*** বর্ষায় নৌকা, শুষ্ক মৌসুমে বাঁশের সাঁকো কিংবা কখনো হেঁটে নদী পারাপার
*** আধুনিক কর্মসংস্থান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে চরের মুনুষ
রাজশাহীর বাঘা উপজেলার চকরাজাপুর ইউনিয়নের প্রায় ১৫টি চরে বসবাস করছে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ। বর্ষায় এই মানুষদের উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র ভরসা খেয়াঘাটের নৌকা। বর্ষায় নৌকা, শুষ্ক মৌসুমে বাঁশের সাঁকো কিংবা কখনো হেঁটে নদী পার হয়ে উপজেলা সদরে যেতে হয় তাদের। ফলে এই দুর্ভোগ তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। দীর্ঘদিন ধরে চরের বাসিন্দারা সেখানে সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। এতে আধুনিক কর্মসংস্থানের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। শ্রমিকের কাজ ও ক্ষুদ্র ব্যবসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ এই ১৫ হাজার মানুষ। সেতুর অভাবে বছরের পর বছর ধরে দুর্ভোগে রয়েছেন তারা।
বাঘার চকরাজাপুর ইউনিয়নের মধ্যে রয়েছে- চকরাজাপুরচর, কালীদাসখালীচর, লক্ষ্মীনগরচর, দাদপুরচর, উদপুরচর, পলাশী ফতেপুরচর, ফতেপুর পলাশীচরসহ ১৫টি চর। এসব চরের মানুষ উপজেলা সদরে যাতায়াতের জন্য নির্ভর করেন শিমুলতলাঘাট, চাঁদপুরঘাট, পালপাড়াঘাট, সরেরহাটঘাট, খায়েরহাট ক্লাবঘাট ও খায়েরহাট হালিম মাস্টারের ঘাট। বর্ষাকালে সেখানে নৌকা ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় নেই। শুষ্ক মৌসুমে সাঁকো কিংবা পানি ভেঙে পার হন এখানকার মানুষ। ফলে সেখানে কোনো ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ নেই। অধিকাংশ মানুষ শ্রমিকের কাজ করেন। কেউ বা নদী পার হয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এখানে তাই সব পরিবারে স্বচ্ছতার স্বপ্ন খুবই ক্ষীণ।
স্থানীয়দের দাবি- এই ঘাটগুলোর যেকোনো একটির স্থানে সেতু নির্মাণ করা হলে পুরো ১৫টি চরের মানুষ সহজেই উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটত। কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পেত। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এই দাবি জানিয়ে আসলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
গ্রামের প্রবীণরা জানান, বর্ষা মৌসুমে নৌকায় পারাপারের সময় বহু মানুষ নদীতে নিখোঁজ হয়েছেন, অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন। শুধু যাতায়াতের সমস্যার কারণেই এখানকার ছেলে-মেয়েরা শিক্ষা থেকে পিছিয়ে পড়ছে। আধুনিক প্রযুক্তির কোনো সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না। চরাঞ্চলে রয়েছে ৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। কিন্তু কোনো কলেজ না থাকায় মাধ্যমিক পাসের পর বহু শিক্ষার্থী পড়াশোনা বন্ধ করতে বাধ্য হয়। যে কয়জন উচ্চশিক্ষার চেষ্টা করে, তাদের প্রতিদিন কষ্ট করে উপজেলা সদরে যাতায়াত করতে হয়। নদী পার হয়ে পড়ালেখা করাতে চান না অনেক পরিবার। বাধ্য হয়ে বেকার ও অন্যপেশায় ঝুঁকে পড়ে তরুণ প্রজন্ম।
পদ্মার চরগুলো মূলত কৃষিনির্ভর। ফলে চরের বাসিন্দারা শ্রমিকের কাজ ও কৃষি কাজেই বেশি আগ্রহী হয়। উচ্চ শিক্ষায় তাদের অনেকেই বঞ্চিত হতে হয় বলে দাবি করেন সচেতন পরিবারের অনেক অভিভাবক। অন্যদিকে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে চরে ফসল ফলিয়েও ন্যায্যমূল্য পান না বলে অভিযোগ চরের বাসিন্দাদের। কারণ এখানকার জমিতে উৎপাদিত ধান, গম, ভুট্টা, পাট, ডাল ও শাক-সবজি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যায়। কিন্তু যোগাযোগব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় চাষিদের পণ্য ন্যায্য দামে বিক্রি করা সম্ভব হয় না। বাধ্য হয়ে তারা ফড়িয়াদের কাছে কম দামে বিক্রি করেন।
চরের বাসিন্দারা জানান, বহু বছর ধরে নির্বাচনের আগে সেতুর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও কাজ হয়নি। বর্তমান নতুন বাংলাদেশে যেন সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবে রূপ নেয়, এটাই প্রত্যাশ চরবাসীদের। তাদের বিশ্বাস, একটি সেতু হলে শুধু যাতায়াত নয়, শিক্ষা, কৃষি ও স্বাস্থ্যসেবায়ও যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে। আধুনিক সুবিধা পেয়ে তাদের ভাগ্যবদল হবে।
দাদপুর চরের সাবেক মেম্বর রেজাউল করিম বলেন, চরে সেতুর অভাবে কৃষিপণ্য সঠিকভাবে বাজারজাত করা যায় না। সেতু হলে শুধু কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হবে না, সাধারণ মানুষও নিরাপদে উপজেলা সদরে যেতে পারবে। এটা সবার দাবি বলে জানান তিনি।
এ ব্যাপারে বাঘা উপজেলা প্রকৌশলী বেলাল হোসেন বলেন, বাঘার চকরাজাপুর ইউনিয়নের চর এলাকার খায়েরহাট হালিম মাস্টারের ঘাটে ৬০০ মিটার দীর্ঘ একটি সেতু নির্মাণের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলে কাজ শুরু করা হবে। আমরা চেষ্টা করছি এই বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে।