ঢাকা মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

বিক্ষোভ-সহিংসতায় থমথমে খাগড়াছড়ি

রূপালী প্রতিবেদক ও খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি 
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৫, ০১:০৫ এএম
  • সহিংসতায় ভারত বা ফ্যাসিস্টদের ইন্ধন আছে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
  • নিহত তিনজনের পরিচয় শনাক্ত
  • দুই সড়কে অবরোধ শিথিল
  • ভুক্তভোগী পরিবারের নিরাপত্তা ও বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি আসক ও এইচআরএফবির 

মারমা স্কুলছাত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় বিক্ষোভ ও সহিংসতাকে কেন্দ্র করে এখনো থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে খাগড়াছড়িতে। ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত সব আসামিকে গ্রেপ্তার ও বিচারসহ আট দফা দাবিতে তিন পার্বত্য জেলায় চলছে জুম্ম ছাত্র-জনতার ডাকা অনির্দিষ্টকালের অবরোধ। এ ছাড়া প্রশাসনের জারি করা ১৪৪ ধারা অব্যাহত রয়েছে। অবরোধের কারণে খাগড়াছড়িতে দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। তবে দুই সড়কের অবরোধ শিথিল করেছে অবরোধকারীরা। লাশ সৎকার ও আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য অবরোধ শিথিল করা হয়েছে বলে এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। তবে অন্যান্য সড়কে অবরোধ চলবে। তবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, খাগড়াছড়ির সহিংসতার ঘটনায় ভারতের বা ফ্যাসিস্টদের ইন্ধন রয়েছে। শান্তিপূর্ণভাবে যাতে দুর্গাপূজা না হয়, একটি মহল সেই চেষ্টা চালাচ্ছে। এই মহলই খাগড়াছড়িতে এসব করছে। 

এদিকে গত রোববারের সহিংসতায় নিহত তিনজনের পরিচয় মিলেছে। নিহতরা সবাই খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলার বাসিন্দা। নিহতরা হলেনÑ গুইমারা সিন্দুকছড়ি ইউনিয়নের দেবলছড়ি চেয়ারম্যানপাড়ার আথুই মারমা (২১), হাফছড়ি ইউনিয়নের সাং চেং গুলিপাড়ার আথ্রাউ মারমা (২২) ও রামসু বাজার বটতলার তৈইচিং মারমা (২০)।

খাগড়াছড়িতে সহিংসতার ঘটনায় পাহাড়ি তিন নাগরিক নিহত, বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত, হামলা, গুলি, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ও হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি)। একই সঙ্গে ধর্ষণের শিকার কিশোরী ও তার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রমাণভিত্তিক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা দুটি। 

টানা তৃতীয় দিনের মতো খাগড়াছড়ি জেলায় সড়ক অবরোধ চলছে। গতকাল সকাল থেকে সদরে অল্প কিছু অটোরিকশা চলাচল করতে দেখা যাচ্ছে। তবে দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ আছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সাধারণ মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। বিভিন্ন স্থানে বাজারের কাঁচামালবাহী ট্রাক ও পিকআপ আটকে থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। ১৪৪ ধারা জারি থাকায় বাজারের দোকানপাট বন্ধ। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে না পারায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে সাধারণ মানুষ।

গত শনিবার ও রোববারের সহিংসতার পর খাগড়াছড়ি ও গুইমারা উপজেলায় ১৪৪ ধারা বহাল রেখেছে স্থানীয় প্রশাসন। বিভিন্ন স্থানে পুলিশ, আর্মড পুলিশ, বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে এবং সেনাবাহিনীকে রাস্তায় রাস্তায় টহল দিতে দেখা গেছে।

গতকাল সোমবার ৮টার দিকে খাগড়াছড়ি পৌর শহর ঘুরে দেখা যায়, সড়কে দু-একটি অটোরিকশা চলাচল করছে। বন্ধ রয়েছে দোকানপাট। মোড়ে মোড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান করছেন। এক-দুজনের বেশি মানুষ একসঙ্গে দেখলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

এর আগে শনিবার দুপুর ২টা থেকে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা ও খাগড়াছড়ি পৌরসভায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। একই সঙ্গে গুইমারা উপজেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা অব্যাহত রয়েছে।

অবরোধ চলাকালে জেলার কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি জানিয়ে সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার কাজী ওয়াজেদ আলী বলেন, গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। অবরোধ ঘিরে যেকোনো ধরনের নাশকতা ঠেকাতে পুলিশ তৎপর রয়েছে।

খাগড়াছড়ির গুইমারা থানার ওসি মো. এনামুল হক চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, সোমবার সকাল থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল রয়েছে। পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। উপজেলায় অবরোধের সমর্থনকারীদের অবস্থান নেওয়ার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

এদিকে গতকাল রাজধানীর রমনায় ডিএমপির পাঁচটি থানার ভবন নির্মাণের ভিত্তিফলক উন্মোচন অনুষ্ঠান শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল অব. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘শান্তিপূর্ণভাবে যাতে দুর্গাপূজা না হয়, একটি মহল সেই চেষ্টা চালাচ্ছে। এই মহলই খাগড়াছড়িতে এসব করছে। এই ঘটনা ভারত বা ফ্যাসিস্টদের ইন্ধনে ঘটছে।’

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিচ্ছি। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা বর্তমানে ঘটনাস্থলে আছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিছু সন্ত্রাসী পাহাড়ের ওপর থেকে গুলি চালাচ্ছে। এসব হাতিয়ার অনেক সময় দেশের বাইরে থেকে আসে।’

খাগড়াছড়ির দুই মহাসড়কে অবরোধ শিথিল: খাগড়াছড়ি-ঢাকা ও খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সোমবার দুপুর ১২টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত অবরোধ শিথিল করা হয়েছে। গতকাল এক বিবৃতিতে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’র মিডিয়া সেল।

বিবৃতিতে বলা হয়, লাশ সৎকার ও আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য অবরোধ শিথিল করা হয়েছে। তবে অন্যান্য সড়কে অবরোধ চলবে। এদিকে, নতুন করে সোমবার তিন পার্বত্য জেলায় সড়ক অবরোধ ডাকা হয়েছে। পাশাপাশি তারা তিন জেলায় সব পর্যটন সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করেছে।

খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বিভিন্ন মহলের সাথে আলোচনা চলছে। এখনো ১৪৪ ধারা বহাল রয়েছে।

দুই মানবাধিকার সংগঠনের উদ্বেগ: খাগড়াছড়িতে সহিংসতার ঘটনায় পাহাড়ি তিন নাগরিক নিহত, বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত, হামলা, গুলি, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ও হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি)। গতকাল পৃথক বিবৃতিতে এ দাবি জানিয়েছে সংগঠন দুটি। 

আসকের বিবৃতিতে বলা হয়, অবিলম্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে এবং ঘটনার প্রকৃত কারণ ও দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে হবে। ধর্ষণের শিকার কিশোরীর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে, একই সঙ্গে নিহত ও আহত ব্যক্তিদের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো নাগরিকদের জীবন, সম্পদ ও মর্যাদা রক্ষা করা। সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে এর পরিণতি পুরো সমাজকেই বহন করতে হবে।

তিনজন নিহত হওয়ার ঘটনায় অতিরিক্ত বল প্রয়োগের ঘটনা ঘটে থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও জানিয়েছে আসক। বিবৃতিতে সংস্থাটি বলেছে, পার্বত্য এলাকায় প্রায়ই উত্তেজনা সৃষ্টির কারণে জনজীবন ও জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। অতীতে সংঘটিত এ ধরনের ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত এবং পেছনের অন্তর্নিহিত কারণ নিরূপিত না হওয়ায় এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে।

বিবৃতিতে আসক আরও বলেছে, পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা কেবল পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য নয়; বরং জাতীয় ঐক্য ও দেশের ভাবমূর্তির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সহিংসতা, ভীতি ও উসকানি কখনোই সমাধান নয়। এগুলো শুধু পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে এবং রাষ্ট্রের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করে। আসক মনে করে, নাগরিক অধিকার সবার জন্য সমান। কারো প্রতি অবিচার, কারো প্রতি বৈষম্য কিংবা কারো নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়া মানে রাষ্ট্রই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া।

জানা গেছে, গত মঙ্গলবার রাত ৯টায় প্রাইভেট পড়ে ফেরার পথে ওই কিশোরী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় বলে অভিযোগ ওঠে। ওই দিন রাত ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় একটি খেত থেকে তাকে উদ্ধার করেন স্বজনেরা। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে একজনকে আটক করেছে পুলিশ। তাকে ছয় দিনের রিমান্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত।

ঘটনার পরদিন বুধবার থেকে জুম্ম ছাত্র-জনতা ধর্ষণের প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শনিবার বেলা ২টার পর সদর, পৌর এলাকা ও গুইমারায় ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। ধর্ষণের প্রতিবাদে ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে অবরোধও চলমান থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় গত রোববার দুপুরে বিক্ষোভ ও সহিংসতায় রণক্ষেত্র পরিণত হয় খাগড়াছড়ির গুইমারার রামেসু বাজার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে অবরোধকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় গুলিতে তিনজনের মৃত্যু হয়। নিহত তিনজনই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর। সেনাবাহিনীর মেজরসহ আহত হন অন্তত ২০ জন।