আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সারা দেশে ৪২ হাজার ৭৬১টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ১৭ হাজার ৫৫৬টি ভোটকেন্দ্র ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। সংখ্যাটি শুধু উদ্বেগজনকই নয়, বরং নির্বাচনি নিরাপত্তার জন্য এক কঠিন বাস্তবতাও ইঙ্গিত দেয়। দেশের অর্ধেক ভোটকেন্দ্রে সহিংসতার সম্ভাবনা থাকলে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করা নিঃসন্দেহে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এর ফলে ভোটারদের নিরাপত্তা, ভোটদানের পরিবেশ এবং নির্বাচনের বিশ্বস্ততা প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে।
ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র চিহ্নিত করতে পুলিশ যে মানদ-গুলো ব্যবহার করেছে, পূর্বের সহিংসতার রেকর্ড, ভোটার সংখ্যা, আধিপত্য বিস্তার, অবকাঠামো, এলাকা দুর্গমতা, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগব্যবস্থা তা নিঃসন্দেহে যৌক্তিক। ঝুঁকির কারণগুলো স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করতে পারা মানেই ঝুঁকি মোকাবিলার প্রস্তুতির পথটিও পরিষ্কার হওয়া। ইতোমধ্যে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে যে নিরাপত্তা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তা অবশ্যই আশাব্যঞ্জক। তবে তা যথাযথ বাস্তবায়নই নির্ধারণ করবে জনগণ নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবেন কি-না।
পুলিশের পক্ষ থেকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে বডিওর্ন ক্যামেরা, অস্ত্রসজ্জিত দল, বাড়তি আনসার সদস্য, স্ট্রাইকিং ফোর্স এবং দ্রুত সাড়া দেওয়ার ইউনিট মোতায়েনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। পাশাপাশি সেনাবাহিনী, বিজিবি, কোস্টগার্ডসহ বিভিন্ন বাহিনীকে সমন্বিতভাবে মাঠে রাখার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু শুধু বাহিনী মোতায়েন করলেই হবে না। প্রতিটি সদস্যের নিরপেক্ষতা, পেশাদারিত্ব এবং দায়িত্ব পালনের ওপর কঠোর নজর দিতে হবে। নির্বাচনের মাঠে কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতি পক্ষপাত বা রাজনৈতিক বিভাজনের ছাপ থাকলে জনগণের আস্থা ক্ষুণœ হবে, নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
নির্বাচনকালে বিদ্যুৎব্যবস্থার প্রস্তুতি বিশেষত গ্রামীণ ও দুর্গম অঞ্চলে বিকল্প আলোর ব্যবস্থা প্রশংসার দাবিদার। সন্ধ্যার পর ভোট গণনা নিরাপদে এবং স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন করতে জরুরি অবকাঠামোগত প্রস্তুতি অপরিহার্য।
ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে পূর্ব-নির্বাচনি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা গুরুত্বপূর্ণ। এত অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার হবে সেই সঙ্গে সন্ত্রাসী কর্মকা- দমনে এসব অভিযান কঠোর ভূমিকা রাখবে। তবে এ ধরনের অভিযান যেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে লক্ষ্য করে ব্যবহার না হয়, সে বিষয়ে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামান্যতম পক্ষপাত বা অপব্যবহার নির্বাচনকে কলঙ্কিত করতে পারে।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, অতি ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে বডিওর্ন ক্যামেরা রাখার পরিকল্পনা রয়েছে। যাতে কোনো ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক ক্যামেরার ফুটেজ দেখে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। কেন্দ্রে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা হলে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য বডিওর্ন ক্যামেরায় তার ভিডিও ধারণ করবেন। এই ভিডিও ফুটেজ ডিজিটাল অ্যাভিডেন্স হিসেবে সংরক্ষণ করা হবে। যাতে পরে যেকোনো তদন্তে ব্যবহার করা যায়, এটি একটি ভালো উদ্যোগ।
আমরা মনে করি, এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ভোটারদের আস্থা ফেরানো। ভোটার যেন কেন্দ্রগুলোতে নিরাপদে যেতে পারেন এবং কোনো প্রকার ভয়ভীতি ছাড়াই ভোট দিতে পারেন এটা নিশ্চিত করতে যেকোনো কঠোর পদক্ষেপ নিতেই হবে। এটাই হবে এবারের নির্বাচনের মূল সাফল্য। পুলিশ, প্রশাসন এবং নির্বাচন কমিশনের উচিত সমন্বিতভাবে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা যেখানে নাগরিকরা মনে করবেন, আমার ভোট আমার অধিকার, এবং সেটি নিরাপদ।
মোটা দাগে বলতে গেলে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে বাড়তি নিরাপত্তা, স্বচ্ছ মনিটরিং, নিরপেক্ষ বাহিনী মোতায়েন, প্রযুক্তিগত নজরদারি এবং দ্রুত সাড়া দেওয়ার সক্ষমতা নিশ্চিত করতে হবে। ভোটের দিনকে ‘ভোট উৎসব’ হিসেবে উদ্যাপন করতে হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দায়িত্ব পালন করতে হবে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা, দৃঢ়তা এবং সততার সঙ্গে।
নির্বাচন শুধু ভোট নয় এটি গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের বিশ্বাসের প্রতীক। সে বিশ্বাস অটুট রাখতে হলে এখন থেকেই যথাযথ, দৃঢ় এবং সর্বাত্মক প্রস্তুতি প্রয়োজন।

