রবিবার, ২০ জুলাই, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


বাসস

প্রকাশিত: জুলাই ২০, ২০২৫, ০৮:১০ এএম

রায়েরবাগের একটি নির্জন স্থান থেকে বাটন ফোনে সাংবাদিকদের কাছে নয় দফা দাবির বার্তা পাঠাই: আব্দুল কাদের 

বাসস

প্রকাশিত: জুলাই ২০, ২০২৫, ০৮:১০ এএম

আব্দুল কাদের। ছবি- সংগৃহীত

আব্দুল কাদের। ছবি- সংগৃহীত

ছাত্র-জনতার জুলাই গণআন্দোলন চলাকালীন সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইন্সটিটিউটের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী আব্দুল কাদের সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আন্দোলনের কঠিন সময় হাল ধরে আন্দোলনকে উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন তিনি। নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকার দিনগুলোতে গণমাধ্যমে পৌঁছে দিয়েছিলেন ৯ দফা দাবির কথা। যার ফলে নিভিয়ে যাওয়া আন্দোলন পেয়েছিল নতুন মাত্রা, দেশের জনগণ ফিরে পেয়েছিল ভরসা। সেই কাদের ১৫ জুলাই এক রিকশাওয়ালার সাহায্য নিয়েছিলেন ছাত্রলীগের অবস্থান জানার জন্য। পরে ওই রিকশাওয়ালা ছাত্রলীগের অবস্থান সম্পর্কে অবহিত করছিলেন কাদেরকে। সেই রিকশাওয়ালা পরবর্তীতে ৫ আগস্ট হাসিনা পালানোর পর কাদেরকে ফোন করে কান্নারত অবস্থায় বলছিল ‘মামা আমরা তো জিততা গেসি।’

সম্প্রতি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা জানান আব্দুল কাদের। এছাড়াও জানিয়েছেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে তার অবদান ও অভিজ্ঞতার কথা।

বাসস: কোটা সংস্কার আন্দোলনে কীভাবে যুক্ত হয়েছিলেন?

কাদের: ৫ জুন বিকেলে আমি টিউশনিতে ছিলাম যাত্রাবাড়িতে। তখন ছাত্র শক্তির (আমাদের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন) মেসেঞ্জার গ্রুপে কোটা পুর্নবহাল করে হাইকোর্টের যে রায় ছিল সেটার বিরুদ্ধে মিছিল বের করার কথা চলছিল। আলোচনার পর মিছিল বের করার সিদ্ধান্ত  হয়। তখন নাহিদ ভাই, আসিফ মাহমুদ ভাই, আব্দুল হান্নান মাসউদ, রিফাদ রশিদ, হাসিব আল ইসলামসহ আমাদের যারা ছিল তারা সবাই কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে জড়ো হয়। পরে একটি বিক্ষোভ মিছিল হয় যার মাধ্যমে কোটা সংস্কার আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।

এরপর আমাদের গ্রুপে আন্দোলন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এই আন্দোলনকে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, তা নিয়ে আলোচনা করি। প্রাথমিকভাবে ঠিক হয় যে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে আন্দোলন চালানো হবে। ওই সময়ে অন্য যেকোনো ব্যানারে আন্দোলন করলে সেই আন্দোলনকে সরকার বিরোধী আন্দোলন অথবা যারা যুক্ত থাকতো তাদেরকে শিবির ট্যাগ দেওয়া হতো। সেই জায়গা থেকে চিন্তা করে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে আন্দোলন পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

ওই সময় ঈদের ছুটি চলে আসায় আমরা ঈদের পরে আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কারণ তখন ছুটি শুরু হওয়ায় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা দিন দিন কমছিল। এ কারণে ৯ জুন একটি মানববন্ধন করে আমরা ৩০ জুন পর্যন্ত আল্টিমেটাম দিয়েছিলাম।

বাসস: পহেলা জুলাই থেকে ১৫ জুলাই পর্যন্ত আন্দোলনে কীভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন অথবা এই সময়টাতে কি কি দায়িত্ব পালন করেছেন?

কাদের: জুলাইয়ের প্রথম দুই দিন আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে কর্মসূচি পালন করি। কিন্তু এর মাঝে একটি সমস্যা দেখা দেয়, ছাত্র শক্তির পদবি উল্লেখ করে বক্তাদের বক্তব্য কোট করে নিউজ করছিল। যে কারণে আমাদের উপর একটা চাপ সৃষ্টি হয়। কিছু কিছু পত্রিকা তখন এই আন্দোলনকে সরকার বিরোধী আন্দোলন হিসেবে দেখাতে শুরু করে, যা আমাদের জন্য সমস্যা তৈরি করে। ঠিক এ কারণেই আমরা একটি সমন্বিত ব্যানার তৈরির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। এসময় আমাদের সাথে বিভিন্ন হল থেকে কয়েকজন শিক্ষার্থী যুক্ত হন। মল চত্বরের শতবর্ষ স্মৃতিস্তম্ভে আমরা একটি মিটিং ডাকি। সেখানে আমাদের এই আন্দোলনের নাম এবং কমিটি কীভাবে গঠিত হবে তা নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনার মাঝখানে আব্দুল হান্নান মাসউদ ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নাম প্রস্তাব দেন। যেহেতু কোটা পুনর্বহালের মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছিল, সেই জায়গা থেকে হান্নান মাসউদ এই নাম প্রস্তাব করে। পরে সবার সম্মতিতে এই নাম গৃহীত হয়। এর পরে ‘সমন্বয়ক’ ও ‘সহ-সমন্বয়ক’ পদের মাধ্যমে কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০১৯-২০ সেশন পর্যন্ত সমন্বয়ক এবং এর পরের সেশনের শিক্ষার্থীদের সহ-সমন্বয়ক পদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

১৮ সালের কোটা আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা শিখেছিলাম যে একক নেতৃত্ব থাকলে তাকে নানানভাবে ম্যানিপুলেট করা, আর্থিক প্রলোভন দেখানো কিংবা ভয় দেখিয়ে আন্দোলন দমন করার সম্ভাবনা থাকে। তাই আমরা এমন একটি প্যাটার্ন তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেই যেখানে সবার সমান পদমর্যাদা থাকবে, যাতে একক নেতৃত্ব না তৈরি হয় এবং আন্দোলনকে সহজে দমন করা না যায়। এ কারণেই ‘সমন্বয়ক’ ও ‘সহ- সমন্বয়ক’ পদের মাধ্যমে কমিটি গঠিত হয়েছিল।

আন্দোলনের শুরু অর্থাৎ পহেলা জুলাই থেকে আমার দায়িত্ব ছিল ঘোষিত কর্মসূচি পালনে শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখভাল করার এবং শিবিরের সাথে সমন্বয় করা। এরকমভাবে আসিফ মাহমুদ ভাই ছাত্রদলের সাথে এবং নাহিদ বামপন্থীদের সাথে যোগাযোগ করতেন। আর মাহফুজ ভাই সবার সাথে যোগাযোগ রাখতেন। সুতরাং, আমার মূল দায়িত্ব ছিল লজিস্টিক সাপোর্ট দেখা এবং স্বেচ্ছাসেবক টিম নিয়ন্ত্রণ করা।

সম্ভবত ৫ জুলাই শিবিরের জায়েদ (তৎকালীন ছাত্র আন্দোলন বিষয়ক সম্পাদক) নামে একজন আমার সাথে যোগাযোগ করেন। তখন আমি জায়েদের সাথে রাতে আলোচনা করি যে শিবির থেকে আমরা কী ধরনের সহায়তা পেতে পারি। পরে শিবির গুরুত্বপূর্ণ লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়ে আমাদেরকে সহযোগিতা করেছিল। সকল ছাত্রসংগঠনই সাপোর্ট করেছিলো তবে শিবিরের লজিস্টিক সাপোর্ট ছিল উল্লেখযোগ্য।

আমার নেতৃত্বে প্রায় ১০০ জনের একটি স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করা হয়েছিল এবং তাদের নিয়ে একটি মেসেঞ্জার গ্রুপও ছিল। আমার দায়িত্ব ছিল এই স্বেচ্ছাসেবক দলকে পরিচালনা করা এবং আন্দোলনের বিভিন্ন পয়েন্টে শৃঙ্খলা বজায় রাখা। কোন পয়েন্টে কতক্ষণ থাকা হবে, কোথায় কতজন স্বেচ্ছাসেবক থাকবে - এসব বিষয় আমার দায়িত্বে ছিল।

বাসস: ১৪ জুলাই রাতে কী ঘটেছিল বা আপনি ওই সময়ে কোথায় ছিলেন, কী কী করেছেন?

কাদের: ১৪ জুলাই রাত ছিল আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। রাত ১০টার দিকে তখনও আমি টিউশনিতে ছিলাম, তখন একটি মেসেজ আসে যে মেয়েরা সবাই হল থেকে বের হয়েছে। তখন সবাইকে ক্যাম্পাসের দিকে আসতে বলা হয়। এরপর আমি দ্রুত ক্যাম্পাসের দিকে আসি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর এক বক্তব্যের প্রতিবাদে সকল ছাত্ররা ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার - রাজাকার’ স্লোগান দিতে দিতে রাজু ভাস্কর্যের দিকে জড়ো হতে থাকে। হলে অবস্থান করা সকল শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে অবস্থান নেয়।

আমি তখন অনলাইনে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকি। তবে এই স্লোগানকে কিছু কিছু মানুষ বিতর্কিত করার চেষ্টা করছিল। তখন আমাদের সিনিয়ররা (আসিফ ভাই, নাহিদ ভাই এবং মাহফুজ ভাই) এবং আমি একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিই যে এই স্লোগানটিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে দেওয়া যাবে না। আমরা তখন স্লোগান পরিবর্তন করে ‘তুমিও নও, আমিও নই, রাজাকার রাজাকার’ স্লোগান দেওয়ার জন্য কয়েকজন মেয়েকে বলি। তখন তারা এই স্লোগান দেয়। রাত ২:৩০ মিনিট পর্যন্ত আমি ক্যাম্পাসে অবস্থান করেছিলাম। সবাই হলে ফিরে যাওয়ার পর আমি ক্যাম্পাস থেকে চলে আসি।

বাসস: ১৫ এবং ১৬ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের হামলা এবং আবাসিক হলগুলো থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করাসহ নানা ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর বিস্তারিত জানতে চাই।

কাদের: ১৪ই জুলাই রাত থেকে আমি, আসিফ ভাই এবং নাহিদ ভাই একটি বাসায় আশ্রয় নেই। এই বাসাটি ছিল গণঅধিকার পরিষদের সাবেক নেতা মশিউর ভাইয়ের। সে সময় আমাদের থাকার কোনো নির্দিষ্ট জায়গা ছিল না, তখন মশিউর ভাইয়ের পরিবার, বিশেষ করে ভাবী, আমাদের খুব আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছিলেন।

১৫ জুলাই সকাল ১১ টায় আমাদের কর্মসূচি ছিল। পরে ১২:৩০ মিনিটের দিকে আমাদের কর্মসূচি শুরু হয়। প্রথমে মানুষের উপস্থিতি কম থাকলেও পরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি বিশাল মিছিল এসে যুক্ত হয়। তখনই আমরা জানতে পারি যে বিজয় ৭১ হলে আমাদের শিক্ষার্থীদের আটকে রাখা হয়েছে। সাধারণত যারা নিয়মিত আসতো, সেদিন তাদের হল গেটে আটকে রাখা হয়েছিল। আমাদের একজন টিম লিডারসহ একটি দল শিক্ষার্থীদের আনতে তখন হলপাড়ার দিকে যায়। এরপর আমি যোহরের নামাজ শেষ করে এসে দেখি আমাদের সবাই মলচত্বরে অবস্থান করছে।

এর ঠিক একটু পরেই মধুর ক্যান্টিন থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমাদের সকলের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। তখন আমরা সবাই মিলে প্রতিহত করার চেষ্টা করি। তারা ইট পাটকেল ছুঁড়ছিল এবং এ কারণে অনেকেই আহত হয়েছিল। নাহিদ ভাই দু’জন মেয়েকে ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন এবং আমি কয়েকজনকে নিয়ে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। পরিস্থিতি এতটাই বেগতিক ছিল যে আমরা ফুলার রোড দিয়ে এসএম হলের ভেতর ঢুকি। ছাত্রলীগ তখন শিক্ষকদের কোয়ার্টার পর্যন্ত আসে এবং সেখানেও মারধর করে। আমরা সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেলে যাই আহতদের চিকিৎসার জন্য। পরিচিতসহ অনেকেই তখন গুরুতর আহত হয়েছিল।

১৫ই জুলাই সন্ধ্যায় আমরা আবারও ক্যাম্পাসে ফেরার পরিকল্পনা করি। আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ক্যাম্পাসে প্রবেশ করা এবং আন্দোলনকে থামতে না দেওয়া। আসিফ ভাই, নাহিদ ভাইসহ আমরা কয়েকজন একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিই যে যেকোনো মূল্যে ক্যাম্পাসে ঢুকতেই হবে।

এদিন সন্ধ্যা থেকে সাইন্সের তিনটি হল (শহীদুল্লাহ্ হল, অমর একুশে হল এবং ফজলুল হক মুসলিম হল) শিক্ষার্থীদের দখলে চলে চায় এবং ছাত্রলীগ বিতাড়িত হয়। ফলে ওইদিক আমাদের জন্য তুলনামূলকভাবে নিরাপদ ছিল, তাই আমরা সেদিক দিয়েই ক্যাম্পাসে ঢোকার পরিকল্পনা করি। তখন আমরা শহীদুল্লাহ্ হলের সামনে থেকে একটি মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢোকার চেষ্টা করি।

এই সময়ে শিবিরের মহানগর টিম আমাদের সহায়তার জন্য আসে। তারা পাইপ এবং অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে চাঁনখারপুল মোড়ে অবস্থান নেয়। এছাড়াও ছাত্রদলের ২০-২৫ জন আমাদের সাথে যোগ দেয়। সবমিলিয়ে আমরা তখন ১০০-১৫০ জনের মতো ছিলাম। আমরা যখন শহীদুল্লাহ্ হলের দিকে আসছিলাম তখন হলে অবস্থানকারী শিক্ষার্থীরা আমাদেরকে ছাত্রলীগ মনে করে ইট ছুঁড়ে মারতে শুরু করেছিল। পরে আমাদের পরিচিত স্লোগান শুরু করলে পরিস্থিতি ঠিক হয়ে যায়।

মিছিল নিয়ে কার্জন হলের গেটে অবস্থান করলে পুলিশ আমাদের আটকায়। পুলিশ এবং সাংবাদিকরা আমাদের সেখানে কর্মসূচি শেষ করতে বলে। আমাদের নেতৃবৃন্দ তাদের সাথে আলোচনা করে। শেষ পর্যন্ত আমরা কার্জন গেটে কিছুক্ষণ অবস্থান করে আমাদের ওই দিনের কর্মসূচি শেষ করে পরবর্তী কর্মসূচির ঘোষণা দিই।

পরে সেখান থেকে আবারও ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে সবার চিকিৎসার খোঁজ-খবর নিয়ে বাসায় ফিরে আসি। এসময় একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। একজন রিকশাচালককে আমার নিজের পরিচয় দিয়ে আমার ফোন নম্বর ওনাকে দিই এবং ছাত্রলীগ কোথায় কোথায় অবস্থান করছে তা জানাতে বলি। এরপর উনি আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের এলাকায় ছাত্রলীগ কোথায় কোথায় অবস্থান করছে তা জানান। এরপর ৫ আগস্ট যখন আমরা বিজয় লাভ করি, তখন ওই রিকশাওয়ালা আমাকে ফোন করেন। ওনার ফোন নম্বর আমার ফোনে সেভ ছিল এ কারণে তখন ফোন রিসিভ করি।  রিসিভ করার পর রিকশাওয়ালা আমাকে বলেন, ‘মামা আমরা তো জিততা গেছি।’ এই কথা বলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।

১৬ তারিখ পূর্বঘোষিত কর্মসূচি আমরা শহীদ মিনারে পালন করি। সন্ধ্যার দিকে সারাদেশে ৬ জনের শহীদ হওয়ার খবর আসে। তখন নানা সিন্ধান্তহীনতায় আমরা মিছিল নিয়ে ভিসি চত্বর গিয়ে কর্মসূচি শেষ করি। এবং ওই রাতে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। এই সময় সরকারের পক্ষ থেকে বারবার আলোচনার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছিল। আমরা ছয়টি লাশের বিনিময়ে শুধু কোটা সংস্কার নাকি আরও কিছু চাই, তা নিয়ে অনলাইন মিটিংয়ে আলোচনা চলে। নাহিদ ভাই একটি গুরুত্বপূর্ণ উক্তি বলেন যে ‘উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য সরকার দায়ী এবং সরকারকেই সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।’ 

আমরা একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিই, যেখানে এই লাইনটি স্পষ্ট থাকবে। প্রায় এক ঘণ্টা আলোচনার পর রাত ২ টার দিকে আমরা প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করি।

ওই রাতে আসিফ ভাই একটি ফেসবুক পোস্টে লিখেছিলেন যে, ‘আমরা আসছি, আপনারা বের হন, আমরা ১০০ জন নিয়ে আসছি।’ এই পোস্টটি রোকেয়া হল ও অন্যান্য হল থেকে ছাত্রলীগ বিতাড়িত করতে সাহায্য করে এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাহস যোগায়। সেই সময় আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলাম যে ছাত্রলীগ কর্মীদের বের করতে পারব কিনা। আমি ঢাবি শিবিরের তৎকালীন সভাপতি সাদিক কায়েম ভাইকে ফোন করে উদ্যোগ নিতে বলি, যাতে সংগঠিতভাবে এই কাজটি করা যায়। তিনি আমাকে কিছুক্ষণ পর ফোন করে আপডেট জানাতে থাকেন। এভাবে সমন্বয় করে সেদিন আমরা ছাত্রলীগ বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়েছিলাম।

বাসস: ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কী কী ঘটেছিল?

কাদের: ১৭ জুলাই আমাদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি ছিল গায়েবানা জানাজা এবং কফিন মিছিল। কফিন, কাফনের কাপড় ম্যানেজ করার দায়িত্ব ছিল আমার। সকাল থেকে ডামাডোলের মধ্যে সেগুলো কেনা আর সম্ভব হয় নাই। তখন শিবিরের তৎকালীন ছাত্র আন্দোলন বিষয়ক সম্পাদক জায়েদের সাথে দেখা হলে তাকে বিষয়টা জানাই- কাউকে দিয়ে কফিন নিয়ে আসতে পারবে কি না। জায়েদ আমাকে আশ্বস্ত করে এবং এক ভাইয়ের নাম্বার দিয়ে বলে, ‘উনি পৌঁছে দেবেন।’ ঘণ্টা দুয়েক পরে ওই ভাই আমাকে ফোন দিয়ে বলল, ‘কোনোভাবেই কফিন ক্যাম্পাসের ভেতরে ঢুকানো যাচ্ছে না। সবগুলো প্রবেশপথে পুলিশ মোতায়েন করা।’ 

তখন সিদ্ধান্ত নিলাম কেবল কাফনের কাপড় দিয়েই জানাজা পড়াব। উনার সাথে যোগাযোগ করে মুজিব হলের পকেট গেটে গেলাম, গেট বন্ধ। উনি ওপাশ থেকে গেটের উপর দিয়ে কাপড়ের ব্যাগ ছুঁড়ে মারলেন। সেটা নিয়েই ভিসি চত্বরে চলে আসলাম। কিন্তু মন মানতেছিল না, কফিন ছাড়া জানাজা এবং মিছিল অসম্পূর্ণ লাগে। উনি অবশ্য নানানভাবে চেষ্টা করেছিলেন, কফিনটা ঢুকানোর জন্য। অ্যাম্বুলেন্সে করে বিভিন্ন প্রবেশমুখ দিয়ে ঢুকার চেষ্টা করেছেন।

ওই ভাইয়ের সাথে আবারও যোগাযোগ করে বললাম, নীলক্ষেতের মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণ গেটের দিকে আসতে পারবে কি না? এই প্রবেশমুখটা আমাদের কাছাকাছি আছে, আমরা গিয়ে পুলিশের সাথে বার্গেনিং করে হলেও কফিন নিয়ে আসার চেষ্টা করব। উনি একটা অ্যাম্বুলেন্সে করে তোরণের সামনে কফিন নিয়ে এসে ফোন দিলেন। আমি আশেপাশে পরিচিত কাউকেই খুঁজে পেলাম না। কাকে নিয়ে যাবো! চারদিকে আতঙ্ক আর থমথমে অবস্থা। পরে রিফাত রশিদকে পেলাম। আরো মানুষজন লাগবে। ভিসিতে দাঁড়িয়ে সবাইকে চিল্লায়া ডাকলাম, তোরণ থেকে কফিন আনতে যাবো, আপনারা আসেন। পাশ থেকে দাঁড়িয়ে থাকা তালা-শিকল হাতে একজন বললো, চলেন আমরা যাই। তারপর এক এক করে ১৫-২০ জন হয়ে গেলো! আমরা তোরণের ওপাশ থেকে পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে, পুলিশের সাথে ধস্তাধস্তি করে কফিন নিয়ে চলে আসলাম। এই ১৫-২০ জন ব্যক্তি সেইদিন অসামান্য সাহস দেখিয়েছিল, যার দরুন পরিপূর্ণভাবে সেই দিনের কর্মসূচিটা আয়োজন করা গেছে। শিবিরের ওই ভাইও অনেক পরিশ্রম করেছেন, সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। পরে আবার বাকি কফিনগুলোও নিয়ে আসছেন। সেই তালা-শিকল হাতে থাকা ব্যক্তির সাথে পরে পরিচয় হলো। নাম তামিম। আমার ব্যাচমেট এবং একই হলের। এখন ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে যুক্ত।

কফিন নিয়ে প্রবেশ করার পর আমরা জানাজার আয়োজন করি। জানাজা শেষে আমরা রাজু ভাস্কর্যের দিকে মিছিল নিয়ে এগোতে থাকি। মিছিলটি যখন আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের সামনে ছিল, তখন সামনে ও পেছন থেকে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ শুরু করে। তখন কলাভবনের প্রধান গেট বন্ধ থাকায় অনেকে দেয়াল টপকে ভিতরে যায়। দেয়াল টপকানোর সময় আমার উরুর মাংস ছিঁড়ে যায়।

আহত অবস্থায় আমি মল চত্বরের দিকে দৌঁড়াই তখনও পুলিশ ছররা গুলি চালাচ্ছিল। আমরা সেখানে আগুন ধরাই। এরপর সূর্যসেন হলের ক্যাফেটেরিয়ায় আমি আশ্রয় নিই, যেখানে দুজন শিবির কর্মী আমাকে সহায়তা করে। তারা আমাকে লুঙ্গি ও গামছা দেয় এবং প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। রক্ত ঝরা থামছিল না, তাই আমার এক বন্ধুকে ফোন দিই চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য।

এই ঘটনার মধ্যেই আসিফ ভাই পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করে তাদের গুলি থামাতে বলেন এবং আলোচনার প্রস্তাব দেন। আলোচনার প্রস্তাব এ জন্য দিয়েছিল যাতে গুলি করা বন্ধ হয়। প্রথমে পুলিশ আলোচনার প্রস্তাবে রাজি না হলেও, পরবর্তীতে নাহিদ ভাইয়ের মধ্যস্থতায় তারা আলোচনায় বসতে রাজি হয় এবং গুলি বন্ধ করে। এরপর আমাকে এবং আসিফ ভাইকে এক ব্যক্তি একটি মোটরসাইকেল করে ক্যাম্পাস থেকে বের করে নিয়ে যায়।

বাসস: আমরা দেখতে পাই ১৭ জুলাই থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে যায়। এরপরে কোথায় অবস্থান করছিলেন এবং কীভাবে আন্দোলন পরিচালনা করেছেন?

কাদের: ১৭ই জুলাই ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং ক্যাম্পাসে প্রবেশ অসম্ভব হওয়ায় ১৮ই জুলাই থেকে আন্দোলনকারীরা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এই দিনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও রাজপথে নেমে আসে। ১৮ই জুলাই আমরা দুপুর পর্যন্ত মশিউর ভাইয়ের বাসায় ছিলাম। এরপর আমরা যাত্রাবাড়ির দিকে বের হই এবং সেখানে আন্দোলন শুরু করি। ওইদিন বিকেল থেকেই ইন্টারনেটের গতি কমে যায় এবং রাত থেকে পুরো নেটওয়ার্ক বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আসিফ ভাই, নাহিদ ভাই এবং অন্যান্যদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি।

১৯শে জুলাই শুক্রবার ছিল। জুমার নামাজ শেষে মসজিদ থেকে মুসল্লিরা মিছিল নিয়ে বের হলে পুলিশ তাদের উপর গুলি চালায়। যাত্রাবাড়ি থানা এবং রায়েরবাগ থানা এলাকায় একটানা আন্দোলন চলতে থাকে। যাত্রাবাড়ী থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের দখলে ছিল। সেদিন ছোট ছোট বাচ্চারা (১০-১২ বছর বয়সী) পুলিশের সামনে নিজের বুক পেতে দিয়েছিল এবং পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালাচ্ছিল। তবে এই এলাকায় মাদ্রাসা শিক্ষার্থী এবং শিবির কর্মীরা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল। আমি সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে অবস্থান করেছিলাম।

বিকেলের দিকে আমি কাজলা ফ্লাইওভারের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন চারিদিকে মানুষ মারা যাচ্ছিল এবং আমি অসহায় বোধ করছিলাম। বিকেল ৩:৩০ মিনিটের দিকে ঢাবি শিবিরের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ভাই আমাকে ফোন করে বলেন যে কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না, কী করা যায়? আমি বলি যে আমিও কাউকে পাচ্ছি না। তখন তিনি কিছু দাবি-দাওয়া উত্থাপন করার কথা বলেন।

১৬ই জুলাই আবু সাঈদসহ ছয়জন নিহত হওয়ার পর আমরা একটি অনলাইন মিটিং করেছিলাম, যেখানে কিছু দাবি-দাওয়া ঠিক করা হয়েছিল। তবে সেগুলো তখন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। ১৯শে জুলাই সন্ধ্যায় ফরহাদ ভাই আমাকে ফোন করে দাবিগুলো জানান। 

তখন ফরহাদ ভাইয়ের সাথে আলোচনা হয়। এরপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ, হামলাকারীদের বিচার, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ইত্যাদি দাবিগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। ছয় নম্বর দাবি ছিল ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা। আমি এর বিরোধিতা করি এবং বলি যে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা আমাদের অবস্থান নয়, বরং ছাত্ররাজনীতির লেজুড়বৃত্তি বন্ধ করা উচিত। পরে এই বিষয়ে ফরহাদ ভাই আমার সাথে একমত হন। এভাবে সমন্বয় করে নয় দফা ঠিক করা হয়।

দাবিগুলো চূড়ান্ত হওয়ার পর আমার একটি নতুন সিমের প্রয়োজন হয়, কারণ আমার ফোনটি ট্র্যাকিংয়ের ঝুঁকিতে ছিল। আমি আমার টিউশনের ছাত্রকে ফোন করি। সে আমাকে একটি সিম, একটি পাওয়ার ব্যাংক এবং প্রায় ৩০০০ টাকা দেয়। আমি সেই সিমটি নিয়ে আমার মামার বাটন ফোনে ঢুকিয়ে রায়েরবাগের একটি নির্জন স্থানে চলে যাই।

সেখানে বসে আমি সাংবাদিকদের কাছে নয় দফা দাবি সংবলিত বার্তা পাঠাতে শুরু করি। প্রথমে বাটন ফোন থেকে পুরো বার্তা একসঙ্গে পাঠানো যাচ্ছিল না, তাই অর্ধেক অর্ধেক করে পাঠাতে হয়। শিবিরও এই বার্তা প্রচারে সহায়তা করে। আমাকে বিভিন্ন টিভি মিডিয়া থেকে সাংবাদিকরা ফোন করে বার্তাটির সত্যতা যাচাই করেন। আমি তাদের বলি যে এটি আমার পক্ষ থেকে আসা বার্তা এবং দাবিগুলো বলি।

ওইদিন রাত ১১ টার দিকে আমি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়া যেমন বিবিসি, রয়টার্স, আল জাজিরা এবং সিএনএন-এর সাংবাদিকদের সাথে যোগাযোগ করি। আমি তাদের কাছে নয় দফা দাবি সম্পর্কে বার্তা পাঠাই। যদিও সেদিন রাতে আট দফা দাবি বেশি হাইলাইট হয়েছিল, তবে আমি নয় দফা দাবি সম্পর্কে সবাইকে জানাই।

২১শে জুলাই ছিল রবিবার। এদিন আমি সাইনবোর্ডের কাছে একটি মাদ্রাসার পাশে শিশির ভাইয়ের বাসায় আশ্রয় নিই। তিনি তৎকালীন শিবিরের আইটি সেল দেখতেন। রাত ১১টার দিকে আমি রিকশায় করে তার বাসায় যাই। পথে প্রতিটি জায়গায় চেকপোস্ট ছিল এবং সাদা পোশাকে পুলিশ আন্দোলনের খবর বের করার চেষ্টা করছিল।

সেখানে নামাজ পড়ে এবং খাওয়া-দাওয়া করে আমি শিশির ভাইয়ের সাথে আলোচনা করি। পরদিন সকালে সাদিক ভাইয়ের পাঠানো দুজন ব্যক্তি (তাদের মধ্যে একজন নারায়ণগঞ্জ শহর শাখার সভাপতি/সেক্রেটারি ছিলেন) শিশির ভাইয়ের বাসায় আসে। তারা আমার স্মার্টফোনটি নিয়ে যায় এবং আমাকে একটি বাটন ফোন দেয়। শিশির ভাইয়ের বুদ্ধিতে আমার ফোনটি নেওয়া হয়েছিল, যাতে সিম ও ব্যাটারি আলাদা করে রাখা যায়। এদিন থেকে আমি শুধুমাত্র বাটন ফোন ব্যবহার করে যোগাযোগ করতাম।

শিশির ভাইয়ের বাসায় বেশিদিন থাকা সম্ভব ছিল না, কারণ এটি একটি পারিবারিক বাসা ছিল এবং রেড পড়ার ঝুঁকি ছিল। আমার আত্মীয়-স্বজনরাও আমাকে আশ্রয় দিতে রাজি হননি। তখন আমি শিশির ভাইয়ের একটি ঢিলেঢালা টি-শার্ট ও প্যান্ট পরে একটি ক্যাপ মাথায় দিয়ে সরাসরি নিজের বাসায় ফিরে আসি।

আমি দিনের বেলা বাসায় থাকতাম এবং রাতের বেলা বাইরে গিয়ে সাংবাদিকদের সাথে যোগাযোগ করতাম। সন্ধ্যা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত আমি রায়েরবাগ বা ডেমরা রোডে যেতাম, ডেমরা রোড তুলনামূলকভাবে নিরাপদ ছিল। সেখানে সবার সাথে কথা বলতাম। প্রথমে অন্যরা আমার বার্তাটি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে পাঠাতো, কিন্তু পরে আমাকে নিজেই পাঠাতে হতো। সাংবাদিকরা আমার নাম্বার ভেরিফাই করার জন্য প্রতিদিন রাত ১১ টা পর্যন্ত ফোন করতেন। আমি তাদের সাথে কথা বলে বার্তাটি কনফার্ম করতাম।

আমার নিজের বাসায়ও থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তখন সাদিক ভাইয়ের মাধ্যমে আমি রামপুরায় একজনের বাসায় আশ্রয় নিই। এখানে সম্ভবত ২২-২৪ তারিখ পর্যন্ত ছিলাম। এই সময়টাতে প্রতিদিনের কর্মসূচি আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা হতো। কর্মসূচি চূড়ান্ত হওয়ার পর আমি সেটি কনফার্ম করতাম। এরপর সেখান থেকেও আমাকে চলে আসতে হয়, কারণ প্রতিটি বাসায় রেড দেওয়া হচ্ছিল এবং পরিস্থিতি উত্তপ্ত ছিল।

রামপুরা থেকে চলে আসার পর আমার ছোট মামার বন্ধু, যিনি ঢাকায় একটি মসজিদে ইমামতি করতেন, তার কাছে আশ্রয় নিই। ২৫/২৬শে জুলাই সন্ধ্যায় আমি মামার সাথে মসজিদে যাই। সেখানে থাকার সময় শিবিরের পক্ষ থেকে আমাকে একটি স্মার্টফোন দেওয়া হয়। তবে, সেদিন রাতে মামা আমাকে জানান যে মসজিদে থাকা নিরাপদ নয়, কারণ অনেকে আমাকে দেখে গেছে এবং মসজিদ কমিটির সভাপতি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত যে কারণে তার চাকরি চলে যেতে পারে।

২৭/২৮ জুলাইয়ের দিকে সাদিক কায়েম ভাই আমাকে একজন নারী সাংবাদিকের ফোন নম্বর দেন। আমি ওই সাংবাদিক আপার সাথে ফোনে কথা বলি এবং তিনি আমাকে খিলক্ষেতে তার বন্ধুর কাছে যেতে বলেন।

২৮শে জুলাই দুপুরে আমি সিএনজি নিয়ে খিলক্ষেতে যাই। সেখানে একটি মসজিদে নামাজ পড়ার পর সাংবাদিক আপার বন্ধু আমাকে গুলশানে তার বাসায় নিয়ে যান। এই ব্যক্তি একটা অ্যাম্বাসিতে কাজ করতেন এবং বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। আমি আন্দোলনের শেষ দিন পর্যন্ত তার বাসায় ছিলাম। এই ব্যক্তি এবং সাংবাদিক আপা মূলত বাইরে থেকে যারা বিদেশি মিডিয়ায় কাজ করেন তাদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন। যার মাধ্যমে তারা বিভিন্ন তথ্য পেতেন এবং আন্দোলনের কৌশল  নির্ধারণে সহায়তা করতেন।

আন্দোলন চলাকালীন প্রতিদিন দুপুর থেকে পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা চলতো। শিবির এবং ছাত্রদল উভয় পক্ষের সাথে আলোচনা হতো। এই সময়টাতে আব্দুল হান্নান মাসুদ ও মাহিন সরকার মূলত সাংবাদিক তাসনিম খলিল ভাই এবং শিবিরের সাথে যোগাযোগ রাখতেন। রিফাত রশিদ কূটনৈতিক অংশের সাথে যোগাযোগ রাখতেন এবং আমি সকল ছাত্র সংগঠনের সাথে প্রাথমিক পর্যায়ে যোগাযোগ করে পরিকল্পনা ঠিক করতাম। 

২৮শে জুলাইয়ের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট আমাকে ফোন করেন এবং জানান যে ছাত্রদলের প্রেসিডেন্ট আমার সাথে কথা বলতে চান। তখন আমি, রাকিব ভাই (প্রেসিডেন্ট) এবং নাসির (সেক্রেটারি) ভাই অনলাইনে যুক্ত হয়ে কথা বলি। এখানে পরের দিনের কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হয়, যেখানে মিরপুরে ছাত্রদল এবং শিবিরের নাম উল্লেখ করে একটি পরিকল্পনা করা হয়।

মাঠের আন্দোলন না থাকায় আমরা মাঠের আন্দোলন নিয়ে ভাবছিলাম। তখন সবার সম্মতিতে মাঠের কর্মসূচি দেওয়া হয়। রাকিব ও নাসির ভাই আমাদের অভয় দেন এবং বলেন যে তারা মাঠে থাকবেন।

বাসস: পহেলা আগস্ট থেকে ৫ আগস্টের ঘটনায় আপনার ভূমিকা কি ছিল অথবা কী কী দায়িত্ব পালন করেছিলেন?

কাদের: এতোদিনে আমাদের সবাই প্রকাশ্যে চলে এসেছে। পহেলা আগস্ট ছিল বৃহস্পতিবার। ওইদিন আসিফ ভাই আমাকে একটি টেক্সটের মাধ্যমে বলেছিলেন, আমাদের সব সিনিয়ররা অ্যাক্টিভ হয়েছেন এবং তাদের সাথে আলোচনা ছাড়া যেন কোনো কর্মসূচি না দেই।

তবে আসিফ ভাইয়ের ফোনের মাধ্যমে আমাকে ট্র্যাক করতে পারে এটা মনে করে আমি আসিফ ভাইয়ের মেসেজ সিন করিনি। তখন আমি এবং সাদিক কায়েম ভাই পরামর্শ করি যে একটি বড় কর্মসূচি দেওয়া উচিত কি না।

২রা আগস্ট শুক্রবার মাগরিবের পর আমাদের কাছে তথ্য আসে যে আনু মুহাম্মদ প্রেসক্লাবে এক দফা ঘোষণা দিয়েছেন। সেই সময় ওই সাংবাদিক আপা, সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের এবং কূটনৈতিক ব্যক্তিরা আমাকে এক দফা ঘোষণার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন।

আমরা মাগরিবের আগে চারজন এক দফা নিয়ে আলোচনা করি। আমি এক দফা ঘোষণার জন্য প্রস্তুত ছিলাম, কারণ পরিস্থিতি খুবই খারাপ ছিল।  আমি বারবার বলছিলাম যে আনু মুহাম্মদ ইতিমধ্যে এক দফা ঘোষণা দিয়েছেন এবং এখনই আমাদের এক দফা দেওয়া উচিত। 

রিফাত এবং মাসুদ প্রথমে এক দফা ঘোষণার জন্য রাজি হয়েছিল, কিন্তু পরে তারা আর ফোন রিসিভ করেনি। নাহিদ ভাই বলেন যে, রাতে নয় বরং পরের দিন সকালে সবার সামনে মিডিয়াতে এক দফা ঘোষণা করা হবে। এক দফার ভিডিও রেডি করা হয়েছিল কিন্তু সেদিন আর প্রকাশ করিনি। কারণ, ৩ তারিখ দিনের বেলা ১ দফা ঘোষণার কথা বলেছিল নাহিদ ভাই।

৩রা আগস্ট সকাল ১১টায় ঘুম থেকে উঠি। রিফাত জানায় যে, সে গাড়িতে উঠেছে এবং তারা শহীদ মিনারের দিকে যাচ্ছে। পরে সকল জল্পনা- কল্পনার সমাপ্তি ঘটিয়ে শহীদ মিনার থেকে এক দফার ঘোষণা করেন।

তবে এই সময়টাতে সকল সিনিয়র প্রকাশ্যে আসায় আমরা যারা জুনিয়র ছিলাম তারা সবাই পিছনে চলে যাই।

৫ তারিখে লং মার্চ টু ঢাকা ঘোষণা করা হয়েছিল। ৪ তারিখ সারারাত ঘুমাইনি। সকাল ৭ টার দিকে ঘুম থেকে উঠলাম। উঠে আশেপাশের খবর নিয়ে জানতে পারলাম সকল রাস্তায় সেনাবাহিনী অবস্থান করছে। সাড়ে বারোটার  দিকে হাসিনা পালানোর খবর পাই। তখন আমরা সবাই শাহবাগের দিকে যাই। শাহবাগে এসে আসিফ ভাইকে ফোন করি, ওনাকে ফোনে না পেয়ে আমি সংসদ ভবনের দিকে আসি। প্রথমে সংসদ ভবনের ভেতরে প্রবেশ করলেও একটু পরে বেরিয়ে আসি। পরে সংসদ ভবনের গেটে দাঁড়িয়ে ছিলাম যাতে কেউ রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট করতে না পারে। একজন ব্যক্তি টাকার ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছিল, যার মধ্যে ৫৬ লাখ টাকা ছিল। পরে আমি সেই টাকা একজন সেনা অফিসারের কাছে হস্তান্তর করি।

এর মধ্যে সেই রিকশাওয়ালা মামা ফোন দিয়ে বলল, ‘মামা আমরা তো জিততা গেছি।’ এই কথা বলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। যা এখনো আমাদের হৃদয়কে তাড়িত করে।

Shera Lather
Link copied!