ঢাকা শুক্রবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৫

পশ্চিম তীরে মসজিদে অগ্নিসংযোগ ও কোরআন পোড়ানোর ঘটনায় বিশ্বসম্প্রদায়ের নিন্দা

বিশ্ব ডেস্ক
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৪, ২০২৫, ১২:৪৫ পিএম
হাজ্জা হামিদা মসজিদ, দেইর ইস্তিয়া, সালফিত, পশ্চিম তীর। ছবি- সংগৃহীত

অধিকৃত পশ্চিম তীরে মসজিদে অবৈধ ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের আগুন দেওয়ার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক সমালোচনা চলছে। বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) ভোরের দিকে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা পশ্চিম তীরের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত সালফিত এলাকার কাছে দেইর ইস্তিয়া গ্রামের হাজ্জা হামিদা মসজিদে আগুন দেন। ওই অঞ্চলে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সহিংসতার মাত্রা অনবরত বৃদ্ধি পাওয়ার মধ্যেই আগুন দেওয়ার এ ঘটনা ঘটেছে। 

ঘটনাস্থল থেকে তোলা ছবিতে দেখা গেছে, মসজিদের দেয়ালে স্প্রে ব্যবহার করে বর্ণবিদ্বেষী ও ফিলিস্তিনবিরোধী স্লোগান লেখা হয়েছে। আগুনে মসজিদের ভেতরের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পবিত্র কোরআনের কিছু কপিও পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।

ফিলিস্তিনের ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ ঘটনাকে ‘জঘন্য অপরাধ’ উল্লেখ করে নিন্দা জানিয়েছে। বলেছে, এর মধ্য দিয়ে অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডটিতে মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত জায়গাগুলোতেও ইসরায়েলি বর্বরতার কথা সামনে এসেছে।

ওয়াফা সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, ওই ঘটনার বাইরে পশ্চিম তীরের দক্ষিণে হেবরনের কাছে বেইত উম্মার শহরে গতকাল এক অভিযানের সময় ইসরায়েলি বাহিনী গুলি চালালে দুই ফিলিস্তিনি শিশু নিহত হয়।

এসব সহিংসতার ঘটনা এমন সময়ে ঘটেছে, যখন কিনা চলতি বছর পশ্চিম তীরজুড়ে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী ও সেনাদের হামলার সংখ্যা রেকর্ড মাত্রায় পৌঁছেছে। এসব হামলার বড় অংশই ঘটছে ২০২৫ সালের জলপাই চাষের মৌসুমকে ঘিরে।

জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক সংস্থা (ওসিএইচএ) তাদের সবশেষ প্রতিবেদনে বলেছে, গত ১ অক্টোবর থেকে জলপাই চাষকে কেন্দ্র করে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের চালানো কমপক্ষে ১৬৭টি হামলার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। এসব হামলায় ১৫০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি আহত ও ৫ হাজার ৭০০টির বেশি গাছ নষ্ট হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের যুদ্ধের আড়ালে পশ্চিম তীরেও ইসরায়েলি হামলা বেড়েছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ৬৯ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

ইতিমধ্যে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর উগ্র ডানপন্থি সরকারের সদস্যরা পশ্চিম তীরকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের দেশের অন্তর্ভুক্ত করতে চাপ দিচ্ছেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ইসরায়েল এখনই পশ্চিম তীরকে কার্যত নিজেদের অংশ বলে বিবেচনা করছে এবং বর্ণবিদ্বেষী আচরণ চালিয়ে যাচ্ছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর গত জুলাই মাসে সতর্ক করে বলেছিল, ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর ‘মৌন সম্মতি, সমর্থন ও কিছু ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের’ মাধ্যমে পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনকারীরা সহিংসতা চালাচ্ছেন।

জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর আরও বলেছে, অধিকৃত পশ্চিম তীরকে আরও ব্যাপকভাবে দখল করার জন্য ইসরায়েলের বৃহত্তর ও সমন্বিত কৌশলের অংশ হিসেবে বসতি স্থাপনকারীরা ও সামরিক বাহিনী এ হামলাগুলো চালাচ্ছে। এর মাধ্যমে সেখানে ফিলিস্তিনিদের ওপর বৈষম্য, দমন–পীড়ন ও নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাকে আরও জোরাল করা হচ্ছে।

‘একেবারেই অগ্রহণযোগ্য’

দেইর ইস্তিয়ার মসজিদে বৃহস্পতিবারের হামলার ঘটনা আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক নিন্দার জন্ম দিয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের একজন মুখপাত্র বলেছেন, জাতিসংঘ এ ঘটনাটি নিয়ে ‘অত্যন্ত উদ্বিগ্ন’। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের ব্রিফিংয়ে স্টিফেন ডুজারিক সাংবাদিকদের বলেন, ‘উপাসনালয়ে এমন হামলা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।’

ডুজারিক আরও বলেন, ‘আমরা পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি ও তাঁদের সম্পদের ওপর ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের চালানো হামলার নিন্দা জানিয়েছি এবং জানিয়ে যাব। দখলদার শক্তি হিসেবে ইসরায়েলের উচিত বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া এবং মসজিদে হামলা ও দেয়ালে স্প্রে করে নোংরা কথা লেখার মতো ঘটনাগুলোয় দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা।’

ফিলিস্তিনি বার্তা সংস্থা ওয়াফা বলছে, জর্ডানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের ক্রমবর্ধমান হামলার ‘তীব্র নিন্দা’ জানিয়েছে। জর্ডানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র এ সহিংসতাকে ইসরায়েল সরকারের উগ্র নীতি ও উত্তেজনাপূর্ণ বক্তব্যের ধারাবাহিকতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যা ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও উগ্রতা উসকে দিচ্ছে।

গাজায় যুদ্ধের পরও ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় সমালোচনার মুখে থাকা জার্মানিও বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ঘটনাগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করতে হবে এবং দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

একইভাবে সুইজারল্যান্ডের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের অগ্নিসংযোগের ঘটনাগুলো ‘অগ্রহণযোগ্য’। এক বিবৃতিতে দেশটি আরও বলেছে, এ ধরনের সহিংসতা এবং অবৈধ বসতি সম্প্রসারণ কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।

ফিলিস্তিনিরা বিশ্বনেতাদের শুধু নিন্দা নয়, বরং দখলকৃত পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকায় চলমান সহিংসতার মধ্যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কাছে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করাসহ আরও কার্যকরভাবে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি।