ঢাকা সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

একীভূত ব্যাংকে লুটপাট বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কী?  

রেজাউল করিম খোকন
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৫, ১২:৪২ এএম

দেশের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রায়ত্ত শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক গঠনের লক্ষ্যে পাঁচটি সংকটগ্রস্ত ইসলামী ব্যাংককে একীভূত করার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যাকে আর্থিক খাত স্থিতিশীল করার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। নতুন প্রণীত ব্যাংক রেজ্যুলেশন অর্ডিন্যান্স ২০২৫-এর অধীনে প্রণীত এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আনুমানিক ৩৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা মূলধন প্রয়োজন হবে। একীভূতকরণের জন্য নির্ধারিত পাঁচটি ব্যাংক হলো: ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক। বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে এটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় পুনর্গঠন উদ্যোগ।

এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য ব্যয়বহুল লিকুইডেশন বা অবসায়ন প্রক্রিয়া এড়িয়ে চলা এবং শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনা। একই সঙ্গে এটি বেসরকারিভাবে পরিচালিত ইসলামী ব্যাংকগুলোর গভীর সংকটকেও তুলে ধরেছে, যেগুলোর অনেকগুলোই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কনগ্লোমারেট বা ব্যবসায়িক গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিল, যাদের বিরুদ্ধে তহবিল পাচারের অভিযোগ রয়েছে। সরকারের কমিশন করা ফরেনসিক অডিটে গুরুতর অব্যবস্থাপনার চিত্র দেখা গেছে, তিনটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৯০ শতাংশেরও বেশি। নিয়ন্ত্রক সংস্থার মতে, বছরের পর বছর দুর্বল তদারকির পর একীভূতকরণই এখন একমাত্র কার্যকর উপায়। প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে পরিকল্পনা ও তদারকির জন্য একটি কার্যকরী কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে আমানতকারীদের স্বার্থকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হবে। অবসায়ন অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের জন্য অনেক বেশি ব্যয়বহুল ও কষ্টকর হবে। দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার স্থিতিশীলতাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তটি সঠিক। কারণ, দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিবেশ তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল, যার মধ্যে রয়েছে স্থির বিনিময় হার এবং পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। নতুন ব্যাংকের লাইসেন্সের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করা হবে বলেও আশা করা হচ্ছে।

সংকটে পড়া শরিয়াহভিত্তিক পাঁচ ব্যাংক মিলে একটি বড় ইসলামি ধারার ব্যাংক গঠন করা হচ্ছে। নতুন এই ব্যাংকের যাত্রার শুরুতে মূলধন জোগান দেবে সরকার। ব্যাংকটির প্রধান কাজ হবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে (এসএমই) অর্থায়ন করা। এই ব্যাংকের অনুমোদন (লাইসেন্স) দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর অধীনে এই পাঁচ ব্যাংকের আমানত ও সম্পদ স্থানান্তর করা হবে। এই প্রক্রিয়া খুব শিগগিরই  শুরু হবে। ব্যাংক একীভূত হলেও গ্রাহকদের লেনদেনে কোনো সমস্যা হবে না। তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নতুন ব্যাংকটির গ্রাহক হবেন। এ ছাড়া শীর্ষ পর্যায় ব্যতীত অন্য ব্যাংকাররা একীভূতকরণের প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত চাকরিতে বহাল থাকবেন। এ প্রক্রিয়া শেষ হতে অন্তত তিন বছর লাগতে পারে বলে জানা গেছে। ব্যাংক রেজ্যুলেশন অধ্যাদেশ ২০২৫-এর আওতায় এই কার্যক্রম শুরু হবে। আগামী ১৫ অক্টোবরের মধ্যে এই প্রক্রিয়া শেষ হবে। একীভূতকরণের আওতায় ব্যাংকগুলোর যেসব ঋণ খারাপ হয়ে পড়েছে, তা সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির (এএমসি) কাছে হস্তান্তর করা হবে। এমনভাবে সম্পদ হস্তান্তর করা হবে, যাতে নতুন ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে থাকে। এতে বিদেশি বাণিজ্যে লেনদেনে খরচ কম হবে ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন তহবিল থেকে ব্যাংক টাকা নিতে পারবে। এরপর নতুন একটি ব্যাংকের লাইসেন্স অনুমোদন দেওয়া হবে। পাঁচ ব্যাংকের সম্পদ ও দায় সেই ব্যাংকের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এরপর ধীরে ধীরে ব্যাংকের শাখাগুলো একীভূত করা হবে। এ জন্য জনবলও কমানো হবে। 

বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ধার করে আমানতের চেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে ব্যাংকগুলো। দেশে বড় আকারের একটা ইসলামি ধারার ব্যাংক গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে  বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে দেশে ইসলামী ব্যাংক খাতের নতুন সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। অবশ্য জবাবদিহি না ফিরলে ব্যাংক একীভূত করেও ব্যাংক খাত ঠিক হবে না। ব্যাংক যদি রাজনৈতিক লুটপাটের লক্ষ্য হয় এবং আর্থিক খাতের মূল সংস্কারগুলো না হয়, তাহলে কাজ হবে না। এ জন্য আগে সুশাসন, জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। গত ৯-১০ মাসেও আর্থিক খাতে পুরোপুরি সুশাসন ফেরেনি। কেন এই সময়ে ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়াতে পারল না, এটাও বড় প্রশ্ন। ব্যাংক একীভূত করে ভালোভাবে পরিচালনা করা গেলে সেটা ভালো কিছু হবে। এ জন্য কারা পরিচালনা করবে ও সুশাসন কতটা মেনে চলবে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনের সঙ্গে এই একীভূতকরণের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। আশা করা যায়, আগামী সরকারও এ প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেবে। তবে নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা না করে আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই পাঁচটি ইসলামী ব্যাংক একীভূত হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংককর্মীদের আশ্বস্ত করতে গিয়ে বলেছেও, এই একীভূতকরণের ফলে কোনো কর্মীকে চাকরি হারাতে হবে না। কর্মীদের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। প্রয়োজনে কিছু শাখা পুনর্বিন্যাস করা হবে। যেসব ব্যাংকের শাখা শহর এলাকায় বেশি, সেগুলোর কিছু শাখা গ্রামাঞ্চলে স্থানান্তরের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

ব্যাংকিং খাতের সংস্কারে বাংলাদেশ ব্যাংকের একীভূতকরণ প্রক্রিয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, ব্যাংকিং খাতের দুর্বল ব্যাংকগুলোকে রক্ষার নামে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে প্রক্রিয়া শুরু করেছে তা আর্থিক খাতের সংকট মোকাবিলায় বৈশ্বিক চর্চার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিবেচিত হওয়ার কথা। কিন্তু এখানে আন্তর্জাতিক মানদ- মানা হচ্ছে না বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্ট অনেকে। এর ফলে পুরো প্রক্রিয়াটিই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বলে মনে করছেন তারা। এই প্রক্রিয়া দিয়ে ব্যাংকিং খাতের সমস্যা সমাধান করা যাবে না। বরং আরও নতুন সমস্যার সৃষ্টি হবে। চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে একীভূত করলেই হবে না। সামগ্রিকভাবে ব্যাংকগুলোতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। রিয়েল অডিট হয়েছে কি না, যাচাই-বাছাই ছাড়া চাপিয়ে দিয়ে একীভূত করলেই ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে এমন ভাবার কারণ নেই। বরং যে ব্যাংকগুলো খারাপ হয়েছে, সেখানে রাজনৈতিক প্রভাব, ব্যবস্থাপনা ও দক্ষতার অভাবের মতো বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ না করে একীভূত করলে ভালো ব্যাংকগুলো হুমকির মুখে পড়ার শঙ্কা থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে নীতিমালা করেছে তাতে বলা হয়েছে, খারাপ ব্যাংকের পরিচালকরা ব্যাংক একীভূত হওয়ার পাঁচ বছর পর্যন্ত পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হতে পারবে না। এছাড়াও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছাঁটাই করার আশঙ্কাসহ নানা অনিশ্চয়তা থাকায় এই প্রক্রিয়া কতটা ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশে ব্যর্থতার দায় কেউ স্বীকার করে না। আর্থিক খাত নিয়ন্ত্রকেরাও ব্যতিক্রম নন। কিন্তু এই ব্যর্থতা পুরো আর্থিক খাতকেই এখন বিপদে ফেলেছে। বেশ কিছু ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি এতটাই নাজুক হয়েছে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ব্যাংকে পর্যবেক্ষক ও সমন্বয়ক হিসেবে নিজস্ব কর্মকর্তা বসিয়েছিল। কিন্তু এরপরও বিশেষ তদারকিতে থাকা বেশির ভাগ ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। দুর্বল ব্যাংকের পরিস্থিতি ভালো হয়নি কেন? এসব ব্যাংকের মালিক ও বড় গ্রাহকদের বেশির ভাগ ছিল সরকারঘনিষ্ঠ। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক কতটা ভূমিকা রাখতে পেরেছে, এটাও বড় প্রশ্ন। কিন্তু ব্যাংক খাতে যে সংকট, ব্যাংক একীভূত করে কি সেই সংকট কাটানো যাবে- এটি একটি বড় প্রশ্ন। এই সংকটের জন্য যারা দায়ী, তা মালিক পক্ষ হোক বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কিংবা নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ, তাদের ব্যাপারে কী করা হচ্ছে, সেটি আরেকটি বড় প্রশ্ন। ব্যবসায়ীদের মধ্য থেকেই এখন দাবি উঠেছে, তারা ‘লুণ্ঠিত ঋণের’ দায় নিতে চান না। এ দেশে আমানতকারীদের অর্থ যারা লুণ্ঠন করেছেন বা লুণ্ঠনে সহায়তা করছেন, তাদের কোনো শাস্তির মুখে পড়তে হয় না। ব্যাংক একীভূত হয়ে আরও বড় যে ব্যাংক হবে, সেখানে লুটপাট বন্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সেটা জানাও এখন জরুরি।

রেজাউল  করিম খোকন: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক