বাংলাদেশে বিনিয়োগের সীমাবদ্ধতা কমাতে ধীরে ধীরে অগ্রগতি অর্জন করলেও এখনো বাধা রয়েছে। বাংলাদেশে বিনিয়োগের বাধার জন্য পাঁচটি কারণ চিহ্নিত করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ২০২৫ সালের বৈশ্বিক বিনিয়োগ পরিবেশ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। যা গত ২৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়েছে।
ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদনে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ওপর অসম করের বোঝা, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং সীমিত অর্থায়নের উৎস বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বিশেষত মার্কিন বিনিয়োগ আকর্ষণে প্রধান অন্তরায় বলে উল্লেখ করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক দশকে বাংলাদেশ বিনিয়োগের অন্তরায় দূর করতে ধীরে ধীরে অগ্রগতি সাধন করেছে, যার মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার উদ্যোগ অন্যতম। তবে বিদেশি বিনিয়োগ এখনো নানাবিধ স্থায়ী সমস্যার কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে; যেমন অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, সীমিত অর্থায়নের সুযোগ, প্রশাসনিক বিলম্ব, বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ওপর অসম করভার এবং দুর্নীতি।
সরকারের বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির সংস্কারমূলক কার্যক্রম এখনো প্রাথমিক বাস্তবায়ন পর্যায়ে রয়েছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধীরগতি এবং দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারব্যবস্থাÑ যা বর্তমানে সংস্কারের আওতায় রয়েছে এবং বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়ার সীমাবদ্ধতা, সময়মতো চুক্তি বাস্তবায়ন ও ব্যাবসায়িক বিরোধের ন্যায়সঙ্গত নিষ্পত্তিকে ব্যাহত করছে বলেও এতে দাবি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সরকারের মেধাস্বত্ব এবং শ্রম অধিকার সংরক্ষণ কার্যক্রম এখনো অকার্যকর। মেধাস্বত্ব সুরক্ষায় সরকার পর্যাপ্ত সম্পদ বরাদ্দ দেয় না। গত এক দশকে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পে অগ্নি ও ভবন নিরাপত্তা মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অগ্রগতি অর্জন করলেও শ্রমিকদের সংগঠন গঠন ও যৌথ দরকষাকষির অধিকার চর্চার ক্ষেত্রে এখনো গুরুত্বপূর্ণ আইনি বাধা বিদ্যমান।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, দুর্নীতি বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য একটি গুরুতর বাধা হিসেবে রয়ে গেছে। জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী সম্মেলনের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশে ঘুষ ও দুর্নীতি মোকাবিলায় আইন রয়েছে, তবে আইন প্রয়োগ অনিয়মিত।
দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারের প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও এটি এখনো সরকারি ক্রয়-বিক্রয়, কর ও শুল্ক সংগ্রহ এবং নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের মধ্যে ব্যাপকভাবে বিদ্যমান। কিছু অনুমান অনুযায়ী, ব্যবসায়ীদের গোপন পেমেন্টের কারণে বাংলাদেশের জিডিপি দুই থেকে তিন শতাংশ পর্যন্ত কমে যায় বলে স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকার দুর্নীতিবিরোধী প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করলেও, বিরোধী দলগুলো অভিযোগ করেছিল, দুর্নীতি দমন কমিশনকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের হয়রানির জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দুর্নীতি প্রতিরোধে আরও কঠোর মনোভাব গ্রহণের সংকেত দিয়েছে। ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে এটি নতুন নেতৃত্ব নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন পুনর্গঠন করেছে, বলা হয় প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের মেধাস্বত্ব এবং শ্রম অধিকার প্রয়োগ কার্যকর নয়। অন্যদিকে, জাল পণ্য সহজলভ্য এবং সরকার মেধাস্বত্ব সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয় না বা তাতে যথেষ্ট বিনিয়োগ করে না। যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো তৈরি পোশাক, ভোগ্যপণ্য, সিনেমা, ওষুধ এবং সফটওয়্যারে মেধাস্বত্ব লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছে।
প্রতিবেদন বলেছে, অন্তর্বর্তী সরকার শেখ হাসিনার শাসন আমলে প্রণীত প্রথা বাতিলের চেষ্টা করছে, যা বৈদেশিক বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টি করত। যেমন- সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কর্তৃক বিদেশি মুদ্রায় বিলম্বিত অর্থ প্রদান এবং দেশের বাইরে থেকে বিদেশি মুদ্রা স্থানান্তরের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতির বাধ্যবাধকতা।
বাংলাদেশে বিদেশি মুদ্রার ঘাটতি তৈরি হয়েছিল যখন দেশের কয়েকটি বড় ব্যাংক নিয়মবহির্ভূত ঋণ প্রদান করেÑ যা শাসক আওয়ামী লীগের কিছু সদস্যের সঙ্গে জড়িত কোম্পানিগুলোকে দেওয়া হয়েছিল এবং পরে এ ঋণগুলো পরিশোধ করা হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কু-ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ২৮ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলারে। অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংকিং খাতের সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, যেন এ খাত আন্তর্জাতিক সেবা অনুশীলনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদচ্যুত করার পর অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র প্রশাসন সংস্কারে কাজ শুরু করেছিল, তবে বড় পরিবর্তন ঘটেনিÑ দাবি করা হয় প্রতিবেদনে।
সেখানে আরও বলা হয়েছে, সরকার তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে কিছু সরকারি সেবার স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বাড়াতে ধাপে ধাপে অগ্রগতি করেছে। তবে নিয়মাবলি প্রায়ই অস্পষ্ট, অসঙ্গত বা সাধারণ জনগণের কাছে প্রকাশিত নয়। ফলে বিনিয়োগকারীদের সঠিক মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করা, যেমন নির্দিষ্ট শিল্পে ভর্তুকি কঠিন হয়ে পড়ে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছাত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর কয়েক সপ্তাহ ধরে সহিংস দমন-পীড়নের পর ৫ আগস্ট, ২০২৪ সালে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নেতৃত্ব দিয়ে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রশাসনের সংস্কারের কাজ শুরু করে, কিন্তু দৈনন্দিন নিয়ন্ত্রক দৃশ্যপটের বেশির ভাগই অপরিবর্তিত রয়েছে।