থমথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস

সারাদেশে মুখোমুখি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন-শিক্ষার্থী

মাইদুর রহমান রুবেল ও সজিব আহমেদ

প্রকাশিত: জুলাই ১৭, ২০২৪, ১০:৪৭ পিএম

সারাদেশে মুখোমুখি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন-শিক্ষার্থী

ছবি, রুপালী বাংলাদেশ

কোটা আন্দোলনকে ঠেকাতে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। একই সাথে আজ (১৭ জুলাই) সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে হল ছেড়ে যেতে বলা হয়েছে শিক্ষার্থীদের। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এমন নির্দেশনা মানতে নারাজ শিক্ষার্থীরা । এক জরুরি সিন্ডিকেড সভায় এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনের সূত্র ধরে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানিয়েছে ঢাবি প্রশাসন। 

হল ত্যাগ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোটা সংস্কারের আন্দোলনকারীরা। তারা বলেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিটির (ইউজিসি) সিদ্ধান্ত মানি না আমরা। আমরা হল ছাড়ছি না। 

সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা নানান স্লোগান দিতে থাকেন, ‘হল ছাড়ার সিদ্ধান্ত মানি না, মানব না; হল আমার বাড়ি ঘর, হল আমি ছাড়ব না; সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত মানি না, মানব না; বাহ্ ভিসি চমৎকার, স্বৈরাচারের পাহারাদার; ভিসি কী করে, ক্যাম্পাসে রক্ত ঝরে’ইত্যাদি শ্লোগানে মুখর ছিলো ক্যাম্পাস। 

আন্দোলনের সমন্বয়ক বলেন, সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত আমরা মানি না। আমরা শিক্ষার্থীদের আহ্বান করছি হল ত্যাগ না করার জন্য। শিক্ষার্থীদের আজকে সন্ধ্যার মধ্যে হলে ফেরার আহ্বান জানাচ্ছি।  আজকে আমরা হেরে গেলে হেরে যাবে বাংলাদেশের। আমাদের আন্দোলন বন্ধ করার জন্য হল ছাড়তে বলা হচ্ছে।

শিক্ষার্থীদের অনড় অবস্থানের কারনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পয়েন্টে বিপুল সংখ্যক পুলিশ, র‌্যাব, আর্মড ফোর্সের সদস্যরা অবস্থান নিয়েছেন। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়কে টহল দিচ্ছে বিজিবির গাড়ি। ক্যাম্পাসের ভিসি চত্বরে অবস্থান করছেন আন্দোলনকারীদের কিছু শিক্ষার্থী। তবে ছাত্রলীগের কোনও নেতাকর্মীকে দেখা যায়নি ক্যাম্পাসে। থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে ক্যাম্পাস জুড়ে। 

এর আগে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষনা দেন সরকার। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ ঘোষনা দেয়া হয়। বুধবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সরেজমিনে ক্যাম্পাসে ঘুরে দেখা গেছে বারবার উত্তপ্ত হয়েছে শিক্ষার্থীদের জ্বালাময়ি শ্লোগানে। আবার তা নিবৃত করতে অ্যাকশানে গেছে পুলিশ। 

বিকেল ৩ টার পর থেকে টিএসসিতে দফায় দফায় সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছে পুলিশ। এসময় পুলিশের ছোড়া শব্দ বোমায় আহত হন বেশ কয়েকজন সংবাদকর্মী। সাউন্ড গ্রেনেডের প্রচণ্ড শব্দে ছত্রভঙ্গ হয়ে যান শিক্ষার্থীরা। এরপর তারা ভিসি চত্বর, মল চত্বরসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নেন।

তবে বেলা ১২টার পর আন্দোলকারীরা রাজু ভাস্করের সামনে অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করলে তাদের সরিয়ে দেয় পুলিশ। পরে তারা অবস্থান নেন ভিসি চত্বরে। কোটার বিষয়টি সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ক্যাম্পাস ছাড়বে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। 

এদিকে দুপুর ১২টার পর শহিদুল্লাহ হলের দিক থেকে শিক্ষার্থীদের একটি মিছিল টিএসসিতে জমায়েত হতে চাইলে পুলিশ-বিজিবি সদস্যরা শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেন। এ সময় সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দও শোনা যায়। পরে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে নিউমার্কেট ও ঢাকা মেডিক্যালের দিকে চলে যান। 

ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ছাত্ররা টিএসসিতে একত্রিত হতে চেয়েছিল। আমরা তাদের সরিয়ে দিতে সাউন্ড গ্রেনেড চার্জ করেছি। পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। 

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ পথ ও ভেতরের বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা সতর্ক অবস্থান নিয়েছেন। নীলক্ষেতের দিকে ঢাবির প্রবেশপথ ‘মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণ’থেকে টিএসসি পর্যন্ত একটু পর পর বিরতি দিয়ে বিজিবি সদস্যরা দল বেঁধে অবস্থান করছেন। এসময় তাদের সঙ্গে জলকামান, রায়ট কারও দেখা গেছে।    

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিজিবির অবস্থান সংবিধানসম্মত নয় মন্তব্য করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরীন বলেছেন, যদি নিরাপত্তা বাহিনী থাকেই, তাদের শিক্ষার্থীদের পক্ষেই থাকতে হবে। নইলে তারা ক্যাম্পাসে থাকতে পারবেন না। সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার সামনে আয়োজিত নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন। 

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে ক্যাম্পাস ছেড়ে পালিয়েছেন ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয় (ঢাবি) ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন ও সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত । সকালে ঢাবির শিক্ষার্থীরা জানায়, আজ সকালে নেতাকর্মীদের নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যান। এরপর ক্যাম্পাস থেকে পালিয়ে যান ঢাবি ছাত্রলীগ সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ (জাবি) সহ একে একে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় । বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শিক্ষার্থীদের সময় উল্লেখ করে হল ছাড়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ হল ছাড়লেও অনেকেই হল না ছেড়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষনা দিয়েছে। 

শিক্ষার্থীদের ‘নিরাপত্তা বিবেচনায়’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে আবাসিক শিক্ষার্থীদের আজ বুধবার (১৭ জুলাই) বিকাল ৪টার মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সকালে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের জরুরি সভার সিদ্ধান্তে জানানো হয়, গত ১৪, ১৫ ও ১৬ জুলাই কোটা আন্দোলনের কারণে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ শিক্ষার্থীরা এখনো চালিয়ে যাচ্ছে আন্দোলন। 

চলমান পরিস্থিতি বিবেচনায়) জরুরি সিন্ডিকেট সভা ডেকে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি কর্তৃপক্ষ। বুধবার সকাল থেকে অনলাইনে চবির সিন্ডিকেট সভা অনুষ্ঠিত হয়। সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বুধবার সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে ছাত্রী হলসমূহ এবং রাত সাড়ে ৬টার মধ্যে ছাত্র হলসমূহ খালি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রভোস্টদের সবগুলো রুম সিলগালা করার নির্দেশ দিয়েছে সিন্ডিকেট। শিক্ষার্থীরা যেন ক্যাম্পাস ছেড়ে যেতে পারে, সেজন্য দুপুর আড়াইটা থেকে রাত পর্যন্ত নিয়মিত শিডিউলে চলবে শাটল ট্রেন। 

এদিকে সিন্ডিকেটের জরুরি সভা ডেকে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) বন্ধ ঘোষণা করে বিকাল ৫টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়া নির্দেশ দিয়েছে প্রশাসন। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত নাকচ করে দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। তবে সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখান করে শিক্ষার্থীরা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন ‘যা হওয়ার হোক, আমরা হল ছাড়বো না’।


 

Link copied!