ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনে যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা দেশের দীর্ঘদিনের শাসন ব্যবস্থার সংকটকে আবারও স্পষ্ট করেছে। নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের বক্তব্যে প্রতিফলিত হয়েছে, দুর্নীতি কেবল অব্যাহতই নয়, বরং তা ক্ষমতার অপব্যবহার, দখলবাজি, চাঁদাবাজি ও দলীয় প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে আরও গভীর শিকড় গাড়ছে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাত ও প্রশাসনিক কাঠামোর ভেতরে দুর্নীতির উপস্থিতি যে কতটা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা অস্বীকার করা আর সম্ভব নয়। দুর্নীতি আগের চেয়ে বেড়েছে না কমেছে, তা নিয়ে পরিসংখ্যানগত তুলনা না থাকলেও বাস্তবতা হলো, দুর্নীতি, দখল ও চাঁদাবাজি অব্যাহত আছে। ক্ষমতার অপব্যবহার, দলীয় একচ্ছত্রতা এবং প্রশাসনিক জবাবদিহির অভাব এ সমস্যাকে আরও গভীর করেছে।
গত ১৫ বছরে রাষ্ট্রের নানা খাত যেমন, ব্যবসা-বাণিজ্য, জমি ও সম্পদ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যাংক ব্যবস্থা সবখানেই দখলদারি ও অনিয়ম বিস্তৃত হয়েছে। রাজনীতির সঙ্গে পেশি, অর্থ আর প্রভাবের অশুভ সমীকরণ তৈরি হয়েছে। ক্ষমতার আশ্রয়ে থাকা এক শ্রেণির ব্যক্তি ও গোষ্ঠী কেবল অর্থনৈতিকভাবে নয়, রাষ্ট্রের সামগ্রিক কাঠামোতেও দখলদারি কায়েম করেছে। এ অবস্থার ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে রাষ্ট্র ও সমাজের ন্যায়-বিচারবোধ এবং নৈতিকতা হুমকির মুখে পড়েছে।
সুশাসিত, গণতান্ত্রিক ও দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র একদিনে গড়ে ওঠে না। ৫৪ বছরের নানা জটিলতা, বিশেষ করে দীর্ঘ একচ্ছত্র শাসনের অনিয়ম-জঞ্জাল কাটানো কঠিন প্রক্রিয়া। কিন্তু এখন একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, দেশ নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে, এবং জনগণ পরিবর্তনের আশা দেখছে। এ সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব আরও বড়।
আগামী নির্বাচনের ইশতেহারে দুর্নীতি প্রতিরোধকে প্রথম সারির অঙ্গীকার হিসাবে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা জরুরি। জুলাই সনদসহ বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন, অতীত মানবাধিকার লঙ্ঘন ও রাষ্ট্রীয় অপরাধের কার্যকর তদন্ত-বিচার, দলীয় কার্যক্রমে গণতন্ত্র ও স্বচ্ছতা, এসব প্রতিশ্রুতি কেবল কথায় সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। বাস্তবায়নে সঠিক রোডম্যাপ ও সময়সীমাসহ স্পষ্ট কর্মপরিকল্পনা থাকতে হবে।
ব্যবসা খাতে ‘রাষ্ট্রকাঠামো দখল’ রোধে আরও কঠোর নীতি প্রয়োজন। গত এক যুগে দেখা গেছে, একশ্রেণির ব্যবসায়ী রাজনৈতিক ক্ষমতার সুবিধা নিয়ে একচেটিয়া লাভের সুযোগ পেয়েছে, আর প্রতিযোগিতা ও স্বচ্ছতার স্বাভাবিক পরিবেশ ধ্বংস হয়েছে। ফলে অর্থনীতি বিকৃত হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উদ্যোক্তা সমাজের বড় একটি অংশ। ভবিষ্যতে যেন কোনো গোষ্ঠী রাষ্ট্রক্ষমতাকে পুঁজি করে একাধিপত্য কায়েম করতে না পারে এমন নিশ্চয়তা দিতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে।
একই সঙ্গে জবাবদিহিতা বঞ্চিত প্রশাসন, নিয়ন্ত্রণহীন দলীয় আধিপত্য এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রাজনৈতিক ব্যবহারের মতো সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সুস্পষ্ট সংস্কারমূলক অঙ্গীকার রাখতে হবে। দখল-চাঁদাবাজি বন্ধের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দায়বদ্ধতা ও স্বচ্ছতা বাড়ানো অপরিহার্য।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের ঘর থেকেই শুদ্ধাচার শুরু করতে হবে। যদি দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা ও আর্থিক জবাবদিহি না থাকে, তাহলে দুর্নীতি প্রতিরোধের প্রতিশ্রুতি হবে কেবল কাগুজে শব্দ।
মোটা দাগে বলতে গেলে, দুর্নীতি, দখল ও চাঁদাবাজি কেবল অর্থনৈতিকেই ধ্বংস করে না , এটি রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তিকেও দুর্বল করে দেয়। তাই শক্তিশালী রাজনৈতিক অঙ্গীকার, সুস্পষ্ট নীতি এবং দৃঢ় বাস্তবায়ন চিন্তা ছাড়া এ সমস্যার সমাধান হবে না। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সব রাজনৈতিক দলের উচিত সুশাসন ও দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র গঠনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া, কারণ জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার ও রাষ্ট্রের স্বাভাবিক গতিতে ফেরার এখনই সর্বোত্তম সময়।
আমরা মনে করি, বাংলাদেশের সামনে এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন। টিআইবি রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য যে ৫২টি প্রস্তাবনা তুলে ধরেছে এসব প্রস্তাবের প্রতি গুরুত্ব না দিলে আগামী দিনের শাসনব্যবস্থা আগের ভুলের পুনরাবৃত্তিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন