মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)। আর্থিক পরিষেবা খাতে তিন দশকের অভিজ্ঞতা থাকা মামদুদুর রশীদ এর আগে ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের (এনসিসি) এমডি ও সিইও ছিলেন। সাধারণ গ্রাহক, করপোরেট ক্লায়েন্ট ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের আস্থার বহির্প্রকাশের মাধ্যমে রেকর্ড আমানত প্রবৃদ্ধি অর্জন নিয়ে কথা বলেছেন রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে।
প্রশ্ন: বাজারে মন্দা বা সংকট থাকা সত্ত্বেও কীভাবে আমানতকারীদের আস্থা ধরে রেখেছেন?
উত্তর: আস্থা ধরে রাখা ব্যাংকিংয়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা কয়েকটি বিষয়ে আলাদা গুরুত্ব দিয়েছি। প্রথমত, স্বচ্ছতা, গ্রাহকের টাকা কোথায় ব্যবহার হচ্ছে এবং তাদের কীভাবে সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে, সেটি পরিষ্কারভাবে জানাই। দ্বিতীয়ত, নিরবচ্ছিন্ন সেবা- গ্রাহক ব্যাংকে আসুক বা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করুক, সময়মতো সেবা পেতে হবে। তৃতীয়ত, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময় মানুষ প্রথমেই অর্থের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবেন। এজন্য আমরা আমাদের সাইবার সিকিউরিটি, আইটি অবকাঠামো এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাকে আরও শক্তিশালী করেছি। এসব উদ্যোগের ফলে গ্রাহকরা বুঝেছেন, ইউসিবি তাদের টাকার জন্য একটি নিরাপদ ও বিশ্বাসযোগ্য জায়গা।
প্রশ্ন: বর্তমানে আপনার ব্যাংকে মোট আমানতের পরিমাণ কত?
উত্তর: আমাদের ব্যাংকে প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা আমানত রয়েছে। এটি শুধু সংখ্যার দিক থেকে বড় অর্জন নয়, বরং ইউসিবির প্রতি সাধারণ গ্রাহক, করপোরেট ক্লায়েন্ট ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের অটল আস্থার বহির্প্রকাশ। চলতি বছরের প্রথম আট মাসেই ইউসিবি ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি নেট ডিপোজিট প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে এবং নতুন করে ৪ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। এটি ব্যাংকের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেকর্ড।
প্রশ্ন: গত ১-২ বছরে আমানত প্রবাহ কেমন ছিল?
উত্তর: গত দুই বছরে বৈশ্বিক ও স্থানীয় অর্থনৈতিক মন্দা, মুদ্রাস্ফীতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার চাপ সত্ত্বেও আমাদের আমানতের প্রবাহ ইতিবাচক ছিল। বিশেষ করে খুচরা ও প্রবাসী আমানতের প্রবৃদ্ধি লক্ষণীয়। চলতি বছরের প্রবৃদ্ধি আমাদের জন্য একটি মাইলফলক, আমরা ২০০% নেট ডিপোজিট গ্রোথ অর্জন করেছি, যা ব্যাংকের ইতিহাসে নজিরবিহীন। অনেক ব্যাংকে যেখানে আমানত প্রবাহ স্থবির হয়ে গেছে, আমরা সেখানে নতুন গ্রাহক যুক্ত করতে এবং পুরোনো গ্রাহকদের আস্থা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছি। এর পেছনে আমাদের ডিজিটাল সেবা সম্প্রসারণ, গ্রাহককেন্দ্রিক প্রোডাক্ট এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার কৌশল বড় ভূমিকা রেখেছে।
প্রশ্ন: বর্তমানে সঞ্চয়, চলতি ও স্থায়ী আমানতের ওপর গড় সুদের হার কত?
উত্তর: বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী আমাদের সুদের হার নির্ধারিত হয়। বর্তমানে সঞ্চয়ী হিসাবে গড়ে ১.৫০%-২.৫০%, স্থায়ী আমানতে ৯.৫০%-১০.৫০% পর্যন্ত সুদ দেওয়া হচ্ছে। চলতি হিসাবে সাধারণত সুদ দেওয়া হয় না, তবে কিছু করপোরেট অ্যাকাউন্ট বা বিশেষ ক্ষেত্রে সামান্য হারে সুদ প্রযোজ্য হতে পারে। সুদের হারের পাশাপাশি আমরা গ্রাহক সেবাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি, কারণ উন্নত গ্রাহক সেবাই সফলতার মূল ভিত্তি।
প্রশ্ন: অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় আপনারা কীভাবে প্রতিযোগিতামূলক সুদের হার অফার করেন?
উত্তর: আমরা বিশ্বাস করি, গ্রাহকের মূল্যায়ন মানে শুধু সুদের হার বাড়ানো নয়। প্রতিযোগিতামূলক হার অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তবে আমরা তার সঙ্গে দিই অতিরিক্ত সুবিধা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- আমাদের ডিজিটাল ব্যাংকিং প্ল্যাটফর্ম, তাৎক্ষণিক ফান্ড ট্রান্সফার সুবিধা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সিস্টেম এবং গ্রাহকের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়ে বিশেষায়িত প্রাহক সেবা।
প্রশ্ন: আমানত সংগ্রহ বাড়াতে নতুন কী ধরনের পণ্য চালু করেছেন?
উত্তর: ইউসিবিতে সকল শ্রেণির গ্রাহকের জন্য বিভিন্ন ধরনের ডিপোজিট প্রোডাক্ট রয়েছে। ফ্লেক্সিবল ডিপোজিট স্কিম, যেখানে গ্রাহক চাইলে মাসিক ছোট অঙ্ক জমা দিয়ে একটি নির্দিষ্ট সময় পর বড় অঙ্ক পেতে পারেন; ডাবল মানি স্কিম, যেখানে নির্দিষ্ট সময়ে আমানত দ্বিগুণ হয়; এবং মাসিক আয় স্কিম, যেখানে অবসরপ্রাপ্ত বা স্থায়ী আয়ের বাইরে থাকা গ্রাহকরা তাদের টাকার বিপরীতে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট অঙ্ক পান। এগুলো খুচরা গ্রাহকদের মধ্যে বিশেষ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
প্রশ্ন: নারী, সিনিয়র সিটিজেন বা প্রবাসীদের জন্য আলাদা কোনো স্কিম আছে?
উত্তর: অবশ্যই আছে। নারী গ্রাহকদের জন্য আমরা বিশেষ সঞ্চয় স্কিম চালু করেছি, যেখানে তারা বাড়তি সুদের পাশাপাশি সহজ শর্তে সঞ্চয় করতে পারেন। সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য অতিরিক্ত সুদের হার এবং দ্রুত সেবা প্রদানের বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য আমরা রেমিট্যান্স-লিঙ্কড ডিপোজিট সেবা চালু করেছি, যাতে তারা দেশে টাকা পাঠানোর পাশাপাশি নিরাপদে সঞ্চয় করতে পারেন।
প্রশ্ন: মোবাইল ব্যাংকিং বা ডিজিটাল মাধ্যমে আমানত সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছেন কি?
উত্তর: হ্যাঁ, এটি আমাদের অগ্রাধিকারের তালিকায় আছে। ইউসিবির রয়েছে আধুনিক ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবা ইউনিট এবং মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ইউপে। এগুলোর মাধ্যমে গ্রাহকরা সহজেই টাকা জমা, স্থানান্তর, বিল পরিশোধ ও সঞ্চয় করতে পারেন। অনেক তরুণ ও প্রবাসী গ্রাহক এখন সরাসরি আমাদের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অ্যাকাউন্ট খোলা থেকে শুরু করে সব ধরনের ব্যাংকিং সেবা উপভোগ করছেন।
প্রশ্ন: আমানতকারীদের অর্থের নিরাপত্তায় আপনার ব্যাংক কী পদক্ষেপ নিয়েছে?
উত্তর: আমানতকারীদের অর্থের নিরাপত্তাকে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকি। সাইবার নিরাপত্তায় বিশেষ জোর দিচ্ছি। গ্রাহকের প্রতিটি লেনদেন এনক্রিপ্টেড এবং মাল্টি-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশনের মাধ্যমে সুরক্ষিত করা হয়েছে। এ ছাড়া ফ্রড মনিটরিং সিস্টেম, রিয়েল-টাইম অ্যালার্ট এবং আন্তর্জাতিক মানদ- অনুসারে সিকিউরিটি অডিট করা হয়। অর্থাৎ শুধু সুদের প্রতিশ্রুতি নয়, আমরা গ্রাহকের অর্থ নিরাপদ রাখার জন্য প্রতিটি পদক্ষেপে দায়িত্বশীল।
প্রশ্ন: ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আমানত রাখার প্রবণতা কতটা বেড়েছে?
উত্তর: কোভিড-১৯-এর পর থেকে মানুষের ব্যাংকিং অভ্যাসে বড় পরিবর্তন এসেছে। আগে যেসব গ্রাহক কেবল শাখায় গিয়ে লেনদেন করতেন, তারাও এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছেন। বর্তমানে আমাদের মোট লেনদেনের প্রায় ৬৫%-৭০% অনলাইন ও মোবাইল ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে। নতুন প্রজন্মের গ্রাহকরা বিশেষভাবে ডিজিটাল সেবা ব্যবহার করছেন, যা আমাদের জন্য ইতিবাচক ইঙ্গিত।
প্রশ্ন: আপনার ব্যাংকের অ্যাপ বা ই-ব্যাংকিং প্ল্যাটফর্মে আমানত ব্যবস্থাপনায় গ্রাহক কী সুবিধা পাচ্ছে?
উত্তর: আমাদের ইউসিবি ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবা ইউনেটের মাধ্যমে গ্রাহকরা ব্যালেন্স চেক থেকে শুরু করে ডিপিএস/এফডি খোলা পর্যন্ত সবকিছু ঘরে বসেই করতে পারছেন। তারা যেকোনো সময় ই-স্টেটমেন্ট ডাউনলোড করতে পারেন, অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন এবং লেনদেন করতে পারেন ইউটিলি বিল জমা দিতে পারেন, এমনকি গাড়ির টোলও পরিশোধ করতে পারেন। অর্থাৎ এখন গ্রাহকের কাছে ব্যাংক মানেই কেবল শাখা নয় বরং একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম যা ২৪ ঘণ্টা তার হাতের মুঠোয়।
প্রশ্ন: আগামী ১ বছরে দেশের ব্যাংকিং খাতে আমানতের প্রবণতা কেমন হবে বলে মনে করেন?
উত্তর: অর্থনীতি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। আমরা আশা করছি, আগামী এক বছরে আমানতের প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক হবে। বিশেষ করে খুচরা আমানত এবং ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আসা সঞ্চয় বাড়বে। প্রবাসী আয়ের প্রবাহও ব্যাংকিং খাতের আমানত বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। তবে এর জন্য ব্যাংকগুলোকে আস্থা ধরে রাখতে হবে এবং প্রযুক্তির নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
প্রশ্ন: আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে আপনার ব্যাংক কী ভূমিকা রাখছে?
উত্তর: ইউসিবি সবসময় বিশ্বাস করে- দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে হলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। এজন্য আমরা এজেন্ট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং এবং শাখাহীন ব্যাংকিং কার্যক্রমের মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকায় পৌঁছেছি। এখন গ্রামের মানুষও সহজে সঞ্চয় করতে পারছে, রেমিট্যান্স তুলতে পারছে এবং ছোট ঋণ পাচ্ছে। এতে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ছে এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।