জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা মানব ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসলীলার পর বিশ্ব যখন এক চরম অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড়িয়ে, তখন ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর এই সংস্থা আলোর দিশারি হিসেবে আবির্ভূত হয়। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা ছিল এক স্বপ্নময় উদ্যোগ, যা এক বিধ্বস্ত পৃথিবীতে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সহযোগিতার নতুন হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আশায়।
আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষা করা, মানবাধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করার মতো মহান লক্ষ্যগুলো নিয়ে গঠিত এই সংঘ তৎকালীন বিশ্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে গভীর আশার সঞ্চার ঘটিয়েছিল। পুরো বিশ্ব তখন এই সংস্থার দিকে তাকিয়েছিল এক ন্যায্য ও সমতার পৃথিবী প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশায়। কিন্তু আজকের এই দিন পর্যন্ত সেই প্রত্যাশা কতটা পূরণ হয়েছে, তা এক কঠিন প্রশ্ন। আজকের বিশ্বে জাতিসংঘের কার্যক্রম কি সত্যিই বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামগ্রিক স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে, নাকি এটি কেবল ধনী ও শক্তিধর দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষার এক সুবিশাল হাতিয়ার মাত্র?
জাতিসংঘের কাঠামো বিশ্লেষণ করলেই এই বিতর্কটির বীজ খুঁজে পাওয়া যায়। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ, নিরাপত্তা পরিষদ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ, অছি পরিষদ, আন্তর্জাতিক বিচার আদালত এবং সচিবালয়সহ মোট ছয়টি প্রধান অঙ্গসংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রবিন্দু হলো নিরাপত্তা পরিষদ। প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্ন থেকেই এই পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ লাভ করে বিশ্বের পাঁচ গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী মোড়লÑ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া এবং ফ্রান্স। এই পাঁচ স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের হাতে রয়েছে যেকোনো সিদ্ধান্তকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য ‘ভেটো’ প্রদানের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। এই ভেটো ব্যবস্থা শুধু যে তাদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে ব্যবহৃত হয় তা নয়, বরং তাদের মিত্র রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থকেও প্রাধান্য দিতে গিয়ে এর অপব্যবহার করা হয়। এর ফলস্বরূপ, অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত কণ্ঠস্বর অনেক সময়ই এই ক্ষমতার দাপটে নীরব হয়ে যায়, যা আন্তর্জাতিক সমতার নীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থি।
এই স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রগুলোর আত্মস্বার্থকেন্দ্রিক কর্মকা- বিশ্বের ইতিহাসে বহুবার কালো অধ্যায়ের সাক্ষ্য বহন করেছে। সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণগুলোর একটি হলো ২০০৩ সালের ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে এবং নিরাপত্তা পরিষদের সুস্পষ্ট অনুমোদন ছাড়াই বিশ্বের মানচিত্রে অবস্থান করা স্বাধীন রাষ্ট্র ইরাকে অভিযান চালায়। নিরাপত্তা পরিষদের অন্যান্য সদস্য দেশ এই অভিযানের বিরোধিতা করলেও, ভেটো ব্যবস্থার ফাঁক গলে ধনী দেশগুলো তাদের ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ বজায় রাখতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে, আফ্রিকার ক্ষুদ্র এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া রাষ্ট্রগুলোতে সামান্য অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হলেও জাতিসংঘের তাৎক্ষণিক কড়া পদক্ষেপ অনেক ক্ষেত্রে নিজস্ব স্বকীয়তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। এই বৈষম্যমূলক আচরণই প্রমাণ করে যে, জাতিসংঘের কাঠামো ও কার্যপদ্ধতি ঐতিহ্যগতভাবে ধনী রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থের অনুকূলে পরিচালিত হয়।
সম্প্রতি চলমান ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন যুদ্ধ জাতিসংঘের কার্যকারিতা নিয়ে বিতর্কের আগুনে যেন ঘি ঢেলেছে। ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে ফিলিস্তিনের নিরীহ নারী, শিশু এবং বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধের যথাযথ নিয়মকে অমান্য করে নিজেদের স্বেচ্ছারিতার মাধ্যমে এই গণহত্যা জারি রাখা হয়েছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব যতবার উত্থাপন করা হয়েছে, ঠিক ততবারই ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো প্রদানের মাধ্যমে তা ভ-ুল হয়েছে। এ ধরনের নজির দেখিয়ে ধনী রাষ্ট্রগুলো নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় আন্তর্জাতিক মঞ্চকে ব্যবহার করে অন্যান্য ক্ষুদ্র দেশগুলোকে শোষণ করে যাচ্ছে। একইভাবে, দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও জাতিসংঘ শুধু নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে, যা এর নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে পারার ব্যর্থতাকে স্পষ্ট করে তোলে। ফলে প্রশ্ন জাগে, বৈশ্বিক সংকটের মুখে জাতিসংঘ কি কেবল একটি নীরব দর্শক বা ক্ষমতাশালীদের হাতের পুতুল?
জাতিসংঘের মূল নীতিমালার মধ্যে রয়েছে মানবাধিকার রক্ষা, আন্তর্জাতিক শান্তি বজায় রাখা, দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নির্মূল এবং সকল দেশের সমান অধিকার নিশ্চিত করা। কিন্তু বাস্তবতার চিত্র প্রায়শই এর বিপরীত। উন্নয়নশীল ও গরিব দেশগুলোর জরুরি সমস্যাÑ যেমন খাদ্য নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি, স্বাস্থ্য সংকট এবং আন্তর্জাতিক ঋণ। এগুলো জাতিসংঘের নীতিমালার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত হলেও, ধনী দেশগুলো তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় প্রায়শই এসব নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। উদাহরণস্বরূপ, জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আলোচনায় উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রায়শই মূল সিদ্ধান্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে না, কারণ ধনী দেশগুলো তাদের শিল্প ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় প্রভাব খাটিয়ে সিদ্ধান্তগুলোকে নিজেদের দিকে প্রভাবিত করে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এই প্রক্রিয়াকে গ্লোবাল পলিটিক্সের বুর্জোয়া স্বার্থের প্রতিফলন হিসেবে ব্যাখ্যা করে থাকেন। এর অর্থ হলো, নীতিমালার সুফল থেকে গরিব দেশগুলো বঞ্চিত হয় এবং তাদের সমস্যা প্রায়শই ধনী দেশগুলোর স্বার্থের কাছে অবমূল্যায়ন করা হয়। যেকোনো যুদ্ধ ও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে জাতিসংঘ কেবল নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে এবং নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়। এই দুর্বলতা স্পষ্ট করে তোলে যে, জাতিসংঘের পরিচালনা পদ্ধতি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ধনী রাষ্ট্রের প্রভাব দ্বারা পরিচালিত হয়।
আজ জাতিসংঘের প্রায় ৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এসেও এর কার্যক্রম, পরিচালনা পদ্ধতি ও সফলতা নিয়ে তাই মৌলিক প্রশ্নগুলো থেকেই যাচ্ছে। বিশ্বকে যদি সত্যিই একটি ন্যায্য, শান্তিপূর্ণ ও সমতার মঞ্চ উপহার দিতে হয়, তবে জাতিসংঘকে তার স্বকীয়তা বজায় রেখে কাজ করতে হলে কিছু মৌলিক সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। প্রথমত এবং প্রধানত, নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী রাষ্ট্রগুলোর ভেটো ক্ষমতাকে যথাযথ সংস্কার করে এর কার্যাবলিকে স্বাধীন করে দিতে হবে, যাতে কোনো একক বা কয়েকটি দেশের স্বার্থে বিশ্বশান্তি ও ন্যায়বিচার বিঘিœত না হয়। একই সঙ্গে, বিশ্ব কূটনৈতিক গুরুত্বের সঙ্গে জোরদার করে সকল দেশের স্বার্থে জাতিসংঘের নিজস্ব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এই সংস্কার প্রক্রিয়ায় গরিব ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোরও একটি সুদৃঢ় ও কার্যকর অবস্থান থাকা আবশ্যক। কেবল কাঠামোগত এই মৌলিক পরিবর্তনগুলোই জাতিসংঘকে ‘ধনী রাষ্ট্রের হাতিয়ার’ না হয়ে, বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রকৃত ‘আন্তর্জাতিক সংস্থা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

