রাজধানীর বাজারে মাত্র দুদিনের ব্যবধানে পেঁয়াজ কেজিতে ৪০-৫০ টাকা বেড়েছে। এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতি কোনোভাবেই স্বাভাবিক বাজারচক্রের ব্যাখ্যায় পড়ে না। ঢাকার খুচরা বাজারে এখন প্রতি কেজি পেঁয়াজ ১৪০-১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাইকারিতে পাল্লাপ্রতি দাম ৬৫০-৬৮০ টাকায় পৌঁছেছে। এ অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে সাধারণ ভোক্তার ন্যূনতম জীবনযাত্রার ব্যয়ও মারাত্মক চাপে পড়ছে। পেঁয়াজের ঝাজে নয়, দামেই চোখে জল ঝড়ছে সাধারণ ভোক্তাদের। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, পেঁয়াজ কি রাতারাতি দুর্লভ হয়ে গেল, নাকি বাজার নিয়ন্ত্রণে চিহ্নিত চক্র আবার সক্রিয় হলো?
বিক্রেতাদের বক্তব্যেও কোনো অস্বাভাবিকতার ইঙ্গিত নেই। দুদিন আগেও পাইকারিতে যে পেঁয়াজ ১০০ টাকা কেজি ছিল, তা হঠাৎ বেড়ে ১৩৫-১৪০ টাকায় পৌঁছে গেল কীভাবে? একইভাবে বস্তাপ্রতি ৮৫০-১০০০ টাকা পর্যন্ত দাম বৃদ্ধি কোনোভাবেই উৎপাদন, পরিবহন বা আমদানির খরচের যৌক্তিক ব্যাখ্যার সঙ্গে মেলে না। আগাম জাতের ‘মুড়িকাটা’ পেঁয়াজ বাজারে আসা শুরু হয়েছে, স্বাভাবিক নিয়মে যার কারণে দাম কমার কথা ছিল। কিন্তু সরবরাহ সীমিত রেখে সেই পেঁয়াজের দামও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে স্পষ্ট যে বাজারে এক ধরনের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে।
এই অনিয়ন্ত্রিত মূল্যবৃদ্ধির প্রধান কারণ, কার্যকর বাজার তদারকির অভাব। ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো দাম নির্ধারণ করছেন, আর সরকারি নজরদারি প্রায় অকার্যকর অবস্থায় আছে। ফলে ক্রেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করলেও তাদের সেই ক্ষোভের প্রতিফলন বাজারে পড়ছে না। বরং সুযোগসন্ধানী একটি অংশ এই বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিচ্ছে।
যদিও সরকার সীমিত আকারে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিয়েছে। প্রতিদিন ৫০টি আইপি এবং প্রতিটিতে ৩০ টন করে পেঁয়াজ আমদানি করা হবে। এ খবর নিশ্চয়ই বাজারে কিছুটা স্বস্তি আনতে পারে, স্বস্তি এনেছেও। ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির খবরেই দিনাজপুরের হিলিতে কমেছে দেশি পেঁয়াজের দাম। দেশি মুড়ি কাটা পেঁয়াজ কেজি প্রতি ১০ টাকা কমে ১০০ টাকা এবং দেশি শুকনো মানের পেঁয়াজ কেজি প্রতি ২০ টাকা কমে ১১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এই স্বস্তি কতটা স্থায়ী? অতীত ইতিহাস বলে, দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ার পর আমদানির দরজা খুলে দিলে তা কেবল বাজার-চক্রের পেছনে দৌড়ানোই হবে। এর কোনো টেকসই প্রভাব নিশ্চিত হয় না। তদুপরি, আমদানির এ অনুমতি যেন আবার নতুন কোনো প্রভাবশালী গোষ্ঠীর হাতে বাজার নিয়ন্ত্রণের সুযোগ না তৈরি করে, তা নিশ্চিত করা জরুরি।
পেঁয়াজের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ শুধু আমদানি বাড়ানোয় সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। উৎপাদন-সংরক্ষণ-বিপণনের একটি সমন্বিত কাঠামো সরকারকে কার্যকর করতে হবে। বিশেষত খুচরা বাজারে তদারকি জোরদার করা, দাম-তালিকা কঠোরভাবে মানা নিশ্চিত করা এবং মজুতদারি ও কারসাজির বিরুদ্ধে উদাহরণযোগ্য ব্যবস্থা নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
ভোক্তা সাধারণ বছরের পর বছর একই দৃশ্য দেখে ক্লান্ত। পণ্য সংকট দেখেই হঠাৎ দাম বাড়ে, পরে সামান্য কমলেও তা কখনোই আগের অবস্থায় ফেরে না। এ চক্র ভাঙতে হলে বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে এবং নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিকে ‘স্বাভাবিক’ ঘটনার মতো দেখতে শেখা বন্ধ করতে হবে।
আমরা মনে করি, পেঁয়াজের অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে অতিরিক্ত চাপের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। বাজারে অরাজকতা রোধে এখনই কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। প্রশাসনকে শক্ত হাতে বাজার মনিটরিং করতে হবে, কারসাজি বন্ধ করতে হবে, এবং আমদানির প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও দ্রুত করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
নিত্যপণ্যের দাম হাতের নাগাল থেকে বেরিয়ে গেলে সাধারণ মানুষ বিপাকে পড়ে। তাই স্থিতিশীল বাজার আর ন্যায়সঙ্গত বাণিজ্য রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব। এখনই কঠোর পদক্ষেপ না নিলে অস্থিতিশীলতা আরও বাড়বে, আর তার পুরো চাপ পড়বে সাধারণ মানুষের রান্নাঘরেই।

