২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশের ক্লাসরুম কেমন হবে? চোখ বন্ধ করে ভাবলে হয়তো ভেসে ওঠে সায়েন্স ফিকশন সিনেমার দৃশ্য। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সেই ভবিষ্যৎ কোনো সুদূর কাল্পনিক দৃশ্যপটে আটকে নেই; তা এখনই, এই ২০২৫-এর শেষলগ্নে দাঁড়িয়ে আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। কুড়িগ্রামের চরের যে ছেলেটি আজ ভাঙা টিনের চালের নিচে বসে অঙ্ক কষতে হিমশিম খাচ্ছে, আর ঢাকার গুলশানের যে মেয়েটি তার আইপ্যাডে জটিল কোডিং শিখছে, এই দুই মেরুর ব্যবধান ঘুচিয়ে দেওয়ার মতো কোনো জাদুর কাঠি যদি পৃথিবীতে থেকে থাকে, তবে তার নাম ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ বা এআই। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখন এক বিশাল ‘প্যারাডাইম শিফট’ বা আমূল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো, আমরা কি কেবল স্রোতে গা ভাসাচ্ছি, নাকি এই বিশাল ডেটা-সুনামির মোকাবিলা করতে আমরা আসলেই প্রস্তুত?
বাংলাদেশের শিক্ষার প্রচলিত চিত্রটি আমাদের সবার চেনা, গাদাগাদি করে বসা ক্লাসরুম, জীর্ণ ব্ল্যাকবোর্ড, আর ৪০ থেকে ৬০ জন ছাত্রের জন্য মাত্র একজন শিক্ষক। বাংলাদেশ ব্যুরো অব এডুকেশনাল ইনফরমেশন অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিকস (ব্যানবেইস) তথ্যমতে, মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত এখনো ১:৩৮-এর ওপরে, যা মফস্বলে ১:৬০ ছাড়িয়ে যায়। একজন রক্তমাংসের শিক্ষকের পক্ষে কি প্রতিটি ছাত্রের মেধা, দুর্বলতা আর শেখার গতি বুঝে আলাদা যতœ নেওয়া সম্ভব? এখানেই এআই হয়ে উঠছে ‘গেম চেঞ্জার’। এটি কোনো সাধারণ প্রযুক্তি নয়, বরং এটি ক্লাসরুমের সেই ‘অদৃশ্য শিক্ষক’ যে কখনোই ক্লান্ত হয় না। এআই-এর মূল শক্তি হলো ‘হাইপার-পার্সোনালাইজেশন’। একটি ক্লাসে যদি ৫০ জন ছাত্র থাকে, এআই ৫০টি ভিন্ন ভিন্ন কারিকুলাম বা শেখার পদ্ধতি তৈরি করতে সক্ষম। সাম্প্রতিক এডটেক ডেটা বলছে, বাংলাদেশে টেন মিনিট স্কুল, শিখো কিংবা বন্ডস্টাইনের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোতে এআই-চালিত অ্যাডাপটিভ লার্নিং ব্যবহারের ফলে শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক দুর্বলতা চিহ্নিত করার হার প্রায় ৬০ শতাংশ নির্ভুল হয়েছে। এটি এমন এক বিপ্লব, যা গত ১০০ বছরেও আমাদের শিক্ষা খাত দেখেনি।
তবে মুদ্রার উল্টো পিঠটাও আমাদের দেখতে হবে। এআই বিপ্লবের এই স্বপ্নযাত্রায় সবচেয়ে বড় কাঁটা হলো ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ বা প্রযুক্তিগত বৈষম্য। বিটিআরসির সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩ কোটির ঘর ছাড়ালেও, এর বড় একটি অংশ মূলত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী। শিক্ষার কাজে উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ গ্রামে এখনো নগণ্য। একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার আরবান এলাকায় যেখানে প্রায় ৭১ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর স্মার্ট ডিভাইস এবং এআই টুলের এক্সেস রয়েছে, সেখানে গ্রাম বা রিমোট এলাকায় এই হার মাত্র ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশের নিচে। অর্থাৎ, এআই যদি এখনই ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা হয়, তবে তা ধনী ও দরিদ্রের শিক্ষার ব্যবধানকে আকাশচুম্বী করে তুলতে পারে। আমরা কি এমন একটি সমাজ চাই যেখানে এআই কেবল বিত্তবানদের সন্তানকে ‘সুপার হিউম্যান’ বানাবে, আর সুবিধাবঞ্চিতরা আরও পিছিয়ে পড়বে?
শিক্ষকদের ভূমিকা এবং তাদের চাকরির নিরাপত্তা নিয়ে যে ভীতি কাজ করছে, তা অমূলক নয়, তবে অতিরঞ্জিত। ম্যাককিনসে গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বর্তমান প্রযুক্তিতে শিক্ষকদের ২০ থেকে ৪০ শতাংশ সময় ব্যয় হয় খাতা দেখা, রুটিন তৈরি করা বা হাজিরা নেওয়ার মতো ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ’ কাজে। এআই এই কাজগুলো নিমেষেই করে দিতে পারে। বাংলাদেশেও এর পরীক্ষামূলক ব্যবহার শুরু হয়েছে। যখন একজন শিক্ষকের ওপর থেকে এই বোঝা সরে যাবে, তখন তিনি মেন্টরশিপ, ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স এবং ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং শেখানোর দিকে নজর দিতে পারবেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের শিক্ষকদের কি সেই প্রশিক্ষণ আছে? প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের বড় একটি অংশের এখনো আইসিটি বা তথ্যপ্রযুক্তির বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ নেই। (ধ২র) প্ল্যাটফর্মে লক্ষাধিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ নিলেও, এআই-এর মতো জটিল টুল ক্লাসরুমে ব্যবহারের দক্ষতা অর্জন করতে আমাদের এখনো অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে চিত্রটি আরও নাটকীয়। বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (টএঈ) এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার জরিপে দেখা যাচ্ছে, গত দুই বছরে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে চ্যাটজিপিটি (ঈযধঃএচঞ), জেমিনাই (এবসরহর) বা ক্লড-এর মতো টুল ব্যবহারের প্রবণতা প্রায় ৫০০ শতাংশ বেড়েছে। এটি গবেষণার মান বাড়াচ্ছে নাকি প্লেজিয়ারিজম বা নকলের কারখানা তৈরি করছে, তা নিয়ে শিক্ষাবিদদের মধ্যে তুমুল বিতর্ক চলছে। তবে আশার কথা হলো, এআই গবেষণার ডেটা প্রসেসিংয়ের সময় কমিয়ে এনেছে প্রায় ৯০ শতাংশ। আগে যে লিটারেচার রিভিউ করতে একজন পিএইচডি গবেষকের মাসখানেক লাগত, এআই-এর সাহায্যে তা এখন কয়েক ঘণ্টায় সম্ভব। কিন্তু এখানেও বড় বাধা আমাদের ‘ভাষাগত সীমাবদ্ধতা’। ইন্টারনেটে থাকা এআই মডেলগুলোর অধিকাংশ ডেটাসেট ইংরেজি বা পশ্চিমা ভাষাভিত্তিক। বাংলা ভাষায় জেনারেটিভ এআই-এর কার্যকারিতা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। যদিও আইসিটি বিভাগের উদ্যোগে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ প্রকল্পে কাজ চলছে, তবুও ‘ লো-রিসোর্স ল্যাঙ্গুয়েজ’ হিসেবে বাংলায় এআই-এর পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার নিশ্চিত করা একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ।
অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এআই শিক্ষ খাতকে সাশ্রয়ী করতে পারে। ইউনেস্কোর গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট অনুযায়ী, মানসম্মত সায়েন্স ল্যাবরেটরি বা ল্যাব সেটআপ করতে যে কোটি কোটি টাকার অবকাঠামো প্রয়োজন, এআই এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ঠজ) তা নামমাত্র খরচে প্রতিটি শিক্ষার্থীর হাতে পৌঁছে দিতে পারে। স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়নে ২ শতাংশের আশপাশে আটকে থাকা বাজেট দিয়ে রাতারাতি অবকাঠামো বদলানো কঠিন। এখানেই এআই হতে পারে ‘কস্ট-এফেক্টিভ সলিউশন’। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ। লোডশেডিংয়ের কবলে থাকা একটি গ্রামের স্কুলে আপনি বিশ্বের সেরা এআই সফটওয়্যার দিলেও তা অকেজো। তাই এআই বাস্তবায়নের আগে আমাদের ‘বিদ্যুৎ ও কানেক্টিভিটি’র বুনিয়াদি সমস্যার সমাধান করতে হবে।
নৈতিকতা এবং ডেটা প্রাইভেসি বা তথ্যের সুরক্ষা, এই বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশে আলোচনা এখনো শৈশব পর্যায়ে। শিক্ষার্থীদের শেখার প্যাটার্ন, তাদের আচরণের তথ্য এবং ব্যক্তিগত ডেটা এআই সিস্টেমগুলোতে সংরক্ষিত হচ্ছে। এই বিশাল ‘বিগ ডেটা’ যদি কোনো থার্ড পার্টি বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে যায়, তবে তা জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হতে পারে। সম্প্রতি ইউনেস্কো এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত ‘এআই রেডিনেস অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট’-এ এই বিষয়টির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, আমাদের এখনো শিক্ষা খাতে এআই ব্যবহারের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট ‘লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক’ বা আইনি কাঠামো নেই। অ্যালগরিদম বায়াস বা পক্ষপাতদুষ্টতা আরেকটি বড় সমস্যা। পশ্চিমা ডেটায় প্রশিক্ষিত এআই যদি আমাদের শিক্ষার্থীদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ইতিহাস বা মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক তথ্য দেয়, তবে তা আমাদের সাংস্কৃতিক স্বকীয়তার জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
পরিশেষে, প্রশ্নটা এটা নয় যে এআই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে দখল করে নেবে কি না। প্রশ্ন হলো, আমরা এই পরিবর্তনকে কীভাবে আলিঙ্গন করব। এআই কোনো জাদুর প্রদীপ নয়, এটি একটি শক্তিশালী হাতুড়ি, যা দিয়ে আমরা নতুন কিছু গড়তে পারি অথবা নিজের পায়ে আঘাত করতে পারি। আমাদের প্রয়োজন একটি ‘হাইব্রিড মডেল’, যেখানে মানুষের আবেগ আর যন্ত্রের বুদ্ধিমত্তা হাত ধরাধরি করে চলবে। আমাদের সিলেবাস থেকে মুখস্থবিদ্যাকে ঝেটিয়ে বিদায় করে সেখানে ‘প্রম্পট ইঞ্জিনিয়ারিং’, ‘ডেটা লিটারেসি’ এবং ‘ইমোশনাল রেজিলিয়েন্স’ বা মানসিক সহনশীলতার মতো বিষয়গুলো যুক্ত করতে হবে। কারণ আগামী দিনের শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতাটা হবে ‘মানুষ বনাম এআই’ নয়, বরং ‘সাধারণ মানুষ বনাম এআই ব্যবহার জানা মানুষ’-এর মধ্যে। বাংলাদেশ যদি এই প্রযুক্তিগত ঢেউয়ের মাথায় চড়তে পারে, তবে আমাদের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশ সত্যিকার অর্থেই সম্পদে পরিণত হবে। আর যদি আমরা ব্যর্থ হই, তবে আমরা কেবল বিশ্বমানের কনজিউমার বা ভোক্তা হয়েই থাকব, ক্রিয়েটর বা উদ্ভাবক হতে পারব না। সিদ্ধান্ত এবং সময়, দুটোই এখন আমাদের হাতে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন