ঢাকা বুধবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৫

নির্বাচনের মাঠ কতটা প্রস্তুত?

আব্দুল কাদের জীবন
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১০, ২০২৫, ০৩:০২ এএম

আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে বাংলাদেশের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে এই নির্বাচনকে একটি মাইলফলক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো প্রচার-প্রচারণায় আটঘাট বেঁধে নেমে পড়েছে। ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপের প্রতিটি চুমুকে নির্বাচনি আলোচনা। নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে মসৃণ ও নিরাপদ রাখতে ইতোমধ্যে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে আনা হয়েছে ব্যাপক রদবদল। জেলা প্রশাসক ও উপজেলা প্রশাসনে এই বড় ধরনের পরিবর্তন সামগ্রিক প্রস্তুতিকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হচ্ছে, এবং গুজব প্রতিরোধের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে একাধিক প্রতিষ্ঠান সমন্বয় করে কাজ করছে। প্রতিনিয়ত দেশজুড়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হচ্ছে, যা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত।

এবার ভোটারের সংখ্যা প্রায় ১৩ কোটি, যা নির্বাচন কমিশনের জন্য একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে অনলাইনে প্রবাসীদের ভোটগ্রহণের ব্যবস্থা, যা এই প্রথমবার বাস্তবায়িত হতে চলেছে। এই প্রযুক্তিগত উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়, কিন্তু এর সফল বাস্তবায়ন একটি বড় পরীক্ষা।

এত প্রস্তুতির মধ্যেও জনমনে কিন্তু শঙ্কা থেকেই যাচ্ছেÑ আগামী ফেব্রুয়ারি কি সত্যিই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত? দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এই প্রশ্নটিকে আরও জোরালো করে তুলেছে।

দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী, বর্তমানে প্রায় পাল্টাপাল্টি অবস্থানে রয়েছে। প্রতিনিয়ত দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘাত-সংঘর্ষের খবর আসছে, যা নির্বাচনি পরিবেশকে বিঘিœত করছে। কয়েক দিন আগে পাবনা দুই দলের সংঘর্ষ বাধে, দেখা যায় আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার। যেটি সত্যি আগামী নির্বাচনের জন্য ভয়াবহ বার্তা।

বিশেষ করে বিএনপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিশৃঙ্খলার চিত্র আরও উদ্বেগজনক। ২৭২টি আসনে প্রার্থী ঘোষণার পর থেকেই দলের মধ্যে অসন্তোষ চরমে উঠেছে। অনেক আসনে প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহার চেয়েছেন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর। আবার পছন্দের প্রার্থী না পাওয়ায় অনেক স্থানে কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধছে। দুঃখজনকভাবে, এতে হতাহতের সংখ্যাও উদ্বেগজনক।

অন্যদিকে, বিএনপি কর্মীদের মধ্যে হতাশাও বিরাজ করছে। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা দেশের মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। তারেক রহমানের দেশে ফেরার অনিশ্চয়তা কর্মীদের মনোবলকে দুর্বল করেছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আন্তর্জাতিক চাপ এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক আশ্রয় আইন লঙ্ঘন করে তার পক্ষে হুট করে দেশে ফেরা সম্ভব নয়। তারেক রহমান নিজেও তার সাম্প্রতিক বক্তব্যে ‘একক নিয়ন্ত্রাধীন নয়’ শব্দটি ব্যবহার করে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের কাছে তিনি ‘অনাস্থার প্রতীক’ হয়ে আছেন। এসব আন্তর্জাতিক সমীকরণের সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তার ফেরা কঠিন। তবে সরকার ইতোমধ্যে তার ফেরা নিয়ে নিরাপত্তা সংক্রান্ত সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বলে জানা যায়। এ ছাড়াও, বিএনপির জোট নিয়েও এখনো ধোঁয়াশা কাটেনি, যদিও তারা ২৭২টি আসনে প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করেছে।

জোটের রাজনীতি ও নতুন সমীকরণ

জামায়াতে ইসলামী ৩০০টি আসনেই প্রার্থী চূড়ান্ত করে রেখেছে, তবে জোটগত সমঝোতার ওপর নির্ভর করে তারা আসন সংখ্যা কমিয়ে আনতে পারে এবং জোট শরিকদের জন্য ১০০টি আসনও ছাড় দিতে পারে। ইতোমধ্যে জামায়াতে ইসলামীসহ আটটি রাজনৈতিক দল দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে বিশাল সভা-সমাবেশ করেছে। রাজনৈতিক মহলের ধারণা, এই আট দল মিলে একটি নতুন রাজনৈতিক জোট হতে চলেছে। যদিও দরকষাকষি এখনো চলছে, এই জোটের গুঞ্জনই বর্তমানে রাজনৈতিক অঙ্গনের মূল আকর্ষণ। আদৌ এই জোট গঠিত হবে কিনা, এবং জোট হলে আসন বণ্টন নিয়ে কত সময় প্রয়োজন পড়বে, তা নিয়ে সবার মনেই সংশয়।

অন্যদিকে, এনসিপি, এবি পার্টি এবং রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে আরেকটি নতুন রাজনৈতিক জোট। এই জোট জন্ম দিয়েছে নানা আলোচনার, তবে এর শক্তিমত্তা এবং চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা নিয়ে এখনো পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়নি।

নির্বাচন কমিশন একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেওয়ার জন্য প্রস্তুত, কিন্তু হাতে সময় মাত্র দুই মাস। প্রতি মুহূর্তে সমীকরণ আরও জটিল হচ্ছে। গোয়েন্দা তথ্যমতে, এক ‘ফ্যাসিস্ট চক্র’ আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণকে কেন্দ্র করে নাশকতার পরিকল্পনা করছে। দেশে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র প্রবেশের সম্ভাবনা রয়েছে, এবং জালনোট ছড়িয়ে দিয়ে অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা হতে পারে। নির্বাচন বানচালের জন্য দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার ঝুঁকি কোনোভাবেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

গুজব ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উদ্বেগজনক ব্যবহার, বিশেষত এআই-নির্মিত কন্টেন্ট দ্বারা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা, এটি নিরসন করা সরকারের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ। উপরন্তু, সীমান্ত এলাকা দিয়ে মাদকের প্রবাহ এবং দেশজুড়ে একের পর এক অগ্নিকা-ের ঘটনা সরকারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এ অগ্নিকা-গুলো নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার এখনো ব্যর্থ, যা নির্বাচনি নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এ ছাড়া ও চাঁদাবাজদের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না সরকার।

এ ছাড়াও, আগামী নির্বাচনে সরকার আন্তর্জাতিক চাপ কতটা সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারবে, সে বিষয়েও পরিষ্কার চিত্র নেই।

ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজন করতে গেলে সরকারকে একটি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। প্রশ্ন হলো, সরকার তার কাজে কতটা সফল? রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা কতটা মিলছে? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই বা কতটা প্রস্তুত? দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বলছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকার এখনো পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি নিতে পারেনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও সর্বোচ্চ সক্রিয়তা দেখাতে হবে।

সময় যেহেতু আর মাত্র দুই মাস, তাই সরকারকে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের বিষয়ে কঠোর হতে হবে। সার্বক্ষণিক সক্রিয় থাকার কোনো বিকল্প নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা এবং নির্বাচন কমিশনের কঠোর অবস্থানই পারে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে। নির্বাচনকে ঘিরে যে অস্থিরতা ও শঙ্কা তৈরি হয়েছে, তা দূর করতে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে এখন ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। নির্বাচনের মাঠ প্রস্তুত করতে প্রতিটি পদক্ষেপ হতে হবে দৃঢ় এবং স্বচ্ছ।

আব্দুল কাদের জীবন, শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়