৃষিকাজ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
২. ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস: ২০০৭ সালের সিডর, ২০০৯ সালের আইলা, ২০২০ সালের আম্ফান এবং ২০২১ সালের ইয়াসের মতো ঘূর্ণিঝড়গুলো লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা ধ্বংস করেছে।
৩. বন্যা ও নদীভাঙন: ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও পদ্মা নদীর অববাহিকায় প্রতিবছর কয়েক লাখ মানুষ ঘরহারা হয়। ২০২২ সালের বন্যায় সিলেট ও সুনামগঞ্জে ৫০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছিল।
৪. ভূ-অবস্থানগত উদ্বেগ: ওচঈঈ-এর মতে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বাড়লে বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ জমি ডুবে যাবে এবং বাস্তুচ্যুত হবে প্রায় ৩ কোটি মানুষ।
প্রতিকার ও করণীয়
জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় রোধে আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও ব্যক্তিগত স্তরে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।
আন্তর্জাতিক উদ্যোগ:
ক্স প্যারিস চুক্তি (২০১৫): বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার লক্ষ্যে ১৯৬টি দেশ সম্মত হয়।
ক্স খড়ংং ্ উধসধমব ঋঁহফ: জলবায়ু বিপর্যয়ের ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য ধনী দেশগুলোর অর্থ সহায়তা প্রদানের তহবিল গঠনের প্রস্তাব পাস হয় ঈঙচ-২৭-এ।
ক্স কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে প্রতিশ্রুতি: ইউরোপ, কানাডা, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ অর্ধেকে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা নিয়েছে।
বাংলাদেশের করণীয়:
১. জলবায়ু বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি: পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বাজেট বৃদ্ধির পাশাপাশি স্থানীয় সরকার ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত কর্মসূচি দরকার।
২. উপকূলীয় বাঁধ মেরামত ও নতুন বাঁধ নির্মাণ: প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটার বাঁধের অধিকাংশই জরাজীর্ণ। এসব বাঁধ আধুনিকায়ন জরুরি।
৩. সবুজ প্রযুক্তি ও পুনর্নবায়নযোগ্য শক্তি: সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুশক্তি ও বায়োগ্যাসের প্রসার ঘটিয়ে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে।
৪. জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য পুনর্বাসন পরিকল্পনা: ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যান (ঘঅচ)-এ জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
৫. গবেষণা ও সচেতনতা বৃদ্ধি: স্কুল-কলেজে জলবায়ু শিক্ষা, গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রচার ও স্থানীয় পর্যায়ে জনগণকে প্রশিক্ষিত করতে হবে।
উপসংহার
জলবায়ু পরিবর্তন এখন বৈশ্বিক মানবিক সংকটে পরিণত হয়েছে। এটি শুধু পরিবেশ নয়, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, অভিবাসন এবং নিরাপত্তার ওপরও ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশ এ সংকটে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে থাকলেও, আমাদের সচেতনতা, বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা ও আন্তরিক উদ্যোগ থাকলে আমরা এ বিপর্যয় থেকে উত্তরণের পথ বের করতে পারি।
আমাদের প্রয়োজন প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের মনোভাব, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকার এবং আজই সেই প্রতিজ্ঞা নেওয়ার উপযুক্ত সময়।