জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) গোপালগঞ্জ পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত সহিংসতা নিয়ে দেশের রাজনীতিতে নতুন করে তীব্র আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। ঘটনাটিকে কেউ দেখছেন সরকারদলীয় ফ্যাসিবাদী শক্তির ‘ফাঁদ’ হিসেবে, কেউ বলছেন এটি একটি পূর্বপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, যার উদ্দেশ্য আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করা।
গোপালগঞ্জের ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মত দিয়েছেন- এটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ‘ফাঁদ পাতা মাঠ’ ছিল।
তাদের মতে, এনসিপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ বাধিয়ে সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে একটি বার্তা দিতে চেয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, এনসিপি তো অনুমতি নিয়েই গিয়েছিল। যদি প্রশাসন বাধা না দেয়, তবে সংঘর্ষের দায়ও প্রশাসনের।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক কৌশলের অংশ। তারা বলছেন, জুলাই গণআন্দোলনের বর্বরতা আড়াল করতেই সরকার গোপালগঞ্জে নাটক সাজিয়েছে। এর মাধ্যমে ‘পতিত ফ্যাসিস্টের দোসররা’ মাঠে ফেরার সুযোগ নিচ্ছে এবং সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।
ঘটনার কয়েকদিন আগে থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো হয় উসকানিমূলক পোস্ট ও অপপ্রচার। এমনকি বঙ্গবন্ধুর সমাধি ভাঙচুর হতে পারে এমন গুজব ছড়িয়ে উত্তেজনা বাড়ানো হয়। এনসিপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রতিহতের ঘোষণা দিয়ে মাঠে নামানো হয় ‘দুর্বৃত্তদের’- অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
ঘটনার সময় পুলিশের ভূমিকা নিয়েও উঠেছে তীব্র প্রশ্ন। অনেক রাজনৈতিক নেতা অভিযোগ করছেন, পুলিশ হামলা প্রতিহত না করে দর্শকের ভূমিকায় ছিল। টেলিভিশন ফুটেজে দেখা যায়, কিছু পুলিশ সদস্য পেছনের দরজা দিয়ে সরে যাচ্ছেন।
এক বিশ্লেষক বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে পুলিশ সাহস হারিয়েছে। তারা আর আগের মতো সক্রিয় নয়।
তবে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তারা সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নিয়েছে। সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল ব্যবহার করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। চার শতাধিক পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থলে মোতায়েন ছিল। সেনাবাহিনীর সহায়তায় এনসিপি নেতাদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়।
ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, আমি নিজে ঘটনাস্থলে আছি। ঘটনার পূর্ণ তদন্তের জন্য তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিএনপি এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলে, এটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমন করার একটি গভীর নীলনকশা।
দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়িত্বশীলভাবে কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানান।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেন, আমরা বিচারবহির্ভূত সহিংসতা সমর্থন করি না। সরকারের ব্যর্থতাই এই সহিংসতার জন্য দায়ী।
দলের উত্তরাঞ্চলীয় মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, আমরা ভিকটিম, অথচ এখন উল্টো আমাদের দায়ী করা হচ্ছে।
এনসিপির মুখপাত্র আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, পহেলা জুলাই দেশব্যাপী পদযাত্রা কর্মসূচি দেওয়ার পর জনগণের বিপুল সাড়া পাওয়া যায়। কিন্তু গোপালগঞ্জে যাওয়ার আগে আমরা নানাভাবে হুমকি পাচ্ছিলাম। তাই জনগণের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ ঘোষণা করা হয়।
গোপালগঞ্জের সহিংস ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে ফের উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। কেউ একে গণআন্দোলনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলছেন, কেউ বলছেন এটি ক্ষমতাসীনদের শক্তি প্রদর্শনের কৌশল। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ কতটা অবাধ-সুষ্ঠু থাকবে, তা নিয়েও উদ্বেগ বাড়ছে।