শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো ভিলেজে আগুনের ঘটনা তদন্তে এবার পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার গতকাল সোমবার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ছাড়াও এরই মধ্যে এ ঘটনায় আরও বেশ কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগুনের ঘটনায় তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। এ বিষয়ে কারো কোনো গাফিলতি রয়েছে কি না, বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করছে সংশ্লিষ্টরা। এদিকে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা সামনে এলেও- ক্ষতিগ্রস্তদের দাবিÑক্ষতিপূরণ কে দেবে বা আদৌ দেবে কি না, তা নিয়ে কারো কোনো ধারণা এখনো নেই। অর্থনৈতিক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি দেশে তিনটি আগুনের বড় ঘটনা ঘটেছে। সব অর্থনৈতিক খাতসংশ্লিষ্ট। তাই এসব ভালোমতো তদন্ত করা উচিত। আসলেই অগ্নিদুর্ঘটনা না কি পূর্বপরিকল্পিত প্রশ্ন থেকে যায়? সাবেক অর্থনৈতিক বিশ্লেষক দিলারা হাফিজ জানান, আগুনের সঠিক তদন্ত না করতে পারলে জনসম্মুখে অনেক প্রশ্ন থেকে যাবে, যে কারণে সরকারকে এর সঠিক ঘটনা সামনে আনতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের অপারেশন ও মেইনটেইন্যান্স শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আগুনের ঘটনায় আমাদের তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। কারো গাফিলতি রয়েছে কি না, সেটা মাথায় রেখে তদন্ত কমিটি কাজ করছে।’
এর আগে গত শনিবার দুপুরে শাহজালালের আমদানি কার্গো ভিলেজে আগুনের ঘটনা ঘটে। এরপর ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট, পুলিশ, আনসার, র্যাব, এপিবিএন, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রাত ৯টার কিছু পরে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এ ঘটনায় একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সব তদন্ত কমিটি এরই মধ্যে কাজও শুরু করেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, সঠিক মতে ফায়ার সার্ভিসকে কাজ করতে দেওয়া হয়নি। এসব সমালোচনার পর বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এস এম রাগীব সামাদ বলেছেন, বিমানবন্দরে আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি দেরিতে ঢুকেছে বলে যেসব প্রশ্ন উঠেছে, সেটি ‘সত্য নয়’। তবে এ ঘটনায় কারো গাফিলতি রয়েছে কি না, সেটা তদন্তের পর জানা যাবে। তদন্ত সূত্রমতে, যেখানে আগুনের সূত্রপাত, সেখানে স্টিলের স্ট্রাকচার থাকায় আগুন অনেকক্ষণ ধরে জ্বলেছে এবং বহুক্ষণ ধোঁয়া উড়েছে। সেই সঙ্গে বাতাসের কারণে অক্সিজেন সরবরাহ থাকায় আগুন নেভাতে সময় লেগেছে।
বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক ক্যাপ্টেন এস এম রাগীব সামাদ বলেন, ‘প্রশ্ন আসতে পারে, তারা এটা রক্ষণাবেক্ষণ করেছে কি না, আমরা যাচাই করেছি কিনা। এই ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’টা সব সময় করা আমাদের সম্ভব হয় না। এর ব্যবস্থা করা অবশ্যই ওই প্রতিষ্ঠানের বা অ্যাসোসিয়েশনের দায়িত্ব।’
বেশ কয়েকটি তদন্ত কমিটি হয়েছে, তারা নিশ্চয়ই চুলচেরা বিশ্লেষণ করবে: বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক
আমদানি কার্গো এলাকায় ১৩২টি ফায়ার এক্সটিংগুইশার বোতল ছিল। সেই সঙ্গে চলতি বছরের জুন মাসেও বিমানবন্দরের ফায়ার ইউনিট এগুলো কীভাবে ব্যবহার করবে, সে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল বলে জানান রাগীব সামাদ। এসব তথ্য নথিবদ্ধ থাকার কথাও বলেন তিনি। একইভাবে টার্মিনালেও প্রতিদিনই বিভিন্ন অফিস, লাউঞ্জে ফায়ার এক্সটিংগুইশার ব্যবহার করতে হয়। এটা আমাদের লগবুকেও রেকর্ড আছে। আগুনের সূত্রপাত কীভাবে হয়েছে জানতে চাইলে সম্ভাব্য কয়েকটি কারণের কথা বলেন বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেন, বেশ কয়েকটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। তারা নিশ্চয়ই চুলচেরা বিশ্লেষণ করবে এবং বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন দেবে। তবে আমাদের টাওয়ার থেকে যখন জানিয়েছে, আমাকে বলা হয়েছিল, আট নম্বর গেটের পাশে কুরিয়ার সার্ভিসের আশপাশ থেকে আগুনটা হয়েছে। তার ধারণা, এখানে কয়েকভাবে অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তিনি বলেন, ওখানে (অগ্নি দুর্ঘটনাস্থলে) তাদের লোক সাধারণত ছুটির দিনে থাকে না। সে দিন ছুটি থাকায় যেকোনো কিছু হতে পারে।
রাগীব সামাদ বলেন, যদি মানুষ থাকত, তাহলে হয়তো মনুষ্যঘটিত দুর্ঘটনার একটি সম্ভাবনা থাকতে পারত। সেটা না হলে হয়তো একটি বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের ঘটনা হতে পারে। এরকম সম্ভাব্য কিছু কারণ হতে পারে। কিন্তু প্রাথমিকভাবে আমাদের ধারণা, ওই কুরিয়ার অফিস থেকেই আগুনটা হয়েছে। কিন্তু ঠিক কী কারণে আগুনের সূত্রপাত, এটা নিশ্চয় তদন্তকারী কমিটি উদঘাটন করতে পারবে।
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের যে ফায়ার ইউনিট রয়েছে, সেটিকেও ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল না, এমন একটি গুঞ্জনও ছড়িয়েছে। এটিও নাকচ করে দিয়েছেন তিনি। রাগীব সামাদ বলেন, অগ্নিকা-ের পরপর একটি বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ায়, বিমানবন্দরের পার্কিং এলাকার একজন সুপারভাইজার এসে বলেছে, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এটা বিভ্রান্তিকর তথ্য। বেসামরিক বিমান মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দেশের প্রধান বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন লেগেছে বেলা ২টা ১৫ মিনিটে। সে সময়ের ঘটনার বিবরণ দিয়ে বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘প্রাথমিক তথ্যটা টাওয়ার (নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার) থেকে প্রথম আমাকে জানায়। তখনই আমি বলেছি, ‘ফায়ার ভেহিক্যাল মুভ করেছে?’ ওরা বলেছে, ‘জি স্যার, মুভ করেছে।’ ফায়ার সার্ভিসকে কি জানানো হয়েছে? বলেছে, ‘না স্যার, আমরা কল দেব।’
সম্প্রতি তিনটি আগুনের বড় ঘটনায় অর্থনৈতিক খাত কেন?
এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি দেশে পরপর তিনটি আগুনের ঘটনা ঘটে। সব অর্থনৈতিক খাতসংশ্লিষ্ট। এ মাসের ১৪ তারিখ মিরপুরের একটি গার্মেন্টস কারখানায় আগুনে ১৬ জন শ্রমিক-কর্মচারী মারা যান। পুড়ে যায় কারখানাটি। এরপর চট্টগ্রাম ইপিজেডে একটি টেক্সটাইল কারখানা পুড়ে কংকাল হয়ে যায়। তারপর ঢাকা শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে স্মরণকালের ভয়াবহ আগুন। এসব আগুনে ১৬টি প্রাণহানিসহ হাজার কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়।
দেশে সব ধরনের পণ্যে দাম বাড়তে পারে:
ওদিকে এসব বিষয়ে সিঅ্যান্ডএফের একাধিক এজেন্টরা বলছেন, এখন থেকে প্রতিদিন আসা মালামাল রাখার সক্ষমতা ঢাকা বিমানবন্দরের নেই। তা ছাড়া বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল ছাড়াও জুতা, ব্যাগ বা জুয়েলারির মতো বাজারে বহু ধরনের পণ্য সরবরাহ কমে যেতে পারে। সেই সঙ্গে দেশে সবকিছুর দামও বাড়তে পারে। এদিকে শনিবারের আগুনে এখন পর্যন্ত ২০০ কোটি টাকার বেশি কাঁচামাল পুড়ে শেষ হওয়ার তথ্য দিয়েছে তাদের ৩২টি কোম্পানি। পূর্ণাঙ্গ তথ্য পেলে ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বাড়তে পারে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এর বাইরে ছোট-বড় অনেক প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পরিমাণ পণ্য পুড়ে গেলেও তারা কোনো ক্ষতিপূরণ পাবেন কি না, ক্ষতিপূরণ দেবে কি না, তা নিয়ে কারো কোনো ধারণা এখনো নেই।
বৃষ্টি হলেও ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে:
ওদিকে কার্গো ভিলেজে পুড়ে যাওয়া পণ্য বা ক্ষয়ক্ষতির চেয়ে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিমানবন্দরে নতুন আসা বিপুল পরিমাণ পণ্য রাখা ও এর ব্যবস্থাপনা নিয়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বিমানবন্দরের ৯ নম্বর গেটে একটি অস্থায়ী শেড করা হয়েছে নতুন আসা পণ্য রাখার জন্য। একই সঙ্গে কাস্টমসের এক সভায় ‘যে দিনই মাল আসবে সে দিনই খালাসের ব্যবস্থা’ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং এজেন্ট বা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এবং আমদানিকারকরা বলছেন, যে ব্যবস্থা করা হয়েছে তা খুবই অপ্রতুল এবং যেভাবে রাখা হচ্ছে তাতে বৃষ্টি হলেও ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। তারা বলছেন, শনিবারের আগুনে ক্ষতির পরিমাণ ও ক্ষতিপূরণ বিষয়ে এখনো কর্তৃপক্ষের দিক থেকে আশ্বস্ত হওয়ার মতো কোনো কিছু তাদের জানানো হয়নি।
কার্গো ভিলেজে আগুনের ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিসের ৫ সদস্যের কমিটি: ফায়ার সার্ভিসের পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছেÑ ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে। সদস্য করা হয়েছে- ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা জোন-৩-এর উপসহকারী পরিচালক মো. আব্দুল মান্নান, কুর্মিটোলা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো. নাহিদ মামুন ও ফায়ার সার্ভিস ঢাকা-১৯-এর ওয়্যার হাউসের ইন্সপেক্টর মো. তোজাম্মেল হোসেন। সদস্য সচিব করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক মো. ছালেহ উদ্দিন।
এর আগে গত ১৮ অক্টোবর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আগুনের ঘটনায় সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। কমিটিকে আগামী পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কমিটিতে বিমানের ফ্লাইট সেফটি শাখার প্রধানকে সভাপতি এবং ইন্স্যুরেন্স শাখার উপব্যবস্থাপককে সদস্য সচিব করা হয়েছে। এ ছাড়া বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি, করপোরেট সেফটি অ্যান্ড কোয়ালিটি শাখার মহাব্যবস্থাপক, কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স শাখার প্রধান প্রকৌশলী, নিরাপত্তা শাখার উপমহাব্যবস্থাপক, কার্গো রপ্তানি শাখার উপ-মহাব্যবস্থাপককে তদন্ত কমিটির সদস্য করা হয়েছে। গত ১৯ অক্টোবর কার্গো ভিলেজে অগ্নিকা- তদন্তে স্বরাষ্ট্র সচিব নাসিমুল গনির নেতৃত্বে ৭ সদস্যের কোর কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি আগামী ৫ নভেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।