এম. শামসুল আরেফিন। এনসিসি ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। এর আগে তিনি ব্যাংকটির এএমডি ও ডিএমডি পদেও দায়িত্ব পালন করেছেন। দ্বিতীয় প্রজন্মের এ ব্যাংকটির আর্থিক খাত বেশ মজবুত। স্বচ্ছতা, গ্রাহক-বান্ধব নীতি, এবং ডিজিটাল সেবা সম্প্রসারণের মাধ্যমে ব্যাংকটি কিভাবে আমানত সংগ্রহ করছে তা নিয়ে কথা বলেছেন রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে।
প্রশ্ন : বর্তমানে আপনার ব্যাংকে মোট আমানতের পরিমাণ কত?
উত্তর : বর্তমানে এনসিসি ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ ক্রমবর্ধমান। ২০২৩ সালে আমাদের মোট আমানত ছিল ২৩,৭৭২ কোটি টাকা, যা ২০২৪ সালের শেষে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২৬,৪৩১ কোটি টাকায়। ২০২৫ সালের আগস্ট মাসের শেষে মোট আমানত পৌঁছেছে প্রায় ২৮,৫০০ কোটি টাকায়। এই ধারাবাহিক বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে আমাদের স্বচ্ছতা, গ্রাহক-বান্ধব নীতি, এবং ডিজিটাল সেবা সম্প্রসারণ। ব্যাংকের শাখা নেটওয়ার্ক ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সম্প্রসারণ গ্রাহকদের সুবিধা বৃদ্ধি করেছে এবং তাই আমাদের ওপর তাদের আস্থা ও নির্ভরতা দিন দিন অনেক বাড়ছে।
প্রশ্ন : গত ১-২ বছরে আমানত প্রবাহ কেমন ছিল? বাড়ছে না কমছে?
উত্তর : গত দুই বছরে এনসিসি ব্যাংকের আমানত প্রবাহ ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে রিটেইল গ্রাহকদের আমানতের প্রবৃদ্ধি ২০২৪ সালে ২০২৩ সালের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ইসলামিক ব্যাংকিং ও নারী ব্যাংকিং গ্রাহকদের আমানত বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি গ্রাহকদের আমাদের ব্যাংকের প্রতি বাড়তি আস্থা, আমাদের আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সেবা, এবং স্বচ্ছ ও দ্রুত ব্যাংকিং কার্যক্রমের ফলাফল। ডিজিটাল অ্যাপ, অনলাইন ব্যাংকিং, এবং গ্রাহক বান্ধব পণ্য-সেবার কারণে গ্রাহকরা এনসিসি ব্যাংকে আমানত রাখতে আগ্রহী হচ্ছেন।
প্রশ্ন : বাজারে মন্দা বা সংকট থাকা সত্ত্বেও আপনারা কীভাবে আমানতকারীদের আস্থা ধরে রেখেছেন?
উত্তর: অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, বৈশ্বিক সংকট ও ব্যবসা বাণিজ্যে ধীর গতি থাকা সত্ত্বেও আমাদের মজবুত আর্থিক বুনিয়াদ যা আমাদের বিভিন্ন আর্থিক সূচকের মাধ্যমে প্রতিফলিত হচ্ছে- এর কারণে আমাদের ওপর গ্রাহকদের আস্থা ও নির্ভরতা বাড়ছে। তা ছাড়া আমরা গ্রাহকদের আস্থা ধরে রাখতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং নিরাপদ ব্যাংকিং নিশ্চিত করেছি। আমাদের গ্রাহক-বান্ধব পণ্য, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, ২৪/৭ নিরাপদ লেনদেন ব্যবস্থা এবং দ্রুত গ্রাহকসেবা এই আস্থা ধরে রাখার মূল হাতিয়ার। এ ছাড়া আমরা নিয়মিত গ্রাহক প্রতিক্রিয়া গ্রহণ করি এবং তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন পণ্য ও সুবিধা প্রবর্তন করি, যা আমাদের প্রতি গ্রাহকদের আস্থা আরও বৃদ্ধি করেছে।
প্রশ্ন : বর্তমানে আপনার ব্যাংকে সঞ্চয়, চলতি ও স্থায়ী আমানতের ওপর গড় সুদের হার কত?
উত্তর: আমাদের ব্যাংকে সঞ্চয়, চলতি এবং স্থায়ী আমানতের গড় সুদের হার বাজারের বর্তমান অবস্থা এবং গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী নির্ধারিত। আমরা সাধারণ গ্রাহকদের জন্য প্রতিযোগিতামূলক সুদের হার প্রদান করি এবং নির্দিষ্ট গ্রাহক গোষ্ঠীর জন্য বিশেষ স্কিমের মাধ্যমে আরও উচ্চ সুদের সুবিধা নিশ্চিত করি। উদাহরণস্বরূপ, নারী এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য উচ্চ সুদের স্কিম রয়েছে।
প্রশ্ন : অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় আপনার ব্যাংক কীভাবে প্রতিযোগিতামূলক সুদের হার অফার করে?
উত্তর : আমরা নিয়মিত বাজার বিশ্লেষণ ও গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী সুদের হার নির্ধারণ করি। আমাদের বিশেষ স্কিমগুলো গ্রাহক-বান্ধব এবং বাজারের সমপর্যায়ের অন্যান্য ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক। আমরা গ্রাহকদের জন্য আমানতের কাক্সিক্ষত পর্যায়ের প্রবৃদ্ধি ও মূল্য নিশ্চিত করে নতুন গ্রাহকদের আকৃষ্ট করি।
প্রশ্ন : আমানত সংগ্রহ বাড়াতে ব্যাংক কী ধরনের নতুন পণ্য বা স্কিম চালু করেছে?
উত্তর: আমাদের ব্যাংকের বিভিন্ন আকর্ষণীয় আমানত স্কিম রয়েছে, যেমন- এনসিসি পাওয়ার সেভার, ইন্টারেস্ট ফাস্ট, ফ্রিল্যান্সার, ডাবল বেনিফিট, কোটিপতি স্কিম, মিলিওনিয়ার স্কিম; নারী গ্রাহকদের জন্য রয়েছে পরমা সুপার সেভার, পরমা উদ্যোক্তা, পরমা পাওয়ার সেভার এবং পরমা মাসিক সঞ্চয় স্কিমসহ; শরিয়াহ্ভিত্তিক ইসলামিক ব্যাংকিং পণ্যসমূহ যেগুলো বিভিন্ন গ্রাহক সেগমেন্টের জন্য তৈরি করা হয়েছে যেমন- পেশাজীবী, ফ্রিল্যান্সার, উদ্যোক্তা, দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয়কারী। এ ছাড়া আমরা শিগগরই সিনিয়র সিটিজেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং নি¤œ-আয়ের গ্রাহকদের জন্য নতুন আমানত স্কিম চালু করতে যাচ্ছি।
প্রশ্ন : নারী, সিনিয়র সিটিজেন বা প্রবাসীদের জন্য আলাদা কোনো স্কিম আছে কি?
উত্তর: হ্যাঁ। আমাদের ব্যাংক নারী গ্রাহক এবং প্রবাসীদের জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা পণ্য ও স্কিম চালু করেছে। প্রবাসীদের জন্য অনলাইন অ্যাকাউন্ট খোলা, ওয়ালেট সুবিধা এবং ডিজিটাল লেনদেনের সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে। নারী গ্রাহকদের জন্য যেমন বিভিন্ন রকমের ডিপোজিট স্কিম রয়েছে তেমনি নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ স্কিম সুবিধা ও সাপোর্ট প্রদান করে তাদের আর্থিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য আমরা শিগগিরই আকর্ষণীয় একটি ডিপোজিট স্কিম চালু করার জন্য কাজ করছি- যার মাধ্যমে তারা শুধু আর্থিক নিরাপত্তাই ভোগ করবে না; বরং এই স্কিমের অধীন স্বাস্থ্য বিমা সুবিধা রাখার পরিকল্পনা রয়েছে যা তাদের বাড়তি স্বস্তি দেবে।
প্রশ্ন : মোবাইল ব্যাংকিং বা ডিজিটাল মাধ্যমে আমানত সংগ্রহের উদ্যোগ আছে?
উত্তর: অবশ্যই। আমাদের মোবাইল ব্যাংকিং ও ইন্টারনেট ব্যাংকিং অ্যাপের মাধ্যমে আমানত সংগ্রহের কার্যক্রম চলমান আছে। এ ছাড়া আমরা কিউআর কোড-ভিত্তিক ক্যাশ উইথড্রয়াল, ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট খোলা, এবং ডিজিটাল ন্যানো লোন সুবিধা চালু করার জন্য কাজ করছি। এগুলো গ্রাহকদের জন্য ব্যাংকিং আরও সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করবে।
প্রশ্ন : আমানতকারীদের নিরাপত্তা ও অর্থ সুরক্ষায় আপনার ব্যাংক কী পদক্ষেপ নিচ্ছে?
উত্তর: আমরা প্রতিটি লেনদেনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মাল্টি-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন, ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি), এনক্রিপশন, এবং ২৪/৭ সাইবার সিকিউরিটি মনিটরিং ব্যবস্থা নিয়েছি। এ ছাড়া গ্রাহক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নির্দেশিকা, সচেতনতা প্রচারণা ও নিরাপদ লেনদেনের নিয়মাবলি নিয়মিতভাবে প্রচার করা হচ্ছে।
প্রশ্ন : ডিজিটাল ব্যাংকিং বা অনলাইন মাধ্যমে আমানত রাখার প্রবণতা কতটা বেড়েছে?
উত্তর: ডিজিটাল লেনদেনের মাধ্যমে আমানত রাখার প্রবণতা অত্যন্ত দ্রুত বাড়ছে। গ্রাহকরা এখন শাখায় না গিয়েই যেকোনো সময় ও স্থান থেকে সহজে আমানত করতে পারছেন। এটি গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে সাহায্য করেছে এবং সামগ্রিকভাবে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধি করেছে।
প্রশ্ন : ব্যাংকের নিজস্ব অ্যাপ বা ই-ব্যাংকিং প্ল্যাটফর্মে আমানত ব্যবস্থাপনার কী সুবিধা পাচ্ছে গ্রাহক?
উত্তর: আমাদের ‘এনসিসি অলওয়েজ’ মোবাইল অ্যাপ এবং ‘এনসিসি আইকন’ ইন্টারনেট ব্যাংকিং অ্যাপ এর মাধ্যমে গ্রাহকরা ২৪/৭ সময়ে অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স চেক, ফান্ড ট্রান্সফার, বিল পরিশোধ, মোবাইল রিচার্জ, রেমিট্যান্স গ্রহণ এবং আমানত/ফিক্সড ডিপোজিট পরিচালনা করতে পারছেন। সহজ ইউজার ইন্টারফেস, উন্নত নিরাপত্তা এবং স্বাচ্ছন্দ্যজনক ব্যবস্থাপনার কারণে গ্রাহকরা সর্বোচ্চ পর্যায়ের স্বস্তি ভোগ করছেন।
প্রশ্ন : আপনি মনে করেন, আগামী ১ বছরে দেশের ব্যাংকিং খাতে আমানতের প্রবণতা কেমন থাকবে?
উত্তর: বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, রেমিট্যান্স প্রবাহ ও ডিজিটাল ব্যাংকিং সম্প্রসারণ বিবেচনা করলে আগামী এক বছরে আমানতের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। ব্যাংকগুলোর গ্রাহক-বান্ধব নীতি, ডিজিটাল সেবা সম্প্রসারণ এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধি এই প্রবৃদ্ধিকে আরও সাহায্য করবে।
প্রশ্ন : আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে আপনার ব্যাংক কী ভূমিকা রাখছে? প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমানত সেবা কীভাবে পৌঁছাচ্ছে?
উত্তর: আমাদের ব্যাংক আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। শাখা, উপশাখা, এবং মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কৃষক, ফ্রিল্যান্সার এবং প্রবাসী আয়ভোগীরা এই সুবিধার মাধ্যমে স্বল্প খরচে নিরাপদভাবে আমানত করতে পারছেন।