শনিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


জুয়েল হাসান, প্রকৌশলী সাংবাদিক এবং কলাম লেখক

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৯, ২০২৫, ০৪:৫৭ এএম

যুবসমাজের হতাশা না সম্ভাবনা, দেশ কোন দিকে এগোচ্ছে?

জুয়েল হাসান, প্রকৌশলী সাংবাদিক এবং কলাম লেখক

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৯, ২০২৫, ০৪:৫৭ এএম

যুবসমাজের হতাশা না সম্ভাবনা, দেশ কোন দিকে এগোচ্ছে?

শরতের ভোরে হেমন্তের আভাস যেমন অদৃশ্য মায়ার পর্দা হয়ে আকাশজুড়ে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক তেমনই আমাদের দেশের বর্তমান সময়টিও যেন এক অনন্ত রূপান্তরের দোরগোড়ায় নীরবে অপেক্ষা করছে। দূরের নদীর নরম ঢেউ, বাতাসে দুলে ওঠা কাশফুলের নিঃশব্দ সংগীত, মাঠভরা হলুদ সরিষার ফুলের স্বর্ণালি আলো, আর গ্রাম-শহরের শীতল সকালের কুয়াশাÑ সবকিছুর ভেতরেই যেন এক অদ্ভুত নীরব প্রতীক্ষা, এক অস্পষ্ট অস্থিরতার দীর্ঘশ্বাস। এই অপেক্ষা কিসের? এই অস্থিরতা কোন ভবিষ্যতের ইঙ্গিত? সমাজজুড়ে যে অদৃশ্য প্রশ্নচিহ্নটি ভেসে বেড়াচ্ছে, তা আজ সবচেয়ে বেশি তীব্র হয়ে ওঠে যখন আমরা যুবসমাজের চোখের দিকে তাকাই, যেন তারা-ই দেশের সময়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নীরব সত্য, অব্যক্ত সম্ভাবনার আলো আর লুকানো উদ্বেগের প্রতিচ্ছবি।

যে তরুণরা একদিন স্বাধীনতার অগ্নিগর্ভ সময়ে রাইফেলের মতো সাহস বুকপকেটে নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল, যারা নব্বইয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে স্লোগানকে অস্ত্র বানিয়েছিল, সেই ধারাবাহিকতার বর্তমান উত্তরাধিকারীরা আজ এক অদ্ভুত সংকটের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। এ সময় তাদের সম্ভাবনার, আবার এই সময়ই তাদের হতাশার। তাই প্রশ্নটা আজ বড়, দেশ আসলে কোন দিকে এগোচ্ছে?

বইয়ের পাতা উল্টালে আমরা দেখি প্রতিটি জাতির ইতিহাসে এমন সময় আসে যখন তরুণরা এগিয়ে আসে সমাজের পথ দেখাতে। তারা হয় পরিবর্তনের স্থপতি, রাষ্ট্রের নাবিক, জাতির অভিভাবক। আবার ইতিহাস আমাদের এটিও শেখায়, যখন রাষ্ট্রে অনিশ্চয়তা, রাজনীতিতে অসামঞ্জস্য, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, মূল্যস্ফীতির চাপ এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্ক তৈরি হয়, তখন সবচেয়ে বেশি দিশাহারা হয় এই তরুণরাই। কারণ তারাই সবচেয়ে বেশি স্বপ্ন দেখতে জানে, আর স্বপ্ন ভাঙার বেদনাটাও তারাই সবচেয়ে বেশি অনুভব করে।

কিন্তু একই সময়ে আমরা এমন এক বিষয়ও দেখি, বাংলাদেশের তরুণরা বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় বেশি অভিযোজনক্ষম, বেশি পরিশ্রমী, এবং অসাধারণভাবে সৃজনশীল। স্টার্টআপ, ফ্রিল্যান্সিং, অ্যাপ-ডেভেলপমেন্ট, অনলাইন সার্ভিস কিংবা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তরুণ প্রজন্মের এক বিশাল অংশ আজ নিজের পথ নিজেই খুঁজে নিচ্ছে। তাদের হাতে আছে প্রযুক্তিগত দক্ষতা, আছে সাহস, আছে পরিশ্রম করার মানসিকতা। তাই আমরা যখন হতাশার অন্ধকার দেখি, তখন একই সঙ্গে সম্ভাবনার একটি উজ্জ্বল রেখাও দেখতে পাই। এই দুই বিপরীত শক্তির টানাপোড়েনই আজকের বাংলাদেশি যুবসমাজকে এক জটিল দ্বিধার সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। তারা স্বপ্ন দেখে, কিন্তু বাস্তবের মাটিতে হাঁটতে গিয়ে তারা হোঁচট খায়। তারা ভবিষ্যতের আলো চোখে ভাসায়Ñ কিন্তু বর্তমানের দুশ্চিন্তা তাদের সেই আলোকে বারবার ঢেকে দেয়।

এটি শুধু পর্যবেক্ষণ নয়, এটি একটি আত্মজিজ্ঞাসা, আমাদের সময়কে আমরা কীভাবে দেখি, আর আমাদের তরুণ প্রজন্মকে আমরা কোন পথে চালিত করতে চাই। হতাশার ঘন মেঘ সরিয়ে তাদের জন্য কি আমরা নতুন সম্ভাবনার আকাশ তৈরি করতে পারব? নাকি সময়ের চাপ আমাদের সবাইকে কোনো অজানা অন্ধকারে ঠেলে দেবে?

বাংলাদেশের বর্তমান সমাজ-অর্থনীতি ও রাজনীতির যে রূপান্তরকালীন মুহূর্ত আমরা অতিক্রম করছি, তা যুবসমাজের মানসিক অবস্থানকে সবচেয়ে গভীরভাবে নাড়া দিচ্ছে। কারণ, তরুণদের জীবনই হলো আশা ও বাস্তবতার মাঝখানের সেতুবন্ধন। তাদের বুকে থাকে স্বপ্নের আলো, কিন্তু পায়ের তলায় থাকে বাস্তবতার কাঁটা, এই দুইয়ের টানাপোড়েনই নির্ধারণ করে তারা হতাশায় ডুবে যাবে, নাকি সম্ভাবনার দিগন্ত গড়ে তুলবে।

আজকের তরুণদের সামনে সবচেয়ে বড় যে সংকটটি দাঁড়িয়ে আছে, তা হলো ভবিষ্যতের পূর্বানুমানহীনতা। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক চাপ, দেশের অভ্যন্তরে মূল্যস্ফীতি, চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা, সবকিছু মিলিয়ে চাকরিপ্রত্যাশী একটি বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠী প্রতিদিন নতুন করে মানসিক চাপের সম্মুখীন হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে বের হওয়া তরুণেরা চাকরি না পেয়ে যখন দীর্ঘদিন বেকার থাকে, তখন তাদের ভেতরে জন্ম নেয় অযোগ্যতার বোধ, সৃষ্টি হয় আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি। এটি শুধু একজন তরুণের ব্যক্তিগত সমস্যা নয় এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যতেরও সমস্যা।

অন্যদিকে, রাষ্ট্রের নীতি-সংস্কৃতি ও প্রশাসনিক কাঠামোও তরুণদের সম্ভাবনা বিকাশে যথেষ্ট হাত বাড়িয়ে দিতে পারছে না, এটিও বাস্তবতা। নীতিনির্ধারকদের একটি অংশ এখনো তরুণদের পরিবর্তনধর্মী চিন্তাকে ঝুঁকিপূর্ণ ভেবে সেভাবে জায়গা করে দিচ্ছে না। ফলে তরুণদের সৃজনশীলতা, উদ্যোগ, নতুন কিছু করার ক্ষমতা অনেক সময় ধরে রয়ে যাচ্ছে অবমূল্যায়িত।

কিন্তু এমন সংকটের মাঝেও আমরা অসংখ্য উদাহরণ দেখি, যেখানে তরুণেরা প্রথাগত চিন্তার বাইরে এসে নতুন পথ তৈরি করে নিয়েছে। দেশের বাইরে ফ্রিল্যান্স মার্কেটে বাংলাদেশের তরুণেরা আজ একটি শক্তিশালী অবস্থানে। তথ্যপ্রযুক্তি খাত, স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম, ইউটিউব কনটেন্ট ক্রিয়েশন, কুরিয়ার-ডেলিভারি, ই-কমার্স, লোকাল উদ্যোক্তা, সবক্ষেত্রেই তরুণরা যেমন নতুন নতুন কাজ করছে, তেমনি দেখাচ্ছে অসাধারণ অভিযোজন ক্ষমতা। এখানেই উঠে আসে মূল প্রশ্ন-যুবসমাজ কি হতাশার দিকে প্রবাহিত হচ্ছে, নাকি সম্ভাবনার দিকে? এর উত্তর একরৈখিক নয়। কারণ এই দুই শক্তি একইসঙ্গে কাজ করছে।

তরুণদের হতাশার কারণগুলো :

চাকরির সুযোগের সংকট, অসামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা, নীতি-নির্ধারণে তরুণদের অংশগ্রহণ সীমিত, রাজনৈতিক অস্থিরতার আতঙ্ক, সামাজিক প্রত্যাশার চাপ, আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা, অন্যদিকে সম্ভাবনার দিকগুলো : তথ্যপ্রযুক্তিতে দ্রুত শেখার ক্ষমতা, নতুন উদ্যোক্তা তৈরির প্রবণতা, বৈশ্বিক বাজারে দ্রুত সংযুক্ত হওয়ার দক্ষতা, সৃজনশীল ভাবনা ও পরীক্ষামূলক কাজ, নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরির সুযোগ, এই দুই বিপরীত বাস্তবতা মিলেই তরুণদের জীবনকে আজ একটি সন্ধিক্ষণে এনে দাঁড় করিয়েছে। তারা চাইলে এ সময়কেই সুযোগে রূপান্তর করতে পারে; আবার রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কাঠামো যদি দিশা না দেখায়, তারা আরও গভীর হতাশায় তলিয়ে যেতে পারে।

সমাজের প্রতিটি পরিবর্তনই শুরু হয় তরুণদের হাত ধরে, ইতিহাসের প্রতিটি বাঁক ঘুরে-ফিরে আমাদের এই সত্যের কাছেই নিয়ে আসে। আজকের বাংলাদেশও সেই একই সত্যের সামনে দাঁড়িয়ে। যুবসমাজের চোখে-মুখে আশা যেমন প্রবাহিত হয়, তেমনি ভিড়ে থাকে অনিশ্চয়তার মেঘ। কিন্তু এটাই জীবনের অদম্য বৈপরীত্য, আলো আর অন্ধকার পাশাপাশি জন্ম নেয়। আমরা যদি গভীরভাবে দেখি, বুঝতে পারব যে আমাদের তরুণ প্রজন্ম ঠিক এই দুই স্রোতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে, একদিকে উদ্বেগ, অন্যদিকে অপার সম্ভাবনার দরজা।

তবু প্রশ্ন থাকে, এ সম্ভাবনাকে আমরা কতটা কাজে লাগাতে পারছি? দেশের প্রতিটি নীতি, প্রতিটি সিদ্ধান্ত, প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পে যদি যুবসমাজকে কেন্দ্র করে পরিকল্পনা না করা হয়, তবে সেই উন্নয়ন কেবল পরিসংখ্যানেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কারণ ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গড়ে উঠবে সেই হাতেই, যে হাত এখনো স্বপ্ন নিয়ে পথ খুঁজছে। আর সেই হাত যদি বারবার বাধার দেয়ালে ধাক্কা খায়, তবে সম্ভাবনার সিঁড়ি কখনোই নির্মাণ হবে না। তরুণরা হতাশ হবে কি সম্ভাবনার দিকে এগোবে, উত্তর নির্ভর করছে মূলত তিনটি স্তম্ভের ওপর:

যুবসমাজের সামনে আজ যে সংকট, তা কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন একটি জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে তরুণদের দেখা হবে দেশের চালিকাশক্তি হিসেবে, বোঝা হিসেবে নয়। প্রয়োজন হবে গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব, উন্নত শিক্ষা, নতুন কর্মসংস্থান, এবং সর্বোপরি একটি মুক্ত পরিবেশ, যেখানে তারা নিজেদের মতো করে বেড়ে উঠতে পারে। শেষ পর্যন্ত সত্যটিই হলো-তরুণরা কখনোই কেবল হতাশার প্রতীক নয়; তারা সম্ভাবনার ভান্ডার। তাদের চোখের ভেতর লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের বাংলাদেশÑ স্বপ্নময়, শক্তিশালী, আত্মনির্ভর। তাই আজকের সিদ্ধান্ত আগামী দিনের ইতিহাস গড়ে দেবে। আমরা যদি এখনই তাদের জন্য পথ খুলি, তবে আগামী বাংলাদেশ হবে আরও উজ্জ্বল, আরও দৃঢ়, আরও মানবিক। সময়ের এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তাই আমাদের বলা উচিত, তরুণদের পাশে দাঁড়াও, ভবিষ্যৎকে আলিঙ্গন কর।

                                                                                                                          

 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!