ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রায়ের তারিখ ঘোষণা সামনে রেখে রাজধানীসহ দেশের অনেক স্থানে শুরু হয়েছে চোরাগোপ্তা হামলা। হঠাৎ করেই সোমবার ও মঙ্গলবার ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় ফিরেছে আগুনসন্ত্রাস। দুই দিনে বেশ কয়েকটি বাসে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ময়মনসিংহে বাসের আগুনে ঘুমন্ত চালক পুড়ে নিহত হয়েছেন। একই জেলার ট্রেনেও আগুন দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে রাজধানীতে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে শুরু হয়েছে ককটেল বা হাতবোমা ছুড়ে মারা।
ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ, রাজধানী থেকে জনপথ সবখানে ফের ফিরে এসেছে আগুন আর আতঙ্কের রাজনীতি। ঐতিহাসিক মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণাকে ঘিরে যখন সারা দেশের মানুষের দৃষ্টি আদালতের দিকে, তখনই হঠাৎ আগুন, ককটেল বিস্ফোরণ, সহিংসতা আর ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে আবারও ঘোলা জলে মাছ ধরার চেষ্টা করছে একটি পতিত রাজনৈতিক শক্তি। রাজধানীর রাস্তায়, জনপথের বাসে, এমনকি ট্রেনের ইঞ্জিনে আগুন ধরিয়ে সাধারণ মানুষকে হত্যার যে নৃশংসতা চলছে, তা কোনোভাবেই রাজনীতি নয়, এটি ঘৃণ্য অপরাধ, যা রাষ্ট্রের অস্তিত্বকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়।
গত দুই দিনে ঢাকায় অন্তত নয়টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, ১৭টি ককটেল বিস্ফোরণ এবং ময়মনসিংহে ঘুমন্ত বাসচালকের মৃত্যুর মতো ঘটনা প্রমাণ করে, এই আগুন সন্ত্রাস পরিকল্পিত। উদ্দেশ্য একটাই, আদালতের রায় ঠেকানো, রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করা এবং সাধারণ মানুষের মনে ভয় ছড়ানো। গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিবেদন বলছে, এসব চোরাগোপ্তা হামলায় জড়িত নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও তাদের ভাড়াটে দোসররা। তারা চায় না বিচার হোক, চায় না মানুষ শান্তিতে থাকুক। তারা চায় নৈরাজ্য, চায় রক্ত।
আগুন দিয়ে রাজনীতি করার সংস্কৃতি এই দেশে নতুন নয়। অতীতে বিএনপি-জামায়াতের সময়ও একইভাবে বাসে আগুন, রেললাইন ধ্বংস, মানুষ পোড়ানোর ঘটনা ঘটেছিল। তখন আওয়ামী লীগ অভিযোগ তুলেছিল প্রতিপক্ষের দিকে। আজ যখন নিজেরাই সেই আগুনের রাজনীতি ফিরিয়ে এনেছে, তখন মানুষ আর বিভ্রান্ত হচ্ছে না। কারণ সাধারণ মানুষ এখন জানে, যারা ক্ষমতার জন্য প্রাণ দিতে পারে, তারা গণমানুষের পক্ষে নয়, তারা রাষ্ট্রবিরোধী।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সহিংসতার দায়ভার বিএনপি-জামায়াতের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হতো। এখন আবার আগুনসন্ত্রাস, সহিংসতা ও ভাঙচুরের রাজনীতি সামনে এসেছে। এখন জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, আগে এসব নৈরাজ্য অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হতো, কিন্তু এখন এসব অপরাধমূলক ঘটনার নেপথ্যে কারা? নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ছাড়া দেশের মাটিতে এমন অস্থিতিশীল পরিবেশ অন্য কেউ করতে পারে না। আসলেই আওয়ামী লীগ ভয়াবহ সন্ত্রাসী এক দল হয়ে উঠেছে, যার প্রমাণ দেশের মানুষ দেখতে পারছে। এদিকে বিএনপিপন্থি একাধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের দাবিÑ আওয়ামী লীগ অগ্নিসন্ত্রাসের রাজনীতিতে বিশ্বাসী, যার কারণে তারা ঢাকাসহ সারা দেশে আগুনসন্ত্রাস, সহিংসতা, ভাঙচুর, মানুষ পোড়ানোর রাজনীতির মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান তৈরির চেষ্টা করছে। ফ্যাসিবাদের দোসররা দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তাদের হাত থেকে রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে গেলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে এবং সব ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করতে হবে। তাহলেই এরা শক্ত হাতে দমন হবে।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব এখন একটাই, যেভাবেই হোক এই আগুনসন্ত্রাস থামাতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনকে সর্বোচ্চ সতর্কতায় থাকতে হবে। দুর্বৃত্তদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে হবে, রাজনৈতিক পরিচয় যাই হোক না কেন। একই সঙ্গে জনগণকেও সচেতন থাকতে হবে, যে কোনো সন্দেহজনক কর্মকা-, অচেনা ব্যক্তি বা বিস্ফোরক দেখলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে জানাতে হবে।
ইতোমধ্যে, রাজধানী ও দেশজুড়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। যা ইতিবাচক। তবে শুধু সরকারি সতর্কতা যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন সামাজিক ঐক্য, নাগরিক প্রতিরোধ এবং আগুনসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে স্পষ্ট জনমত। যারা রাজনৈতিক সুবিধা হাসিলের জন্য আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারে, তাদের প্রতি ঘৃণা ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে প্রত্যেক নাগরিকের।
আমরা আশা করব, গত কয়েক দিনে বিভিন্ন স্থানে আগুন সন্ত্রাসের কারণে দেশের মানুষের মাঝে যে আতঙ্ক বিরাজ করছে তা নিরসনে গুরত্বের সঙ্গে কাজ করবে সরকার। যেকোনো মূল্যে এই আগুনসন্ত্রাস প্রতিহত করতে হবে। যারা দেশকে অস্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যেতে চায় তাদেরকে চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনার কোনো বিকল্প নেই। আগুন কোনো দল, মত বা রং চেনে না। এ আগুন জ্বলে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের বুকে। কেড়ে নেয় নিরীহ মানুষের প্রাণ, পুড়িয়ে দেয় রাষ্ট্রীয় সম্পদ।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন