ঢাকা শনিবার, ১৪ জুন, ২০২৫

ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তাব দেবেন তারেক 

রুবেল রহমান
প্রকাশিত: জুন ১৩, ২০২৫, ০২:৪২ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ গ্রাফিক্স

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের সঙ্গে লন্ডনে তারেক রহমানের বৈঠক আজ শুক্রবার। এই বৈঠকে সরকারের সঙ্গে বিএনপির দ্বন্দ্ব নিরসনের সম্ভাবনা দেখছেন দলটির সিনিয়র নেতারা। ওই বৈঠকে আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান হবে বলেও আশা তাদের।

মতপার্থক্য কিংবা দূরত্ব হ্রাসের পাশাপাশি ইউনূস সরকারের অধীনেই যৌক্তিক সময়ে নির্বাচনের প্রত্যাশা দলটির সিনিয়র নেতা হাফিজ উদ্দিন আহমেদের।

আর রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে বৈঠকটি হতে পারে মাইলফলক। তারেক-ইউনূসের বৈঠকের দিকে সরকার, রাজনৈতিক দলসহ সর্বস্তরের মানুষের দৃষ্টি। সব সমস্যার সমাধানে হবে আলোচনা। এই বৈঠকে মতপার্থক্য ও দূরত্ব হ্রাস পাবে বলেই মনে করেন সবাই।

জানা যায়, লন্ডনের হোটেল ডোরচেস্টারে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠকটি হবে ওয়ান টু ওয়ান। আজ শুক্রবার স্থানীয় সময় সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টার এই দীর্ঘ বৈঠকে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির সব বিষয় উঠে আসবে বলে জানিয়েছেন বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা। তবে মূল ফোকাস থাকবে নির্বাচন প্রসঙ্গ।

জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকার এপ্রিলে নির্বাচনের ঘোষণা দিলেও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন আয়োজনে জোর দেবেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের যৌক্তিকতা তুলে ধরবেন।

এখন অবধি ডিসেম্বরে নির্বাচনের দাবিতে অনড় বিএনপি আর সরকার জুন থেকে সরে এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচনের কথা মুখ ফুটে বলেছেন। কিন্তু তা মানতে রাজি নয় বিএনপি। দুই পক্ষের অনড় অবস্থানের বরফ গলাতে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিরোধে না জড়িয়ে আলোচনার মাধ্যেমে নির্বাচন আয়োজনে জোড় দিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া।

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠকে গণহত্যার বিচার ও রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে সরকারকে দলের অবস্থান তুলে ধরার পাশাপাশি কীভাবে এ দুটি বিষয়ে দ্রুত অগ্রসর হওয়া যায়, সেসব বিষয় গুরুত্ব পাবে বলে মনে করেন বিএনপি নেতারা।

বিএনপির পাশাপাশি রাজনৈতিক মহলও আশা প্রকাশ করছেন, তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অনুষ্ঠেয় এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে সৃষ্ট সংকট কেটে যেতে পারে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা এ বৈঠককে সরকার ও বিএনপি উভয়ের জন্যই ‘একটা সুযোগ’ বলে মনে করছেন।

তারা বলছেন, বিএনপি দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল এবং আগামী নির্বাচনে তাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই সরকারের জন্য নির্বাচন, সংস্কার ও বিচার ইস্যুতে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের মনোভাব বোঝা খুব দরকার। অন্যদিকে সরকারও কী কী করতে চায়, সেটাও তারেক রহমানের জানা দরকার। 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘ধারণা করা হচ্ছে, বিগত দুই মাসব্যাপী রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার পর সরকারও নির্বাচন নিয়ে তাদের অনড় অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছে। সম্ভবত সরকারের অভ্যন্তরে এই উপলব্ধি হয়েছে যে, এখন বিএনপির সঙ্গে কনফ্রন্টেশন মোড থেকে রিকন্সিলিয়েশন মোডে আসা প্রয়োজন।’

অন্তর্বর্তী সরকার আগামী এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচনের যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে, সেটিকে যৌক্তিক মনে করছে না বিএনপি। দলটি মনে করে, নির্বাচনের জন্য চলতি বছরের ডিসেম্বরই উপযুক্ত সময়। তবে নির্বাচন আগামী বছরের জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারিতে অর্থাৎ, রোজার আগে হলেও আপত্তি থাকবে না বলে বিএনপির অভ্যন্তরীণ একাধিক সূত্রে জানা গেছে।

দলটির অভিমত, সর্বোচ্চ এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে তারেক রহমান বিষয়টি তুলে ধরবেন বলে দলটির শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। 

ডিসেম্বরে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি দফায় দফায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে হতাশা প্রকাশ করে আসছিল বরাবরের মতোই। প্রধান উপদেষ্টা ঈদের শুভেচ্ছাবার্তায় ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচনের ঘোষণা দিলে হতাশা বাড়ে বিএনপি শিবিরে। নির্বাচন ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে বিএনপির বাড়ে দূরত্ব।

প্রধান উপদেষ্টার লন্ডন সফরে তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠককে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে রাজনীতির হাওয়া। বৈঠকটি আগামী নির্বাচন, সংস্কার ও গণতন্ত্রকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে মত বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর।

রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি রমজান, পাবলিক পরীক্ষা ও প্রতিকূল আবহাওয়ার আগেই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন চায় বিএনপি। কখন নির্বাচন হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্ণ কর্তৃত্ব দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেওয়া হয়েছে। 

বিএনপির নীতিনির্ধারণী কমিটির একাধিক সদস্যের মতে, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠক ফলপ্রসূ হলে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি, প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের উদ্যোগ এবং জুলাই সনদসহ বিভিন্ন ইস্যুতে অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপির মধ্যে যে মতপার্থক্য ও দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তা অনেকটাই কমে আসতে পারে।

বৈঠককে কেন্দ্র করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এরই মধ্যে লন্ডন পৌঁছেছেন। তিনিও বৈঠকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে দলীয় প্রতিনিধিদলে অংশ নিতে পারেন। তবে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের মূল বৈঠকটি হবে কার্যত ‘ওয়ান টু ওয়ান’। রুদ্ধদ্বার ওই বৈঠকে দুজন ছাড়া আর কেউ থাকবেন না।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ড. ইউনূস-তারেক রহমানের বৈঠক রাজনীতিতে সুবাতাস আনবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, গোটা জাতি এখন লন্ডনের দিকে তাকিয়ে আছে। আমরা বিশ্বাস করি, এটি হবে একটি ঐতিহাসিক বৈঠক এবং এ বৈঠকের মাধ্যমে দেশের রাজনীতিতে সুবাতাস বইবে। যৌক্তিক সময়েই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আলোচনার মধ্য দিয়ে নির্বাচনসহ সব সমস্যার সমাধান সম্ভব।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিএনপি মনে করে দেশের প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতা বিবেচনা করে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের আয়োজন করবে। কিন্তু তিনি যে জুন কিংবা এপ্রিলের  কথা বলেন, সেটা প্রায় অসম্ভব।

আমরা মনে করি, আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তাকে সেই বাস্তবতা বোঝাতে সক্ষম হবেন। ডিসেম্বরে না হোক, ফেব্রুয়ারির পর নির্বাচনের আর সুযোগ থাকবে না। আমরা যেহেতু ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়েছি, আমরা আরও কিছু সময় দিতে চাই। তবে সেটা ফেব্রুয়ারিতে রোজা শুরুর আগেই। তিনি যদি নির্বাচন না দেন, তাহলে আমাদের মিত্রদের সঙ্গে আলোচনা করেই পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি পাঁচ বছর থাকবেন, সেটা আমার বিশ্বাস হয় না। নির্বাচন আদায় করে নেওয়ার কৌশল আমরা জানি।’

এই বৈঠককে সরকার ও বিএনপি উভয়ের জন্যই ‘সুযোগ’ হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সরকারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, সংস্কারের বিষয়ে সরকারের অবস্থান, নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ, নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা, দেশকে স্থিতিশীল রাখা, বিএনপির সঙ্গে সরকারের কোনো দূরত্ব নেই অর্থাৎ, একটা ঐক্য অবস্থা প্রকাশ করা এগুলো সবই এখন সরকারের জন্য প্রয়োজন।

তা ছাড়া এই অন্তর্বর্তী সরকারকে বিদ্যমান অবস্থা থেকে বের হয়ে একটা নির্বাচিত স্বাভাবিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নিতে হবে। এই বৈঠকের মাধ্যমে আস্থার সংকট কাটবে বলেও মনে করেন এই বিশ্লেষক।