বুধবার, ১৯ নভেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মো. জসিম উদ্দিন, প্রভাষক

প্রকাশিত: অক্টোবর ২০, ২০২৫, ০১:০০ এএম

জ্ঞানচর্চার দেশে জ্ঞানের মানুষ অপমানিত

মো. জসিম উদ্দিন, প্রভাষক

প্রকাশিত: অক্টোবর ২০, ২০২৫, ০১:০০ এএম

জ্ঞানচর্চার দেশে জ্ঞানের মানুষ অপমানিত

বাংলাদেশকে আমরা প্রায়ই ‘জ্ঞানচর্চার দেশ’, ‘আলোকিত জাতির পথিক’ বা ‘মানবসম্পদের শক্তিতে গড়া রাষ্ট্র’ হিসেবে আখ্যা দিই। কিন্তু এ কথাগুলোর মধ্যে যতটা উচ্চারণে মর্যাদা আছে, বাস্তবে ততটা নেই। সমাজে যে পেশাটি একসময় ছিল সর্বোচ্চ সম্মানের, সেই শিক্ষক পেশাই আজ অবমাননার, উপেক্ষার, এমনকি মাঝে মাঝে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

যে মানুষগুলো আগামী প্রজন্মকে গড়ে তুলছেন, তাদের কণ্ঠে আজ ক্ষোভ, হতাশা, আর অবমাননার গ্লানি। এই বৈপরীত্য আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের মূল্যবোধের সংকটের সবচেয়ে স্পষ্ট চিত্র।

শিক্ষক আলোকিত নাকি অবহেলিত?

একসময় শিক্ষক মানেই নীতিবোধের প্রতীক। গ্রামের মানুষ তার পরামর্শকে সম্মান জানাত। আজ সেই শিক্ষক অধিকার আদায়ের জন্য মিছিল করতে বাধ্য। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিক্ষকদের ওপর হামলার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৮-২০২৩ সালের মধ্যে বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শিক্ষকদের ওপর হুমকি, অপমান বা শারীরিক আক্রমণ ৩০% বেড়েছে। শুধু সাম্প্রতিক ঘটনা নয়, দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদা হ্রাস পাচ্ছে। এই অবমাননা শুধু পেশাগত অন্যায় নয়; এটি জাতির আত্মার ওপর আঘাত। কারণ শিক্ষক হলো জাতির নির্মাতা; তাকে অপমান করা মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জ্ঞান ও চিন্তার আলো নিভিয়ে দেওয়া।

শিক্ষকরা আজ শুধু পাঠদান করেন না, তারা প্রশাসনিক যন্ত্রের অংশ হয়ে পড়েছেন। স্কুল-কলেজে ফরম পূরণ, অনলাইন ডেটা এন্ট্রি, এবং সরকারি রিপোর্টের জন্য দিন কাটে। পাঠদানের আনন্দ, মানবিক সম্পর্ক, শ্রদ্ধাবোধÑসব হারিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার পরিবেশে এমন চাপ শিক্ষকের মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অনেক প্রতিভাবান শিক্ষক এখন ক্লান্তি ও হতাশার মধ্যে কাজ করছেন।

শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার, কিন্তু চেতনার অবনতি:

আমরা শিক্ষা খাতে নানা পরিবর্তন এনেছিÑনতুন পাঠ্যক্রম, ডিজিটাল শিক্ষা, কারিকুলাম সংস্কার ইত্যাদি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই পরিবর্তনগুলো কি শিক্ষার মূল চেতনাকে শক্তিশালী করছে, নাকি কেবল নতুন কাঠামোর মধ্যে পুরোনো সংকটকে লুকিয়ে রাখছে? শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার ভারে জর্জরিত, শিক্ষকরা প্রশাসনিক ঝামেলায় ক্লান্ত, আর শিক্ষা নীতির দিকনির্দেশনা প্রায়ই বাস্তবতার সঙ্গে সংযোগহীন। ফলে শিক্ষার মূল লক্ষ্য, মানবিক ও চিন্তাশীল নাগরিক তৈরিÑতা অধরাই রয়ে গেছে।

আজকের স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা কেবল পাঠদান করেন না; তাদের দিনের অনেকটাই ফরম পূরণ, অনলাইন ডেটা এন্ট্রি এবং সরকারি রিপোর্টের কাজে কেটে যায়। ফলে পাঠদানের আনন্দ, মানবিক সম্পর্ক, শ্রদ্ধাবোধÑসবই হারিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার পরিবেশে এমন চাপ শিক্ষকের মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অনেক প্রতিভাবান শিক্ষক এখন ক্লান্তি ও হতাশার মধ্যে কাজ করছেন।

নীতিনির্ধারণের অস্থিরতা:

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার আরেকটি বড় সংকট হলো নীতিনির্ধারণের অস্থিরতা। কয়েক মাস পরপর ম্যানেজিং বা গভর্নিং বডির পরিবর্তন, শিক্ষানীতি এক সরকারের সময় থেকে আরেক সরকারের সময় ভিন্ন রূপ ধারণ, আর পাঠ্যক্রমে লাগাতার পরিবর্তনÑসব মিলিয়ে শিক্ষা খাতটি আজ এক ধরনের হ-য-ব-র-ল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কোনো শিক্ষা সংস্কারের ফলাফল পরিমাপ করার আগেই নতুন নির্দেশনা এসে পড়ে। শিক্ষককে কখনো নতুন সিলেবাসে, কখনো নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতিতে মানিয়ে নিতে হয়, অথচ পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ বা প্রস্তুতির সুযোগ দেওয়া হয় না। এর ফলে শিক্ষার্থী বিভ্রান্ত, শিক্ষক ক্লান্ত, আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রশাসনিক জটিলতায় জর্জরিত। শিক্ষা হচ্ছে একটি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ, যেখানে স্থিতিশীলতা ও ধারাবাহিকতা অপরিহার্য; কিন্তু আমাদের নীতিগত এই অস্থিরতা শিক্ষার মূল লক্ষ্যকেই ব্যাহত করছে, আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছেÑএটাই সবচেয়ে বড় উদ্বেগ।’

শিক্ষার মান নষ্টের দায় কেবল শিক্ষকের নয়:

বাংলাদেশের শিক্ষা আজ নানা সংকটে জর্জরিতÑমানের অবনতি, মেধা পাচার, প্রশ্নফাঁস, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে আস্থার সংকট। কিন্তু এই সংকটের দায় আমরা প্রায়ই একতরফাভাবে শিক্ষকের কাঁধে চাপাই। এটি অন্যায্য।

যে শিক্ষক সারা বছর অপ্রতুল বেতনে, সীমিত সম্পদে, ক্লান্ত দেহে, ভবিষ্যতের নাগরিক গড়ে তুলছেন, তাকে দোষারোপ করা সহজ, কিন্তু তার প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা দূর করা কঠিন।

শিক্ষার মান বাড়াতে হলে প্রথমেই শিক্ষকের মানসিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা, এবং সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষক যতদিন ভাতের চিন্তায়, অসম্মানের যন্ত্রণায় ভুগবেন, ততদিন শ্রেণিকক্ষে জ্ঞানের আলো পূর্ণতায় জ্বলবে না।

রাষ্ট্রের নৈতিক দায়:

রাষ্ট্র শুধু উন্নয়ন সূচক দিয়ে নিজেকে মাপতে পারে না। জিডিপি, বাজেট, রিজার্ভÑএসবই অর্থনৈতিক সূচক, কিন্তু জাতির আত্মার সূচক হলো শিক্ষা ও সংস্কৃতি।

আজ আমাদের অর্থনীতি বেড়েছে, সেতু হয়েছে, মহাসড়ক আলোকিতÑকিন্তু শিক্ষার আলো কোথায়?

যখন শিক্ষকদের ওপর হামলা হয়, তাদের দাবিকে অবমূল্যায়ন করা হয়, তখন সেটি কেবল পেশাগত অন্যায় নয়, এটি রাষ্ট্রের নৈতিক ব্যর্থতা। কারণ যে রাষ্ট্র তার শিক্ষকদের মর্যাদা দিতে জানে না, সে রাষ্ট্র দীর্ঘমেয়াদে টেকসই উন্নয়ন অর্জন করতে পারে না।

অবসর ও পেনশন সংক্রান্ত বাস্তবতা:

শিক্ষক অবসরের পর তার পেশাজীবনের সমস্ত মেধা ও শ্রমের স্বীকৃতি হিসেবে নিরাপদ পেনশন, চিকিৎসা সুবিধা ও সামাজিক সুরক্ষা পাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্নÑঅনেক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বছরের পর বছর ধরে এই অধিকার পেতে অপেক্ষা করেন। কখনো কখনো প্রশাসনিক জটিলতা বা দুর্নীতির কারণে সুবিধাগুলো দীর্ঘ সময় আটকে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে কেউ কেউ স্বাস্থ্যহানির শিকার হন, আবার কেউ কেউ মারা যান অধিকার না পেয়ে। এটি কেবল ব্যক্তিগত অন্যায় নয়, বরং রাষ্ট্র ও সমাজের নৈতিক ব্যর্থতার প্রতিফলন, যা শিক্ষকের শ্রম ও শিক্ষার মর্যাদাকে হীন করে।

শিক্ষকের প্রতি সমাজের দায় কোথায়?

আমরা সবাই চাই আমাদের সন্তান ভালো ফল করুক, ভালো চাকরি পাকÑকিন্তু আমরা কি তাদের শেখাই শিক্ষকের প্রতি সম্মান দেখাতে? আজকের শিশুরা ঘরে, মিডিয়ায়, কিংবা সমাজে অনেক সময় শিক্ষকের প্রতি অবজ্ঞা দেখতে পায়। ফলে তাদের মনেও শ্রদ্ধাবোধ কমে যায়। যদি একটি সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা হারিয়ে যায়, তবে এটি সমাজের আত্মিক দারিদ্র্যেরই প্রকাশ। আমরা হয়তো অর্থে সমৃদ্ধ হচ্ছি, কিন্তু জ্ঞানে গরিব হয়ে পড়ছি।

ভবিষ্যতের পথ: শিক্ষায় মানবিকতার প্রত্যাবর্তন

শিক্ষাকে মানবিক মর্যাদায় ফিরিয়ে আনাই শিক্ষার মূল চাবিকাঠি। শিক্ষক শুধু পাঠদানকারী নয়; তারা সমাজ ও জাতির নেতৃত্বের নীতিকাঠামো। শিক্ষার লক্ষ্য কেবল চাকরি নয়Ñমানুষ তৈরি, চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি, নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ স্থাপন। এই বাস্তবতা থেকে উত্তরণের জন্য কিছু মৌলিক পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবি।’

প্রথমত, পর্যাপ্ত বেতন ও পেনশন সুরক্ষা:

শিক্ষক যেন জীবনের ন্যূনতম প্রয়োজনের জন্য লড়াই করতে না হয়। নিয়মিত ও প্রতিযোগিতামূলক বেতন, নিরাপদ পেনশন ব্যবস্থা শিক্ষকের মানসিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।

দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রশাসনিক কাঠামো:

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেন রাজনৈতিক চাপ ও হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকে। শিক্ষক তার শিক্ষাদানের দায়িত্ব পূর্ণ মনোযোগে পালন করতে পারবে।

তৃতীয়ত, শিক্ষক প্রশিক্ষণের মানোন্নয়ন:

শিক্ষককে আধুনিক শিক্ষাদানের কৌশল, চিন্তাশীল পাঠদান, এবং মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ শেখানোর জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।

চতুর্থত, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ:

পিতা-মাতা, কমিউনিটি এবং মিডিয়ার মাধ্যমে শিক্ষকের মর্যাদা পুনঃস্থাপন করা। শিশুরা শিক্ষককে সম্মান করতে শিখবে, যা ভবিষ্যৎ নাগরিক হিসেবে তাদের চরিত্র গঠনে সহায়ক হবে।

পঞ্চমত, কর্মপরিবেশের উন্নয়ন:

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত অবকাঠামো, ক্লাসরুম, প্রযুক্তি ও শিক্ষাসামগ্রী সরবরাহ করা। শিক্ষক যেন পড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় সব সরঞ্জাম ও সহায়তা পান।

ষষ্ঠতম, মানসম্মত মূল্যায়ন ব্যবস্থা:

শিক্ষকের কাজকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। শুধু পরীক্ষার ফলাফল নয়, শিক্ষার্থী গড়ে তোলার মানবিক ও সৃজনশীল দিকও বিবেচনা করা হবে।

সপ্তমত, নিরাপদ ও সমর্থনমূলক পরিবেশ:

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর জন্য শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বিদ্যালয়-কলেজকে সহায়তা ও মনোবল বৃদ্ধির পরিবেশ বানানো।

অষ্টমত, জাতির নৈতিক ও মানবিক উন্নয়নে শিক্ষকের অংশগ্রহণ:

শিক্ষককে নীতিনির্ধারণে, কমিউনিটি উন্নয়নে ও শিক্ষানীতি প্রণয়নে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া। শিক্ষকের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান জাতীয় উন্নয়নের জন্য কাজে লাগানো।

রাষ্ট্রকে মনে রাখতে হবে, জাতির মেরুদ- কেবল অবকাঠামো নয়; তার প্রাণদাতা হলো শিক্ষক সমাজ। এই মেরুদ- ভেঙে গেলে পুরো জাতিই বিকল হয়ে পড়ে। শিক্ষককে মর্যাদা দেওয়া মানে শিক্ষার আলোকে শক্তিশালী করা এবং দেশের ভবিষ্যৎকে আলোকিত করা।

পরিশেষে বলতে পারি, বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের পথে, কিন্তু এই উন্নয়ন তখনই অর্থবহ হবে, যখন শিক্ষার মাটি শক্ত হবে, শিক্ষকের চোখে আবার সম্মানের আলো ফুটবে। আমরা যদি সত্যিই একটি আলোকিত বাংলাদেশ চাই, তবে প্রথমে আলোকিত মানুষদের সম্মান দিতে হবেÑযাদের হাতেই জাতির ভবিষ্যৎ গড়া। তাদের অপমান করা মানে নিজেদের অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া।

বাংলাদেশ যদি সত্যিই জ্ঞানের দেশ হতে চায়, তবে জ্ঞানের মানুষের মর্যাদা ফিরিয়ে আনাই হবে প্রথম ও প্রধান সংস্কার।

মো. জসিম উদ্দিন, প্রভাষক, অর্থনীতি বিভাগ জয়পুরা এসআরএমএস স্কুল অ্যান্ড কলেজ

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!