নদী বলতে বুঝায় বহমান স্বচ্ছ পানির ধারা যা গিয়ে শেষ হয়েছে কোনো এক সাগর বা মহাসাগরে। যদিও নদীর মধ্যে কখনো রং-বেরঙের পানিও প্রবাহিত হয় যেমন কলোম্বিয়ার ‘রেইনবো রিভার’। যেখানে একসঙ্গে রংধনুর সাতটি রং এর পানি প্রবাহিত হয়। তাই অনেকে একে রংধনু নদী নামেও অভিহিত করে থাকে।কিন্তু এখন যে নদীটির কথা বলতে যাচ্ছি সেটা রঙিন বা স্বচ্ছ কোনোরকম পানির নদীই নয়। সেটা হচ্ছে ‘ফুলের নদী’! হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। বিচিত্র এই পৃথিবীতে এমন অনেক কিছুই আছে যা দেখলে স্রষ্টার সৃষ্টি নিয়ে মন ভাবনায় পড়তে বাধ্য। তবে এ সবই একমাত্র মহান রবের কুদরতের নিশানা। আজ পরিচয় করিয়ে দেবো এ রকমই এক নদীর সঙ্গে যেখানে কোনো পানি নেই। আছে শুধু ফুল আল ফুল। এতে আছে চেরি, নীল অপরাজিতা, টিউলিপ ও নদীর মতো বেয়ে আসা ছোট ছোট নীল ফুলের সারি। চমৎকার এই নীলাভ ফুলটি এক ধরনের ঘাসফুল যা হাঁটার সময় পায়ের তলায় চুরচুর করে ভেঙে পড়তে চায়। এই পুষ্পদ্বয়ের দোলায়িত দীর্ঘ ও প্রশস্ত বাগান দেখলে যে কেউ-ই ভাববে এটা কোন ফুলের নদীই হবে, যা বয়ে চলেছে কোনো পুষ্পসাগরে মিলিত হওয়ার জন্য।
অবস্থান :
অপূর্ব, অসাধারন, অপরূপা সুন্দর এই ফুলের বাগানটি অবস্থিত ইউরোপ মহাদেশের নেদারল্যান্ডসের কেউকেনহফ শহরে। এ জায়গাটি পুষ্পসম্ভারে এতই মনোরম ও মনোমুগ্ধকর যে, তা যে কারো স্বপ্নকেও হার মানায়। এখানে আছে নানা প্রজাতির রং-বেরঙের হাজার নয় লাখ লাখ টিউলিপ ফুলের বাগান। এ ফুলগুলো সাদা, লাল, গোলাপি, নীল, হলুদ, দুধে-আলতা প্রভৃতি হরেক রঙের হয়ে থাকে। এই এলাকা থেকে প্রতিবছর এসব টিউলিপ ফুল আমেরিকা ও জাপানে রপ্তানি করা হয়। এ ছাড়াও আরও অনেক ফুলপ্রেমী দেশ ও রাজ্য নেদারল্যান্ডস এর এই ‘কেউকেনহফ’ থেকে টিউলিপ আমদানি করে নিয়ে যায়। একে ফুলপ্রেমীদের জন্য একটি ফুলের স্বর্গই বলা যায়। যেদিকে চোখ যায় শুধু ফুল আর ফুল। অনেকে এই ফুলের সমাহারের সৌন্দর্য্য পুরোপুরি উপভোগ করার জন্য এই কেউকেনহফ শহরে এসে অনেকদিন থেকেও যায়।
বসন্তে এর রূপ :
একে তো এই অঞ্চলটি ফুলের জন্য বিখ্যাত, তার ওপর বসন্ত এলে এখানে যেন ফুলপরীরা অসংখ্য ডানামেলে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বসন্তে এর রূপ অনন্যা হয়ে চোখে ধরা দেয়। সঙ্গে মন-মাতানো সৌরভে চারদিকের বাতাস ভরভর করে। আর তাই এ সময় এখানে পর্যটকের সংখ্যাও স্বাভাবিক এর তুলনায় অনেকটা বেড়ে যায়। যেদিকে চোখ যায় শুধু রং-বেরঙের আর নানা প্রজাতির ফুল যেন চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। তখন দূর থেকে কেউকেনহফ-এর ঘরবাড়িগুলোকে দেখলে মনে হবে ফুলের এক মহাসাগরের মাঝখানে ছোট ছোট কয়েকটি মাত্র দ্বীপ গড়ে উঠেছে। বাকি পুরোটাই ভর্তি শুধু চোখ ধাঁধানো রং-বেরঙের ফুল আর ফুলের সমাহারে। এসব ফুলে যেমন প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় থাকে তেমনি প্রকৃতিকে অপরূপ সাজে সজ্জিত করে দেয়। বহু সৌন্দর্যপিপাসু মানুষের হৃদয়ের তৃষ্ণা মেটায়। আর তাই একে সমগ্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফুলের বাগান এর খেতাবটি দেওয়া হয়েছে। যা ফুলপ্রিয় ও ফুলচাষের দেশ জাপানকেও দেওয়া হয়নি।
নদীতে ভ্রমণ :
কেউকেনহফ-এ এলে শুধু ফুল দেখেই যে চোখ জুড়াবে তা নয়, এখানে ফুলের স্বর্গীয় নদীর পাশাপাশি আছে ছোট ছোট সত্যিকারের নদী যেগুলোর দুই তীর শুধু বাহারি রঙের ফুলে ফুলে সজ্জিত। এ নদীতে নৌকায় করে ভ্রমণ করলে আশপাশের প্রকৃতি দেখে মনে হবে এটা হয়তো পৃথিবীর বাইরের অন্য কোন জগতে চলে এসেছি। যেখানে শুধু ফুলের বিছানা বিছানো, ফুলের নদী প্রবাহিত। আর সঙ্গে বাতাসে রয়েছে মন-মাতাল করা ফুলের সুঘ্রাণ। এ রকম স্বর্গীয় ফুলের রাজ্যে গেলে মন হারিয়ে যাবে এর অনুপম সৌন্দর্যের মাঝে।
ফুলের চাষ :
প্রতিবছর এ অঞ্চলে প্রায় সত্তর লাখের মতো ফুলের বীজ ও চারাগাছ রোপণ করা হয়। স্বভাব তো সেজন্যই এটা বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাগান হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। এখানে ফুলের আকর্ষণে আগত পর্যটকদের জন্য উপযুক্ত সময়টা হলো মার্চ মাস থেকে শুরু করে মধ্য মে পর্যন্ত। এ সময় দর্শনার্থীদের জন্য ফুলের বাগান উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। যা দর্শনার্থীদের শুধু চোখ জুড়ায় না মনও ভরায়। ফুলের মধ্য থেকে শুধু এক টিউলিপই ফুটে কয়েক লাখেরও বেশি। মার্চের শেষের দিক থেকে শুরু করে এপ্রিল পর্যন্ত সময়টা। লো টিউলিপ ফুটার উপযুক্ত সময়। এ সময় ‘কেউকেনহফে’র প্রধান বাগান যেটা প্রায় আড়াই’শ বিঘা জমির উপরিভাগজুড়ে রয়েছে, তার উপরিভাগ পুরোটাই জুড়ে থাকে শুধু এই হরেক রঙের টিউলিপ ফুলের সমাহার। এর সঙ্গে নদীর তীরে, পার্কে, বা মাঠে রয়েছে অজস্র অপরাজিতা, চেরি বা নীলাভ রঙের ঘাসফুলের বাহার। সবকিছু মিলিয়ে এ ‘কেউকেনহফ’ কে শুধু ফুলের নদী নয় পুরো একটি ফুলের সাগরও বলা যায়।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন