মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ, এটাই সভ্যতার মূলভিত্তি। রাজনৈতিক মতভেদ যত গভীরই হোক, বিপরীত মতের একজন নেতার অসুস্থতা বা সংকটময় অবস্থায় তার সুস্থতা কামনা করা একটি মৌলিক মানবিক মূল্যবোধ। ইতিহাস বলে, যে নেতৃত্ব উদারতা দেখায়, সে নেতৃত্বই মানুষের হৃদয়ে টিকে থাকে।
আমি বিশ্বাস করি, যদি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আর এক সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনার একটি মানবিক বার্তা প্রদান করা হয়, সাধারণ মানুষ তা অত্যন্ত ইতিবাচক ও সম্মানজনকভাবে গ্রহণ করবে। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে এটির বিশেষ গুরুত্ব থাকবে। কারণ, একসময় এরশাদের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এই দুই নেত্রী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম করেছেন। দুজনই ‘মাইনাস টু’ চাপের শিকার হয়েছিলেন। আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে তাদের দ্বন্দ্ব যেমন আছে, তেমনি আছে গণতন্ত্রের জন্য যৌথ লড়াইয়ের স্মৃতি। মনে আছে বেগম জিয়ার ছোট ছেলের মৃত্যুর পর তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনা বেগম জিয়াকে সমবেদনা জানাতে গিয়েছিলেন যদিও তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তিনি সাক্ষাৎ করতে পারেননি সন্তানের মৃত্যুতে শোকাহত মায়ের সঙ্গে। তারেক রহমানের বিবাহ উপলক্ষে অনুষ্ঠানেও তিনি গিয়েছিলেন। এরপর রাজনৈতিক দন্দ্ব বেড়েছে।
রাজনীতির স্বাভাবিকীকরণ, সহনশীলতা এগুলোই সুস্থ গণতন্ত্রের শক্তি।
বিশ্বের প্রতিটি পরিণত গণতন্ত্রেই ঢ়ড়ষরঃরপধষ পরারষরঃু বা রাজনৈতিক সৌজন্যকে অত্যন্ত উচ্চমর্যাদায় দেখা হয়।
এ প্রসঙ্গে একটি বড় দৃষ্টান্ত আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন থেকে আসে। ইতিহাসে বর্ণিত আছেÑ এক ইহুদি মহিলা, যিনি তার প্রতি শত্রুভাবাপন্ন ছিলেন এবং বারবার অপমান করতেন, তিনি অসুস্থ হলে রাসুল (সা.) নিজ হাতে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন। তিনি শুধু খোঁজখবরই নেননি, বরং করুণা, শুভাকাক্সক্ষা ও মানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। শত্রুতা নয়, মানবিকতাÑ এটাই ছিল তাঁর নেতৃত্বের শিক্ষা।
ম্যান্ডেলা তার চরম বিরোধীদের ( যারা তাকে দীর্ঘদিন কারাগারে আটক রেখেছেন) প্রতি সৌজন্য দেখিয়ে জাতিকে রক্ষা করেছিলেন।
* বাজপেয়ী ও সোনিয়া গান্ধী রাজনৈতিক কঠোর বিরোধিতার মধ্যেও সহনশীলতা বজায় রেখে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করেছিলেন।
* জাসিন্ডা আরডার্ন প্রতিপক্ষের সংকটে মানবিকতা দেখিয়ে নেতৃত্বের নৈতিক উচ্চতা প্রমাণ দেন।
এই শিক্ষা শুধু ধর্মীয় নয়Ñ এটা রাজনৈতিক নৈতিকতার সর্বোচ্চ আদর্শ। একজন নেতার মহত্ব প্রকাশ পায় তখনই, যখন তিনি প্রতিপক্ষের সংকটে সৌজন্যের হাত বাড়িয়ে দেন।
আজ বাংলাদেশ সেই সৌজন্যের তীব্র অভাব অনুভব করছে আমাদের সবারই ভুল আছে, কমবেশি। কিন্তু ভুলের ঊর্ধ্বে উঠে মানবিকতাকে প্রাধান্য দেওয়া একজন নেত্রীর মর্যাদাকেই আরও উঁচু করে। বিএনপি এ দেশের একটি বড় জনগোষ্ঠীর দলÑ তাদের নেত্রীর প্রতি প্রাথমিক মানবিক সম্মান দেখানো রাষ্ট্রনীতিরই অংশ। দেশে আওয়ামী লীগের অবস্থান নিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই তাদের জন্য এটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেউ আমাকে ভালো আচরণ করেনি বলে আমিও কি করবÑ এটা কি নেতৃত্বের মানসিকতা হতে পারে?
নেতৃত্ব মানেই উদারতা, বৃহত্তর স্বার্থে এগিয়ে যাওয়া সজীব জয় যখন নিজেই স্বীকার করেন যে খালেদা জিয়ার প্রতি ন্যায়বিচার হয়তো করা হয়নিÑ তখন আমার কি আর বলার আছে। আমরা কি চাই না বিবেকের স্বাধীনতা ফিরুক? আজ দেশের রাজনীতি এত বিভক্ত কেন? দেশ কি দলের চেয়ে ছোট হয়ে গেছে? দল কি নেতার চেয়ে বড় হতে পারছে না?
মানুষের জন্য রাজনীতি করার কথা ছিল। কিন্তু এখন রাজনীতি হচ্ছে শুধু নেতার জন্য বা দলের জন্য। সাধারণ কর্মী ও সমর্থকদের অন্ধ আনুগত্য ইতিহাসে কখনো স্থায়ী হয়নি। দাম্ভিকতার পতন অনিবার্য এ কথা ইতিহাসে বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। নেতৃত্বের মহত্ব এখানেই যে, সময়মতো নম্রতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যায়।
হাজার অভিযোগ একের বিরুদ্ধে অপরের আছে, থাকবে। রাজনীতিতে দীর্ঘ দিন সৌজন্যতা ও মানবিকতা এবং নেতৃত্বের পর্যায়ে পরস্পরের প্রতি সম্মান ও সহনশীলতার অভাব আজ সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে যার কারণে দেখতে পাচ্ছি অনেক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। এ পরিস্থিতির উন্নতির জন্য মানুষের মনমানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে সব নেতার দায়িত্ব রয়েছে।
সব অন্যায়ের বিচার কোনো না কোনোভাবে হবে। শেষ বিচার করবেন মহান সৃষ্টিকর্তা।
কিন্তু যখন একজন মানুষ জীবন-মৃত্যুর মধ্যবর্তী অবস্থায় তখন তাকে মানবিক মর্যাদা দেওয়াই সভ্য রাজনীতির পরিচয়। সেই মুহূর্তে অভিমান ধরে রাখা কেবল দুর্বলতার লক্ষণ।
আজ আমি যা লিখলামÑ অনেকে মনে মনে ভাবলেও সাহস করে বলবেন না। যদিও তারা মুখোমুখি বিতর্কে খুবই শক্তিশালী কথা বলতে পারেন, কিন্তু মানবিকতার ভাষা উচ্চারণ করার সাহস অনেকেরই কমে গেছে।
সুস্থতার জন্য একটি শুভকামনার বার্তা, মানবিক ও রাজনৈতিক সৌজন্যতার প্রকাশ করে। রাজনীতি নিয়ে চরম বিভক্ত মানুষের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিতে উজ্জীবিত করে পারে। তাই, এখনই সময় উদারতা দেখানোর। এটাই রাষ্ট্রনায়কের পরিচয়। এটাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সঠিক বার্তা।
ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেন, ইউকে ইমিগ্রেশন ও মানবাধিকার আইন বিশেষজ্ঞ
সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা

