ঢাকা রবিবার, ২০ জুলাই, ২০২৫

৩৬ জুলাইয়ের সেই সকাল ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে লম্বা সকাল : রাকিব

বাসস
প্রকাশিত: জুলাই ২০, ২০২৫, ১১:৩১ এএম
মুহাম্মদ রাকিব হোসেন। ছবি- সংগৃহীত

মুহাম্মদ রাকিব হোসেন। ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। রাজপথের যেকোনো আন্দোলনে ছিলেন সম্মুখ সারির যোদ্ধা। ছিলেন ছাত্র অধিকার পরিষদের ঢাকা কলেজ সাংগঠনিক সম্পাদক। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কও ছিলেন। বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টির সংগঠক হিসেবে কাজ করছেন। 

মুহাম্মদ রাকিব হোসেনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলায়। তিনি রামগতি থেকে এসএসসি পাশ করেন। পরে ফেনী সিটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে ঢাকা কলেজে রসায়ন বিভাগে ভর্তি হন। তিনি শিক্ষার্থীদের যে কোনো যৌক্তিক আন্দোলনে সব সময় ছিলেন অগ্রনায়ক। বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের স্মরণ সভায় ছাত্রলীগের হামলায় আহত ও পরে আটক হয়ে দুই মাস জেল খাটেন তিনি।

সম্প্রতি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা জানান মুহাম্মদ রাকিব হোসেন। এছাড়াও জানিয়েছেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে তার অবদান ও অভিজ্ঞতার কথা।

বাসস : কোটা আন্দোলনে আপনি কোথায় এবং কীভাবে জড়িয়ে গেলেন?

মুহাম্মদ রাকিব হোসেন : তৎকালীন ছাত্রলীগ এবং মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতা মামুনের করা রিটে হাইকোর্ট ২০১৮ সালের ৫ জুন পরিপত্র বাতিল করলে কোটা আগের মতো ফিরে আসে। আমি তখন ছাত্র অধিকার পরিষদের ঢাকা কলেজের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলাম। আমরা পার্টি অফিসে এটা নিয়ে আলোচনা করে সন্ধ্যা সাতটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন থেকে দলীয় ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে রাজু ভাস্কর্যে এসে সংক্ষিপ্ত প্রোগ্রামের মাধ্যমে শেষ করি। ১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহাল করার দাবিতে পরের দিন সারাদেশে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। পরে ১ লা জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলন শুরু হয়। 

সেই সময় নিজে যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যেমন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির নাজিম, গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আসাদুজ্জামান রনিসহ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আন্দোলনে যুক্ত করি এবং কেন্দ্রের সাথে যুক্ত করাই। ইডেন কলেজ, বেগম বদরুন্নেসাসহ সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে শুরু থেকেই তাদের আন্দোলনে যুক্ত করাই। এভাবে আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়ি।

বাসস : আন্দোলনে প্রথম কবে বাঁধা পেয়েছিলেন?

মুহাম্মদ রাকিব হোসেন : ৯ জুন সাত কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে নীলক্ষেত মোড়ে সর্বপ্রথম আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সেদিনই নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের হোম ইকোনমিক্স কলেজের সভাপতি আমাদেরকে সেখানে বাঁধা দেয়। পরে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ঢাকা কলেজ-সায়েন্সল্যাব ঘুরে আবার নীলক্ষেত মোড়ে এসে সেদিনের প্রোগ্রাম শেষ করি। 

আন্দোলনের সময়গুলোতে আমাকে এবং নাজমুল ভাইকে (সমন্বয়ক) ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা সোশ্যাল মিডিয়াতে বিএনপি-জামায়াতের পেইড এজেন্টসহ নানা রকম ব্লেইম দিয়ে ভয়ংকরভাবে গুজব ছড়াতে শুরু করে। আমরা হাইকোর্টকে ভুয়া ভুয়া স্লোগান দিয়েছিলাম তারা সেটাকে মার্ক করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সবখানে ভয়ংকরভাবে প্রচার চালিয়েছিল।

বাসস : আপনাদের আন্দোলন একেক দিন একেক নামে হতে থাকে, নামগুলো কীভাবে নির্ধারণ করতেন? 

মুহাম্মদ রাকিব হোসেন : ৭ জুলাই থেকে শুরু হওয়া বাংলা ব্লকেড পুরো আন্দোলন জুড়ে ছিল। এটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল। এরপর একে একে আসে মার্চ ফর জাস্টিস, কমপ্লিট শাটডাউন, মার্চ ফর রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ, প্রোফাইল লাল করা, প্রতিবাদী গানসহ নানা কর্মসূচি আমরা পালন করেছিলাম। নাম ও কর্মসূচিগুলো আমাদের সমন্বয়কদের কোর টিমের মাধ্যমে আসত। পাশাপাশি আমরাও যুক্ত ছিলাম এগুলোর সাথে।

বাসস : বাংলা ব্লকেড নিয়ে আপনার কাছে জানতে চাই?

মুহাম্মদ রাকিব হোসেন : এটি মূলত ৭ তারিখ থেকেই শুরু হয়। ঢাকা কলেজে ইন-কোর্স ও টেস্ট পরীক্ষা থাকায় বাংলা ব্লকেডের শুরুর দিকে আমরা একদমই কম সংখ্যায় ছিলাম। ১লা জুলাই থেকে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন হলের আবাসিক ছাত্রদের কোটা আন্দোলনে না যাওয়ার নির্দেশনা দিয়ে রাখে। তারপরও কয়েকটি হলের অল্প সংখ্যক শিক্ষার্থী আমাদের সাথে আন্দোলনে আসতে থাকে। সেই সময়গুলোতে ইডেনের ছাত্রীরাও যোগ দিতে থাকে। সিটি কলেজ, আইডিয়াল কলেজসহ আশেপাশের কলেজগুলো আমাদের সাথে যোগ দিত। আমরা ঢাকা কলেজ থেকে মিছিল নিয়ে ইডেনের সামনে গিয়ে তাদের একত্রিত করে প্রোগ্রাম শুরু করতাম। আন্দোলনের শুরু থেকেই আমরা স্বতন্ত্র হয়ে আন্দোলন করতাম। সকাল ১১ টার পর শুরু করতাম আর শেষ করতাম দেরিতে। শাহবাগে শুরু হইত বিকাল তিনটা বা সাড়ে তিনটার দিকে। তো এক্ষেত্রে আমরা একটু ব্যতিক্রমী ছিলাম। কেন্দ্রের দাবি অনুযায়ী আলাদা স্থান ও সময়ে আন্দোলন করেছিলাম। কারণ সায়েন্সল্যাব ও নীলক্ষেত ছিল রাজধানীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। ওই দৃষ্টিকোণ থেকে ঢাকা কলেজসহ আশেপাশের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মিলে ৭, ৮ ও ৯ তারিখ পর্যন্ত টানা তিনদিন এখানেই ব্লকেড কর্মসূচি পালন করি। তখন পুলিশের বাধা না থাকলেও নেতৃত্ব পর্যায়ের আন্দোলনকারীদের পুলিশ ও ছাত্রলীগ নানাভাবে হয়রানি করতে থাকে।

বাসস : কোটা সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দেয়ার সময় শিক্ষার্থীদের থেকে যথেষ্ট সাড়া পেয়েছিলেন, সেদিনের বিষয়টি জানতে চাই।

মুহাম্মদ রাকিব হোসেন : আন্দোলনের শুরু থেকে একটা দাবি ছিল ১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহাল করতে হবে। 
সেই আলোকে ক্লাস পরীক্ষা বর্জন, বাংলা ব্লকেডসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হয়েছিল। এরপর ১৪ জুলাই কর্মসূচির অংশ হিসেবে রাষ্ট্রপতি বরাবর কোটার সমস্যা সমাধানে তার হস্তক্ষেপ চেয়ে স্মারকলিপি দেয়ার কর্মসূচি ছিল। সেদিন প্রতিটি ক্যাম্পাস থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে আশেপাশের প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা আসতে থাকে। সেদিন ঢাকা ও ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে বের হলে পুলিশ নীলক্ষেতে বাধা দেয়। তারপরও খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে আমরা ঢাবিতে আসি। সেদিন লাখ লাখ শিক্ষার্থী আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছিল।

সকাল এগারোটার মধ্যে মোটামুটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন ও ঢাকা কলেজসহ আশেপাশের ক্যাম্পাসগুলো ঢাবির সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে চলে আসে। এরপর মার্চ করার জন্য কলাভবনের গেট দিয়ে বের হয়ে শাহবাগ, মৎসভবন, হাইকোর্ট মোড় হয়ে সচিবালয়ে আসি। সেখানে বাধা দেয়া হয়। পরে জিরো পয়েন্টেও বাধা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু শিক্ষার্থীদের চাপের কারণে বঙ্গভবনের দিকে যেতে দিতে বাধ্য হয়। এরপর আমাদের একটি টিম স্মারকলিপি দিয়ে আসে। সেদিন প্রচুর বৃষ্টি উপেক্ষা করে রাস্তায় ছিলাম।

বাসস : ১৪ জুলাই শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের 'রাজাকারের বাচ্চা' বলে সম্বোধনের পর ঢাকা ও ইডেন কলেজ শিক্ষার্থীরা এর প্রতিবাদে ঢাবির শিক্ষার্থীদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন এই ঘটনা জানতে চাই।

মুহাম্মদ রাকিব হোসেন : ঐদিন বিকেলে শেখ হাসিনা প্রেস কনফারেন্সে মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা কোটা পাবে না তো রাজাকারের নাতিপুতিরা কোটা পাবে বলে আন্দোলনকারীদের কটাক্ষ করে। এটা যখন গণমাধ্যমে আসে তখন শিক্ষার্থীরা ফুঁসে ওঠে। আমরা বিক্ষিপ্তভাবে রাতে ১০-২০ জন করে রাজু ভাস্কর্যে গিয়েছিলাম। সেখানে স্লোগান দিয়েছিলাম, ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার রাজাকার’। ‘কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’। ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার।’

সেই প্রোগ্রাম শেষ করে পলাশী মোড় আসতেই  তখন খবর পাই ইডেনের মেয়েরা হলের গেট ভাঙছে। তারাও সেখানে শেখ হাসিনা মন্তব্যের প্রতিবাদে স্লোগান দিচ্ছে। গেট ভেঙে ইডেনের শিক্ষার্থীরা ভিসি চত্বর হয়ে পলাশী হয়ে আবার হলে চলে আসে। সেই সময়টা আমরা ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের নিরাপত্তা দিয়েছিলাম। 

বাসস : ১৫ জুলাই যখন ঢাবিতে হামলা হয় সে সময় আশেপাশের সব ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা সেখানে ছিল, ঢাকা বা ইডেন কলেজ সেদিন আলাদা ছিল কি না?

মুহাম্মদ রাকিব হোসেন : অন্যদিনের মতো সেদিনও ঢাকা ও ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীরা সকাল থেকে সায়েন্সল্যাব এলাকায় আন্দোলন শুরু করে। পরে ১টার দিকে তারা মিছিল নিয়ে রাজুতে চলে আসে। এখানে আসার পর জানতে পারি ঢাবির হলে শিক্ষার্থীদের আটকে রেখেছে ছাত্রলীগ। মিছিল নিয়ে তখন হল পাড়ায় রওনা হই। ওদের উদ্ধার করতে গেলে বিজয় একাত্তর হলে ছাত্রলীগ হামলা করে। সেখানে প্রায় ১৫-২০ মিনিট ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলে। পরে আমরা পিছু হটে ভিসি চত্বরে আসি।

এরপর ২/৩ টার দিকে খবর পাই নীলক্ষেত দিয়ে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের একটি সশস্ত্র দল ভার্সিটিতে ঢুকছে। এদিকে ছাত্রলীগের একটি বড় গ্রুপ মধুর ক্যান্টিনে অবস্থান করছে। কিছুক্ষণ পরই হলপাড়ার ছাত্রলীগ ও ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ ভিসি চত্বরে অবস্থান করা শিক্ষার্থীদের হামলা করে। ওদের সবার হাতে লাঠি, হকিস্টিকসহ নানা দেশীয় অস্ত্র ছিল। তারা শিক্ষার্থীদের উপর্যুপরি পেটাতে থাকে। এক্ষেত্রে সেদিন নারী শিক্ষার্থীরাও রেহাই পায়নি। 
ফুলার রোডের আহতদের মেডিকেল নিয়ে যেতে বাঁধাও দিয়েছিল। ঢাকা মেডিকেলের বহির্বিভাগে গিয়েও তারা হামলা করেছিল। সেসময় নাজমুল ভাইয়ের আহত হওয়ার খবর পাই। আমি নিজেও আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেলে ট্রিটমেন্ট নিয়েছিলাম। সেদিন প্রায় এশার নামাজের আগ পর্যন্ত শহীদুল্লাহ হল এলাকায় থেমে থেমে সংঘর্ষ হয়।

বাসস : আন্দোলন চলাকালে সবুজ নামে ঢাকা কলেজের এক ছাত্রলীগকর্মী মারা যায়। সেদিন মূলত কি হয়েছিল ঐ এলাকায় তা জানতে চাই।

মুহাম্মদ রাকিব হোসেন : ১৬ জুলাই নিরস্ত্র আবু সাঈদকে রংপুরে গুলি করে হত্যা করা হয়। প্রতিবাদে তিনটার দিকে আমরা সায়েন্সল্যাবে অবস্থান করি। সেদিন ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ মারমুখী অবস্থায় কলেজের সামনে অবস্থান করে। সন্ধ্যার দিকে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের একটা অংশ আমাদের সাথে নেগোসিয়েশন করার চেষ্টা করে। আমাদের কিছু সহযোদ্ধা সেসময় টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ভিতর আটকা পড়লে তাদের মারধর করা হয়। সন্ধ্যার সময় ছাত্রলীগ তাদের এক কর্মীকে কলেজের সামনের পেট্রোল পাম্প এলাকায় নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে এর দায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের দেওয়ার চেষ্টা করে। এতে আন্দোলনকারীরা একটু ভয় পেয়ে যায়। কিন্তু মধ্যরাতে জানাজানি হয় ছাত্রলীগের নেতারাই সবুজকে হত্যা করেছে। সেদিন রাতেই হলের শিক্ষার্থীদের চাপে নেতারা হল ছেড়ে পালিয়ে যায়। অন্য ক্যাম্পাসের আগেই মূলত ঢাকা কলেজের হল থেকে নেতারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। 

বাসস : কমপ্লিট শাটডাউন সম্পর্কে জানতে চাই, সে সময় কীভাবে আন্দোলন হয়েছিল।

মুহাম্মদ রাকিব হোসেন : মূলত ১৬ তারিখের পর থেকেই দেশের পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। এরপর সারাদেশ থেকে শুধু লাশের খবর পেতে থাকি। ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার পাশাপাশি কারফিউ জারি করা হয়। পরে আন্দোলনের অংশ হিসেবে কমপ্লিট শাটডাউন শুরু হয়। এরমধ্যে আলোচনা করে নয় দফা দাবি তুলে ধরা হয়। ১৯ তারিখ রাত ১১ টার দিকে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরল হক নুর আমাকে ফোন দিয়ে আন্দোলনের গতিপথ নিয়ে পরামর্শ দেন। সেই সাথে আন্দোলন চালিয়ে নিতে টাকা দেয়ার কথা জানান। পরে জানতে পারি উনি শেষ রাতে গ্রেফতার হয়েছেন। তার গ্রেফতারের পর পর আমি মোবাইল নাম্বার বদল করে আজিমপুরের বাসা ছেড়ে লালবাগ যাই। সেই সময়ে একেক দিন একেক বন্ধুর বাসায় থাকি। সে সময় একা একা আন্দোলনে যেতাম। কেউ যাতে বুঝতে না পারে তাই কাউকে পাঠিয়ে রাস্তার অবস্থা দেখে তারপর বের হতাম। সমন্বয়ক হান্নান মাসুদ, রিফাত রশিদসহ অন্যদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতাম। 

বাসস : ডিবি অফিস থেকে আন্দোলন বন্ধের ঘোষণা আসলেও আপনারা আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। কেনো আন্দোলন বন্ধ করেন নি? 

মুহাম্মদ রাকিব হোসেন : ২৮ জুলাই আমরা হঠাৎ করে জানতে পারি সারজিস-নাহিদ ভাইয়েরা আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন। শোনার পর সাথে সাথেই তা প্রত্যাখ্যান করি। ফেসবুকে এ নিয়ে বেশ লেখালেখি হতে থাকে যে ডিবি অফিস থেকে আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়েছে তা আমরা মানব না। অনেকেই পারসোনালি জানতে চেয়ে নক করেছিল যে আন্দোলন শেষ কিনা, অনেকেই আবার আমাকে আন্দোলন শেষ না করার জন্য সম্বয়কদের সাথে কথা বলার অনুরোধ জানায়। আমি তখন কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে বলি।
আমাদের আন্দোলনের একাধিক স্তর ছিল। আমি হান্নান মাসুদ ও রিফাত রশিদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করতাম। হান্নান মাসুদ আন্দোলনের এক পর্যায়ে আমাকে বলেছিল, ‘যদি আমরাও গুম হই তাহলে আরো একটা গ্রুপ ছিল যে তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবে।’

বাসস : মার্চ ফর জাস্টিস ও প্রোফাইল লাল করা সম্পর্কে জানতে চাই।

মুহাম্মদ রাকিব হোসেন : কারফিউ জারির পর থেকেই শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ এ আন্দোলনের অংশীজনদের  উপর নির্যাতন বাড়তে থাকল। তখন আমরা চিন্তা করলাম এই অন্যায় আর মেনে নেয়া যায় না। ন্যায়বিচারের জন্য আমরা একটা কর্মসূচি দিলাম যা ছিল মূলত মার্চ ফর জাস্টিস।  

রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ ছিল আমাদের আরেকটা কর্মসূচি। কোটার আন্দোলন করতে গিয়ে সারা দেশে যে সকল ভাইয়েরা শহীদ হয়েছিল তাদের স্মরণে এই কর্মসূচিটি ছিল। পাশাপাশি শিল্পী সমাজ ২ আগস্ট শহীদের স্মরণে দ্রোহযাত্রার আয়োজন করেছিল। 

১৬-৩০ জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে পুলিশের গুলি ও ছাত্রলীগের হামলায় প্রায় ৫ শতাধিক প্রাণ ঝরে যায়। এত প্রাণ ঝড়ার পরও সরকার শিক্ষার্থীদের সাথে অমানবিক আচরণ করতে থাকে। এক পর্যায়ে সরকার তাদের হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন দিতে ৩০ জুলাই শোক দিবসের নাটক সাজায়। এদিনও আমরা সরকারের বিপরীতে গিয়ে আমাদের কর্মসূচি ঘোষণা করি। শোক দিবসকে প্রত্যাখান করে আমরা মুখে লাল কাপড় বেধে প্রতিবাদ করি। পাশাপাশি ফেসবুকের প্রোফাইল লাল করে আমাদের শহীদের স্মরণ করি। সেদিনই দেশবাসী শিক্ষার্থীদের পক্ষে রায় দেয়। 

বাসস: আন্দোলনের সময়ে কোথায় কীভাবে ছিলেন, আন্দোলন কীভাবে পরিচালনা করেছেন?

মুহাম্মদ রাকিব হোসেন : আন্দোলনের শুরু থেকেই আজিমপুরে মেসে থেকে আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছি। ১৯ তারিখের পর থেকে আজিমপুর এরিয়ায় পুলিশের অভিযান শুরু হলে গ্রেফতারের আতঙ্ক বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে গ্রেফতার ঠেকাতে আজিমপুর ছেড়ে লালবাগে বন্ধুদের মেসে থাকা শুরু করি। সেই সময়গুলো ভয় আর আতঙ্কে কাটতো। সারাদেশে হত্যাযজ্ঞ দেখে রাতে ঘুমাতে পারতাম না। এমনকি ৫ আগস্ট পর্যন্ত আর একদিনও ঘুমাতে পারিনি। রাত হলেই পাশের ছাদে গিয়ে থাকতাম আর দোয়া পড়তাম। শেষ রাতে বাসায় গিয়ে অল্পসময় ঘুমাতাম। সায়েন্সল্যাবে আন্দোলনে হাজারীবাগ হয়ে যোগ দিতাম। সেই সময় পরিবারের সাথে তেমন যোগাযোগ করতে পারিনি। ১৯ তারিখের পর প্রায় ১০ দিন পরিবারের সাথে যোগাযোগ হয়নি। 

বাসস : আনুষ্ঠানিকভাবে ১ দফা ঘোষণার ঘটনা জানতে চাই। 

মুহাম্মদ রাকিব হোসেন : আন্দোলনের তীব্রতায় ৩০ তারিখের পরই মূলত এক দফার অলিখিত ঘোষণা হয়েছিল। তবুও আনুষ্ঠানিকভাবে এক দফার জন্য ৩ তারিখ শহীদ মিনারে জড়ো হওয়ার নির্দেশনা ছিল। ওইদিন শহীদ মিনারের আশেপাশের এলাকায় যার যার মতো করে উপস্থিত হয়। আমি ঢাকা কলেজ থেকে শিক্ষার্থীদের বিশাল একটি দল নিয়ে উপস্থিত হই। দুইটার পরেই নাহিদ ভাই উপস্থিত হয়ে তার দৃপ্ত কণ্ঠে এক দফা শেখ হাসিনার পদত্যাগের ঘোষণা দেন। এরপর  শহীদ মিনার থেকে মিছিল নিয়ে শাহবাগ যাওয়া হয়। সেখানে প্রায় বিকেল ৫টা পর্যন্ত ছিলাম। 

বাসস : ৫ আগস্ট বিজয়ের প্রেক্ষাপট ও পরবর্তী বিষয় নিয়ে জানতে চাই।

মুহাম্মদ রাকিব হোসেন : ৩৬ জুলাই বা ৫ আগস্ট সকাল ছিল এক শ্বাসরুদ্ধকর দিন। সেদিনের কথা মনে পড়লে শরীর এখনো শিউরে ওঠে। ৫ তারিখ রাতে লালবাগে বন্ধুর বাসায় ছিলাম কিন্তু রাতে ঘুমাতে পারিনি। সারারাত ধরে ওদের সাথে কালকের বিষয়ে আলোচনা করলাম। অনেকটা আতঙ্কও কাজ করছিল। সকাল আটটার দিকে অনলাইন মিডিয়া ফেস দ্য পিপলস-এর সাগর ভাই আমাকে একটা টেক্সট করে আমাদেরসহ সারাদেশের অবস্থা জানতে চাইলেন। 

সকালের দিকে পরিকল্পনা মাফিক ১০ জনের মতো আমরা নীলক্ষেত আসি। এরপর রিক্সায় দু’জন দু’জন করে ভাগ হয়ে শহীদ মিনারের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। আমার সঙ্গে ছিল ফাহাদ, নাজমুল ভাই, আরেক রিকশায় ছিল অভি ভাইসহ আর একজন।  আমি তখন পলাশী হয়ে ঢাকা মেডিকেলের নতুন ভবনে দিকে যাওয়ার চেষ্টা করি। তখনও শহীদ মিনার আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর উপস্থিতি অনেক। দূর থেকে দেখতে পাই মেডিকেলের মোড় থেকে নাজমুল ভাইসহ কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেফতার করে গাড়িতে তুলছে। আমি একটু কৌশল করে ঢাকা মেডিকেলের নতুন ভবনে ঢুকে পড়ি। 

মেডিকেলের ভিতর দিয়ে চানখারপুল এলাকায় গিয়ে মানুষের ঢল দেখতে পাই। তখন আন্দোলনের একমাত্র কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকা। দেড় থেকে দুই হাজার মতো আন্দোলনকারী সেখানে জড়ো হয়েছিল। ছাত্রদলের আবিদ ভাইসহ জনতাকে নিয়ে সংঘটিত হওয়ার চেষ্টা করি। সেখানে প্রায় ঘণ্টাখানিক পুলিশের সাথে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলতে থাকে। এরপর প্রায় সাড়ে ১১ টার দিকে পুলিশ গুলি করা শুরু করে। কিন্তু গুলির উৎস বুঝা যাচ্ছিল না। মুহূর্তেই সবাই ছত্রভঙ্গ হতে থাকে। একসময় বুঝতে পারলাম আমার ডান ও বাম পাশে দু’জন গুলি খেয়ে পড়ে যায়। চোখের সামনে দেখলাম মৃত্যু কীভাবে নিঃশব্দে আসে। আমার হাতের উপরেই কেউ কেউ প্রাণ হারিয়েছিল কিন্তু আমি অল্পের জন্য বেঁচে যাই। 

আহতদের নিয়ে মেডিকেলের ইমার্জেন্সি গেটের দিকে যাওয়া মাত্রই সেখানেও গুলি চলছিল। বার্ন ইউনিটের দিক থেকে স্নাইপার দিয়ে গুলি ছোড়া হচ্ছিল। যাত্রাবাড়িসহ আাশেপাশের এলাকা থেকে মেডিকেলে শুধু লাশ আসতে দেখি। দুপুর পৌনে ১২ পর্যন্ত আমি নিজেই ঢাকা মেডিকেলে কমপক্ষে ২০টা লাশ দেখেছি। কিন্তু কাউকেই চিনতে পারিনি। সবাই ছিল মুক্তিকামী জনতা।

১২ টার দিকে মোবাইলের ডাটা অন করে বুঝতে পারি মোবাইল নেট চালু হয়েছে। নেট চালুর পরপরই আমার মনে হয়েছিল শেখ হাসিনা পালাইছে। পরে কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করি তারাও হাসিনার পালানোর খবর দেয়। পরে শুনতে পাই সেনা প্রধান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। সাথে সাথে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি যা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। আশেপাশের সবাইকে তখন জানাই যে হাসিনা পালাইছে আমাদের শাহবাগ যেতে হবে। পরে মিছিল নিয়ে শাহবাগ চলে আসি। তখন একটা বিষয় লক্ষ করি পুলিশ উধাও হয়ে গেছে। 

৩৬ জুলাইয়ের সেই সকাল ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে লম্বা সকাল। যেন সময় থেমে গিয়েছিল, মানুষ থেমে গিয়েছিল, কেবল গুলি চলছিল আর মানুষ মরছিল। আজও চোখ বন্ধ করলে দৃশ্যগুলো দেখতে পাই। আর মনে হয় এই স্মৃতিগুলো শুধু আমার নয়, এটা আমাদের একটা প্রজন্মের সম্মিলিত ক্ষত যা কখনো মুছবে না।