মানুষের মস্তিষ্কে জন্ম নেওয়া প্রতিটি ভাবনারই আছে এক অনিবার্য যাত্রাপথ, জ্ঞান থেকে প্রজ্ঞায়, শেখা থেকে সৃষ্টি পর্যন্ত। একসময় চক-ডাস্টে ভরা শ্রেণিকক্ষ, কালো বোর্ড আর খাতা-কলমই ছিল শিক্ষার একমাত্র ঠিকানা। শিক্ষক ছিলেন আলোর দিশারি, আর ছাত্ররা সেই আলোর অনুসারী। কিন্তু সময় থেমে থাকেনি। প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি, বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) আবির্ভাব, সেই পুরোনো কাঠামোকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে।
আজ একটি মেশিনও উত্তর দিতে পারে, ব্যাখ্যা করতে পারে, এমনকি শেখাতেও পারে, যা একসময়ে কেবল মানুষের হাতেই সম্ভব ছিল। তাহলে প্রশ্ন জাগে, আমরা কী এক নতুন শিক্ষা বিপ্লবের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে? নাকি মানবিকতার মূল সত্তা হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছি যন্ত্রের বুদ্ধির ভিড়ে?
আমরা খুঁজে দেখব, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে শিক্ষা ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ কেমন হতে পারে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ভূমিকা কোথায় দাঁড়াবে, এবং জ্ঞানের এই দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে মানুষ আসলে কোন পথে এগোবে। এক নতুন ভোরের আলোয় দাঁড়িয়ে আমরা কি তৈরি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য, যেখানে পাঠশালা হবে ডিজিটাল, আর শিক্ষক হবেন হয়তো এক বুদ্ধিমান অ্যালগরিদম?
মানব সভ্যতার ইতিহাসে শিক্ষা সব সময়ই সমাজ, প্রযুক্তি ও চিন্তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু এআই-এর আবির্ভাব শিক্ষাক্ষেত্রে এক অভূতপূর্ব বিপ্লবের সূচনা করেছে। একসময় শিক্ষক ছিলেন জ্ঞানের একমাত্র উৎস, এখন গুগল, চ্যাটবট, ভার্চুয়াল টিউটর, এমনকি এআই ঈষধংংৎড়ড়স অংংরংঃধহঃ সবাই শিক্ষক হয়ে উঠছে। ছাত্ররা এখন শুধু পাঠ্যপুস্তক নয়, বরং একটি বৈশ্বিক মস্তিষ্কের সঙ্গে যুক্ত। প্রশ্ন জাগে, তাহলে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য কি এখন কেবল তথ্য প্রাপ্তি, না চিন্তার বিকাশ?
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো পরীক্ষানির্ভর, মুখস্থনির্ভর এবং একই মাপে সবার মেধা মাপার এক পুরোনো পদ্ধতিতে আবদ্ধ। অথচ এআই এমন এক বাস্তবতা তৈরি করেছে, যেখানে জ্ঞানের চেয়ে বেশি প্রয়োজন সৃজনশীলতা, সমালোচনামূলক চিন্তা ও নৈতিক বোধ। ভবিষ্যতের চাকরির বাজারে অ্যালগরিদম যখন মানুষের জায়গা নেবে, তখন একজন শিক্ষার্থীর আসল মূল্য হবে, সে কতটা মানবিক, কতটা কল্পনাশীল এবং কতটা অরিজিনাল।
বিশ্বের অনেক দেশ ইতোমধ্যেই পাঠ্যক্রমে অও শিক্ষা যুক্ত করেছে। যুক্তরাজ্যে এআই ‘খরঃবৎধপু’ বাধ্যতামূলক, দক্ষিণ কোরিয়া প্রাথমিক স্তর থেকেই শিক্ষার্থীদের মেশিন লার্নিং ও কোডিং শেখাচ্ছে। অথচ আমাদের দেশে এখনো ডিজিটাল ডিভাইস বা প্রযুক্তিগত বৈষম্যই বড় বাধা। শহরের ছাত্র এআই টুল ব্যবহার করে প্রজেক্ট তৈরি করতে পারে, কিন্তু গ্রামের এক মেধাবী ছাত্র এখনো বিদ্যুৎ বা ইন্টারনেটের সংকটে ভোগে। ফলে প্রযুক্তির সুবিধা যতটা আসছে, ততটাই বাড়ছে অসমতা।
তবুও হতাশার কারণ নেই। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম প্রযুক্তিবান্ধব, দ্রুত শিখে এবং অভিযোজনে সক্ষম। আমাদের দরকার শুধু নীতিনির্ধারকদের দূরদৃষ্টি, শিক্ষাকে শুধু পরীক্ষা বা সার্টিফিকেটের গ-ি থেকে বের করে এনে এমন এক জীবন্ত অভিজ্ঞতায় রূপ দেওয়া, যেখানে শিক্ষক হবেন অনুপ্রেরণার উৎস, আর এআই হবে সহযোগী হাতিয়ার।
অতএব, আজকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে শিক্ষা কেমন হবে? শিক্ষক কি রোবটের কাছে হার মানবে, নাকি মানুষ তার মানবিক বোধ দিয়েই প্রযুক্তিকে মানবিক পথে পরিচালিত করবে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই আমাদের নতুন শিক্ষাদর্শ প্রয়োজন, যেখানে বুদ্ধি-বোধ দুটোই সমান গুরুত্ব পাবে। কারণ শিক্ষা যদি মানুষ তৈরি না করে, তবে যন্ত্র যত বুদ্ধিমানই হোক, সমাজ কখনো আলোকিত হবে না।
এআই-নির্ভর শিক্ষার চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আজ শিক্ষার পরিধি পাল্টে দিচ্ছে, এতে যেমন অসীম সম্ভাবনা, তেমনি কিছু গভীর উদ্বেগও আছে। আগে যেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক ছিল মানবিক যোগাযোগের ওপর ভিত্তি করে, এখন সেই স্থানে ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে অ্যালগরিদম, ডেটা বিশ্লেষণ আর ভার্চুয়াল রোবোটিক সহকারী। ফলে প্রশ্ন উঠছে, এই প্রযুক্তি কি শিক্ষাব্যবস্থাকে মানবিক করে তুলবে, নাকি আরও যান্ত্রিক?
এআই ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে শিক্ষার পদ্ধতিকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক (চবৎংড়হধষরুবফ খবধৎহরহম) করে তুলছে। একজন শিক্ষার্থীর শেখার গতি, দুর্বল দিক, আগ্রহের বিষয়, সবকিছু বিশ্লেষণ করে এআই এখন নিজস্ব পাঠ পরিকল্পনা তৈরি করতে পারে। এতে যেমন শিক্ষার মান বাড়ছে, তেমনি সময় ও খরচও কমছে। উদাহরণস্বরূপ উঁড়ষরহমড় বা ঈড়ঁৎংবৎধ-এর মতো অ্যাপ প্ল্যাটফর্মগুলো এআই ব্যবহার করে শিক্ষার্থীর শেখার ধরন অনুযায়ী প্রশ্ন ও কনটেন্ট সাজাচ্ছে। এতে শিক্ষককে আর একসঙ্গে ৫০ জন শিক্ষার্থীর মান সামলাতে হয় না, এআই তার সহায়ক হয়ে ওঠে।
তবে এই পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে এক নতুন সামাজিক ও নৈতিক সমস্যা। প্রথমত, ডিজিটাল বৈষম্য। শহরাঞ্চলের ধনী শিক্ষার্থী হয়তো ল্যাপটপ ও হাই-স্পিড ইন্টারনেট ব্যবহার করে এআই ক্লাস নিতে পারে, কিন্তু গ্রামীণ শিক্ষার্থী সেই সুযোগ পায় না। ফলে শিক্ষা সমতার জায়গায় নতুন এক প্রযুক্তিভিত্তিক বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ডেটা গোপনীয়তা ও মানসিক নির্ভরতা। এআই যখন শিক্ষার্থীর আচরণ বিশ্লেষণ করে শেখার পরিকল্পনা দেয়, তখন ব্যক্তিগত তথ্যও সংগ্রহ করে, যা ভবিষ্যতে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
তৃতীয়ত, শিক্ষকের ভূমিকা সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা। অনেকেই ভাবেন, এআই শিক্ষককে অপ্রয়োজনীয় করে তুলবে। কিন্তু বাস্তবে শিক্ষকই হতে পারেন এআই যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, কারণ প্রযুক্তি তথ্য দিতে পারে, কিন্তু মূল্যবোধ, অনুপ্রেরণা ও মানবিক অনুভব শেখাতে পারে না। একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীর মধ্যে যে সৃষ্টিশীলতা, প্রশ্ন তোলা ও বিতর্কের মনোভাব জাগিয়ে তুলতে পারেন, তা কোনো যন্ত্রের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই শিক্ষকের ভূমিকা বদলাবে, তথ্যদাতা থেকে সহযাত্রী ও অনুপ্রেরণাদাতাতে।
এআই-নির্ভর শিক্ষা পদ্ধতির আরও একটি বড় সুবিধা হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা (ওহপষঁংরাব ঊফঁপধঃরড়হ)। অটিজম বা প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য এআই ভয়েস রিকগনিশন, স্পিচ-টু-টেক্সট, বা স্মার্ট টিউটরিং সিস্টেম তৈরি করছে, যা আগে অকল্পনীয় ছিল। একই সঙ্গে, এআই-নির্ভর মূল্যায়ন পদ্ধতি (এআই-নধংবফ অংংবংংসবহঃ) পরীক্ষার জটিলতা কমিয়ে দ্রুত ফলাফল দিতে পারে, এবং পক্ষপাতহীন মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে পারে, যদি এর ব্যবহার নৈতিকভাবে সঠিক হয়। সুতরাং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিক্ষাক্ষেত্রে কোনো ভয় নয়, বরং একটি নতুন জানালা। তবে এই জানালায় আলো যেমন প্রবেশ করে, তেমনি প্রবেশ করে ছায়াও। আমাদের দায়িত্ব হবে, এআই-কে ব্যবহার করা মানবিক উদ্দেশ্যে, যাতে শিক্ষা কেবল প্রযুক্তিনির্ভর না হয়ে সত্যিকার অর্থে মানবনির্ভর জ্ঞানচর্চার ধারক হয়। আর এজন্য দরকার সঠিক নীতি, প্রশিক্ষিত শিক্ষক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি।
মানুষ না যন্ত্র, শিক্ষার ভবিষ্যৎ কোন পথে? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আজ আমাদের জীবনের প্রতিটি স্তরে প্রবেশ করেছে, কাজ, যোগাযোগ, চিকিৎসা, এমনকি চিন্তার পরিসরেও। শিক্ষাব্যবস্থা তার বাইরে নয়। কিন্তু বড় প্রশ্ন হলো, এই প্রযুক্তি কি মানুষকে আরও জ্ঞানী করে তুলছে, নাকি কেবল যান্ত্রিকভাবে দক্ষ করে তুলছে? শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য তো শুধু তথ্য জানা নয়, বরং সেই তথ্য থেকে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বিকাশ ঘটানো। আর এই জায়গাতেই মানুষ ও যন্ত্রের সীমারেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশে এখন আলোচনা চলছে, এআই কি শিক্ষককে প্রতিস্থাপন করবে? কিন্তু প্রকৃত উত্তর হলো, না, এআই শিক্ষককে নয়, বরং শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করবে। শিক্ষক তখন জ্ঞানের উৎস নয়, বরং দিকনির্দেশক, সহচর এবং অনুপ্রেরণাদাতা। কারণ, শিক্ষার প্রাণ মানবিকতা, যা যন্ত্র কখনোই দিতে পারবে না। একজন শিক্ষক যেমন শিক্ষার্থীর চোখে ভয় বা কৌতূহল চিনে নিতে পারেন, এআই তা পারে না। তাই ভবিষ্যতের শিক্ষা ব্যবস্থায় মানুষ ও যন্ত্রের মধ্যে এক ধরনের সহাবস্থান তৈরি করতে হবে, যেখানে এআই তথ্য সরবরাহ করবে, আর মানুষ শেখাবে চিন্তা করা, অনুভব করা ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া। তবে বাস্তবতা হলো, এই রূপান্তর একদিনে সম্ভব নয়। আমাদের পাঠ্যক্রম, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, এবং শিক্ষানীতি, সবকিছুতে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। যদি এখনই আমরা শিক্ষাকে এআই-সম্মত করে পুনর্গঠন না করি, তবে এক দশকের মধ্যে শিক্ষার্থীরা এমন পদ্ধতিতে শিক্ষা নেবে, যা আমরা প্রস্তুতই নই। তাই জরুরি হয়ে পড়েছে এআই-খরঃবৎধপু, অর্থাৎ ছাত্র-শিক্ষক উভয়ের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে মৌলিক ধারণা তৈরি করা। এই প্রজন্মের হাতে থাকবে ট্যাব বা স্মার্টফোন নয়, বরং এক বিশাল ডিজিটাল বুদ্ধিমত্তা, যা সঠিকভাবে ব্যবহার না করতে পারলে তা আশীর্বাদ নয়, অভিশাপ হয়ে উঠতে পারে।
এ ছাড়া আমাদের শিক্ষানীতিতে প্রযুক্তির সঙ্গে নৈতিকতার ভারসাম্যও রাখতে হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেমন দ্রুত তথ্য বিশ্লেষণ করতে পারে, তেমনি তা ব্যবহার করে অন্যের লেখা কপি করাও সহজ। ফলে ভবিষ্যতের শিক্ষা শুধু ‘বুদ্ধিমত্তার’ নয়, বরং ‘নৈতিক বোধের’ পরীক্ষাও। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যদি এই বোধ তৈরি করতে না পারে, তবে আমরা শুধু প্রযুক্তিবান্ধব প্রজন্ম তৈরি করব, মানুষ নয়। অতএব, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে শিক্ষা ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আমাদের সিদ্ধান্তের ওপর, আমরা কি মানুষকে যন্ত্রের মতো গড়ে তুলব, না যন্ত্রকে মানবিক জ্ঞানের সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করব। এই প্রশ্নের উত্তরই আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। এখনই সময়, এআই -কে ভয় না পেয়ে, সেটিকে মানবিকতার সেবায় নিয়োজিত করার। শিক্ষা সেই আলো, যা মানুষকে মানুষ করে। এই এআই-নির্ভর পৃথিবীতে সেই আলোর দিশাই এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, যাতে প্রযুক্তি নয়, মানুষই থাকে শিক্ষার কেন্দ্রে। কারণ, শিক্ষা যদি মনুষ্যত্ব হারায়, তবে অ্যালগরিদম যতই উন্নত হোক না কেন, ভবিষ্যৎ হবে অন্ধকার।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন