আমরা সহজভাবে যা জানি তা হচ্ছে জনগণের শাসন বা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসনব্যবস্থাই হচ্ছে গণতন্ত্র। রাষ্ট্রের এমন একটি শাসনব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে নীতিনির্ধারণ বা সরকারি প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিক বা সদস্যের সমান ভোটাধিকার থাকে। উবসড়পৎধপু শব্দটি দুটি গ্রিক শব্দ উবসড়ং এবং কৎধঃরধ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। উবসড়ং শব্দের অর্থ হলো ‘জনগণ’ এবং কৎধঃরধ শব্দের অর্থ হলো ‘শাসন’। গণতন্ত্র আইন প্রস্তাবনা, প্রণয়ন ও তৈরির ক্ষেত্রে সব নাগরিকের অংশগ্রহণের সমান সুযোগ রয়েছে। পুস্তকি গণতন্ত্রের সঙ্গে আমাদের বাস্তবতার কোনো মিল নেই। তাই নির্দ্বিধায় বলতে পারি এদেশ গণতান্ত্রিক কাটামোয় আবৃত কোনো দেশ নয় বা কখনো ছিল না। আইন আছে, প্রয়োগ নেই। তাই গণতন্ত্র আমাদের থেকে বহুদূরে সরে যাচ্ছে বা আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি দিনকে দিন। সময় খুবই স্বল্প, তাই দ্রুতগতির এই গণতন্ত্রকে আমরা ধরতে পারছি না। সময়ের এই সাহসী পদক্ষেপকে কাজে লাগাতে পারে একমাত্র তারুণ্যের জাগরণ। এটাই রেনেঁসাস। বাংলার রেনেসাঁসরা সুপ্ত কিন্তু তেজদ্বীপ্ত। এর জাগরণকে রুখে দিতে পারে এমন কোনো শক্তি বা বাধা নেই। রেনেসাঁসের আলোয় আলোকিত হোক এই সোনার বাংলা.. আমাদের বাংলাদেশ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা সাধারণ জনগণ কোন অবস্থানের মধ্যে আছি? গণতন্ত্র...(!)? নাকি স্বেচ্ছাচারিতা..(!)? আমরা নিজেরাও তা জানি না। তার প্রধান কারণ আমরা অল্প শিক্ষায় শিক্ষিত এক জাতি। এদেশে শিক্ষার হার বেড়েছে সত্য কিন্তু মান বাড়েনি। শিক্ষাকে ধারণ করতে হয় অন্তরে আর বিকশিত করতে হয় সর্বস্তরে। যার আলোয় আলোকিত হয় ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ তথা দেশ। সমাজের অবক্ষয়কে দূর করাই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। আমাদের সমাজের বাস্তবতা আজ কোথায়..? যত্রতত্র এক মানুষ আরেক মানুষকে পিটিয়ে মারছে কিংবা পাথর নিক্ষেপ করে একজন আরেক জনকে মেরে ফেলছে নির্দ্বিধায়? এটা কেমন বিচার? এরা কোন মানুষ? জানোয়ারের সঙ্গেও তুলনা করা যায় না। এখন সম্পূর্ণরূপে বলতে পারি, বিকৃত মানসিকতার প্রতিফলন প্রতীকী রূপে বহমান এই সমাজ। এই চলমান ব্যবস্থাপনার জন্য কে দায়ী?
শুধু এতেই ক্ষান্ত নয়! আরও নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে এই মানুষ বা সেই মানুষ, যে তার নিজস্ব সৃষ্টির অবস্থানকে নিয়ে যাচ্ছে নি¤œস্তরের কীটের কাছাকাছি বা তার চেয়েও নগণ্য। জীবন্ত গরুর জিহ্বা কেটে নিয়ে যাচ্ছে এই অমানুষরা। সমাজের অলিতে-গলিতে এই বর্বরতা, এটা কিসের আলামত! বিড়ালের চোখ উপড়ে ফেলছে। কী নির্মম..! ভয়াল নিষ্ঠুরতা। মানুষ এখন রূপমাত্র মানুষ। মুখোশের অন্তরালে অন্য অচেনা অমানুষ। নিষ্পাপ এই গৃহপালিত প্রাণীগুলো কেন নির্যাতিত হচ্ছে..? গাভীটি গর্ভবতীÑ তার প্রচুর খাবার প্রয়োজন অথচ খেতে পারছে নাÑ নির্মমতার স্বীকার; অপরদিকে বিড়ালের বাচ্চাগুলো মাতৃদুগ্ধের অপেক্ষায় ঘুর ঘুর করছে চারিপাশেÑ কিন্তু কষ্টে যন্ত্রণায় মা বিড়ালটি হাও-মাও করছেÑ কোন অভিযোগ ছাড়ায়। হায় মানুষ..! এই অমানুষ হয়ে তুমি খোঁজ গণতন্ত্র?
মানুষ নিছক একটি শব্দ। যার মধ্যে লুকিয়ে আছে হাজারো রূপ, চরিত্র ও আচরণের গল্প। প্রকৃত মানুষ হয় সহানুভূতিশীল, নিঃস্বার্থ, ত্যাগী, সত্যনিষ্ঠ ও ন্যায়পরায়ণ। অপরদিকে স্বার্থান্বেষী মানুষ হয় নিষ্ঠুর, হিং¯্রতা, চরিত্রহীন ও মুখোশের আড়ালে অন্য মানুষ। এই পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিনতম কাজ হলো প্রকৃত মানুষকে চেনা। এখনো প্রকৃত মানুষগুলো এই সমাজে বিরাজমান; কিন্তু সংখ্যায় খুবই কমÑ তারা আমাদের অগ্রজ, বাস্তবতা শেখায় নিঃস্বার্থভাবেÑ আমরা তাদের কাছে ঋণী ও কৃতজ্ঞ। তবে যারা মুখের হাসির আড়ালে লুকিয়ে রাখে হিং¯্রতা, নিষ্ঠুরতা কেবল সেই মানুষ চিনতে সময় লাগেÑ তারা সমাজের নিকৃষ্টতম মানুষ। তারা রূপে মানুষ মাত্র কিন্তু অন্তরের অন্তরীক্ষেÑ নচ্ছার, পাষান্ড, বর্বর জানোয়ারের দল। মানুষকে জানতে মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির একটি মূল্যবান উক্তিÑ ‘তুমি আমাকে যতই পড় না কেন, চিনতে পারবে না, কারণ আমি আমার বাইরের চেহারার চেয়ে শতভাগ আলাদা। আমার চোখ দিয়ে আমাকে দেখ, আমি এমন এক জায়গায় বাস করি, যা তুমি দেখতে পাও না।’
এখন ব্যক্তি-স্বাধীনতা ক্ষীণ প্রায়। ফ্যাসিস্ট আর বর্তমান সময়ের মধ্যে খুব একটা তফাৎ খুঁজে পাচ্ছি না। একই গল্প ভিন্ন প্ল্যাটফরমে সাজানো। পরিবর্তন শুধু প্রেক্ষাপট আর ব্যক্তি সত্তার। আমি যখন এদেশের নাগরিক, তখন আমার একটাই পরিচয় আমি বংলাদেশি। এখানে ধর্ম, সংস্কৃতি, দল-মত নির্বিশেষে আমি এদেশেরই সন্তান। আমার সেই স্বাধীনতা থাকতে হবে, শুধু থাকতে হবে না দিতে হবে। অন্যের স্বাধীনতাকে হস্তক্ষেপ না করে নিজেকে যেভাবে স্বাধীন রাখা যায়; আমি সেই স্বাধীনতাকেই বুঝিয়েছি। সংস্কার নামের প্রহসনে আমরা কতদূর এগুতে পারছি বা পারব। এখানে বৈষম্যটাই যেন প্রতিস্থাপিত হচ্ছে, আন্দোলন তবে কিসের? সংস্কারের না-কি বৈষম্য বিরোধী (!)?
সাদা পাথরের নামে কালো বিড়ালের দৌরাত্ম্য। যারা মানুষ গড়ার কারিগর আজ কতিপয় তাদের বিরুদ্ধেই আগ্রাসনের প্রমাণ প্রস্ফুটিত হয়, কেন? আমরা কি তবে শিক্ষাটাকেও ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছি। কি বাকি থাকল, কোন আশ্রয়ে তবে দেশের শান্তি আসবে? কেউ কি জানে! বোধের শরীরে এখন পচন ধরেছে। একটি দুর্বিষহ সময় পার করে চলছি। ফ্যাসিস্টদের হটিয়ে মানুষ একটু স্বস্তির মুখ দেখেছিলÑ তার নিজের আয়নায়। সেটাও নেই, মানবতা কোথায়..? এখন রক্ষকরাই ভক্ষকের আয়না। আইনের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ নেই, যেন মৌলবাদের, ফ্যাসিস্টদের অভয়ারণ্য এই শ্যামল বাংলা। নতুন ফ্যাসিস্টদের আবির্ভাবÑ এভাবে চলতে পারে না দেশ।
ঝঃবঢ়যবহ জ. ঈড়াবু রচিত ‘ঞযব ৭ ঐধনরঃং ড়ভ ঐরমযষু ঊভভবপঃরাব চবড়ঢ়ষব’ এই বইটি অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান; চলমান সময়ের প্রেক্ষাপটে মূল্যবান এই উক্তিটি তুলে ধরা হলোÑ
‘সাফল্যের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন গন্তব্য সম্পর্কে জানা এবং সেখানে পৌঁছানোর নিয়ম জানা। এর পরবর্তী স্তরে প্রয়োজন গন্তব্য-পথের মানচিত্র। অর্থাৎ পথ জানার চেয়ে লক্ষ্য জানা বেশি প্রয়োজন।
কেবল শ্রম দেওয়ার ওপর কোনো কাজের সাফল্য নির্ভর করে না, বরং ব্যয়িত শ্রম সঠিক ক্ষেত্রে ব্যয় করা হচ্ছে কি-না তার ওপর কাজের সাফল্য বা ব্যর্থতা নির্ভর করে। প্রায় প্রতিটি পেশার ক্ষেত্রে বা শিল্পের ক্ষেত্রে পরিবর্তনের জন্য প্রথম প্রয়োজন নেতৃত্ব। পরবর্তী প্রয়োজন ব্যবস্থাপনা। ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বাজারের পরিবর্তন ঘটছে। ফলে অনেক উৎপন্ন দ্রব্য বা সেবা যা কয়েক বছর আগেও ক্রেতার চাহিদা পূরণে সফল হতো তা আজ অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। তাই ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে অবিরাম পরিবেশগত পরিবর্তন এবং ক্রেতার মনোভাব ও ক্রয় অভ্যাস পর্যবেক্ষণ করার জন্য অবশ্যই শক্তিশালী প্রো-অ্যাকটিভ নেতৃত্ব প্রয়োজন। নেতৃত্বই ব্যবসাকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য শক্তি সংগঠিত করবে।’
শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্য-এই তিন... যতদিন ব্যবসা মুক্ত না হচ্ছে, ততদিন সুস্থ সমাজ ব্যবস্থার স্বরূপ খুঁজে পাওয়া যাবে না। একটি জাতি গঠনে মূল চালিকাশক্তি নির্ভর করে এই তিনটি খাতের ওপর। সমাজের অবকাঠামোর দায়িত্বে যারা আছেন আজ তারা হাত গুটিয়ে নীরবতা পালন করছেন। সমাজে অবক্ষয়ের এটা আরেক সূত্রপাত। এরা দায়িত্ব নিতে চায় না, নিলেও এদের মানতে চায় না কেউ। আমরা নতুনকে গ্রহণ করতে পারি নাÑ এটা আমাদেরই দোষ। দরিদ্রতা আমাদের উপরে উঠতে দেয় নাÑ ঠেলে নামিয়ে আনে দর্শক সারিতে। তাই তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারি না এই মুহূর্তে। একজন সঠিক দিক নির্দেশক খুব বেশি প্রয়োজন এই সমাজের জন্যে, এই দেশের জন্যে। শুধু সময় অতিবাহিত হচ্ছে, কোনো কাজ হচ্ছে না। নিত্যদিনের বাজার এখন নিয়ন্ত্রণহীনÑ সাধারণরা জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। আমরা ভালোকে ভালো বলতে, ন্যায়কে ন্যায়, আর অন্যায়কে অন্যায় বলতে শিখিনি বলেইÑ যত্রতত্র নির্যাতিত-নিপীড়িত।
আলাউল কবীর
কবি ও কথাসাহিত্যিক

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন