১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে ইরান শাসনকারী ধর্মীয় নেতৃত্বকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চায় ইসরায়েল ও তার মিত্ররা। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক অস্থিরতা ইরানের ভবিষ্যতকে গভীর অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাই যদি বর্তমান শাসন ব্যবস্থার পতন হয় তাহলে কে বসবে আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির স্থানে?
১৯৮৯ সালে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির মৃত্যুর পর থেকে দেশটির সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে ক্ষমতায় আছেন আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। তিনি এখন ৮৬ বছরের বৃদ্ধ, শারীরিকভাবে দুর্বল এবং রাজনৈতিকভাবে চাপের মুখে রয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তার উত্তরাধিকার নির্ধারণ প্রক্রিয়াটি শুরু হয়ে গেছে এবং এটিকে ঘিরে অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা ক্রমেই তীব্র হচ্ছে।
এএফপির বিশ্লেষণে বলা হয়, ইরানের পরমাণু বা ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনার বাইরে ইসরায়েল সম্প্রতি তেহরানের জাতীয় টিভি সম্প্রচার কেন্দ্রে হামলা চালিয়েছে। এটি দেখে অনেকেই ধারণা করছেন, ইসরায়েলের লক্ষ্য কেবল পরমাণু সক্ষমতা ধ্বংস করা নয়, বরং সরাসরি আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে সরিয়ে দেওয়া।
এএফপি বলছে, ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন বাহিনীর ইরাক আক্রমণ ও ২০১১ সালে ন্যাটো জোটের লিবিয়ায় হস্তক্ষেপ—এই দুটি ঘটনার পরের বিশৃঙ্খলা ও রক্তপাতের ভয়াবহতা এখনো যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নেতাদের তাড়া করে বেড়ায়।
বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন, খামেনি ও তার ধর্মীয় সহযোগীদের হঠানো হলে যে ক্ষমতার শূন্যতা সৃষ্টি হবে, তা পূরণ করতে পারে ইরানের বিপ্লবী গার্ড আইআরজিসি বা সেনাবাহিনী। এদের অনেকেই আরও কট্টরপন্থী।
আন্তর্জাতিক সংস্থা কারনেগি এনডাওমেন্টের গবেষক নিকোল গ্রাজেউস্কি বলেন, 'ইসরায়েলের হামলা কেবল পরমাণু বা সামরিক স্থাপনায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি সরকার পতনের পরিকল্পনার অংশ বলেই মনে হচ্ছে। কারণ রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের মতো প্রতীকী প্রতিষ্ঠানেও হামলা হচ্ছে।'
তিনি বলেন, 'যদি শাসনের পতন ঘটে, আশা থাকবে উদার ও গণতান্ত্রিক সরকার আসবে। কিন্তু আইআরজিসি বা অন্য কট্টর বাহিনীর উঠে আসার সম্ভাবনাও প্রবল।'
ইরানের অন্যতম আলোচিত বিরোধী নেতা হচ্ছেন রেজা পাহলভী। তিনি যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ও ইরানের প্রাক্তন রাজা মোহাম্মদ রেজা পাহলভীর পুত্র। তিনি দাবি করছেন, 'ইসলামী প্রজাতন্ত্র ভেঙে পড়ার দ্বারপ্রান্তে।'
তিনি খামেনিকে 'ভীতু' অ্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, 'খামেনি লুকিয়ে আছেন।'
রেজা পাহলভী দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের সঙ্গে পুনরায় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পক্ষে কথা বলে আসছেন। কিন্তু ইরানের ভিতরে ও প্রবাসে রেজা পাহলভীর গ্রহণযোগ্যতা সর্বজনীন নয়। তার জাতীয়তাবাদী অবস্থান ও ইসরায়েল ঘনিষ্ঠতা বিতর্কিত। বিশেষ করে ইসরায়েলি হামলার নিন্দা না করায় সেই বিতর্ক আরও জোরালো হয়েছে।
দেশটির আরেকটি সক্রিয় বিরোধী দল হলো পিপলস মুজাহিদিন। তাদের নেত্রী মারিয়াম রাজাভি বুধবার (১৮ জুন) ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বলেন, 'ইরানি জনগণ এই শাসনের পতন চায়।'
তবে এই দলটি অন্যান্য বিরোধী গোষ্ঠীর কাছে অপছন্দের, কারণ তারা ইরান-ইরাক যুদ্ধে সাদ্দাম হোসেনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল।
অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থমাস জুনো বলেন, যদি ইসলামিক রিপাবলিক পতন হয়, তাহলে সেখানে গণতান্ত্রিক ও সংগঠিত বিকল্প নেই বললেই চলে।
তিনি বলেন,রেজা পাহলভী হয়তো সবচেয়ে বেশি পরিচিত নাম, কিন্তু সমর্থকেরা দেশের ভিতরে তার গ্রহণযোগ্যতা অতিরঞ্জিত করেন। সবচেয়ে সম্ভাব্য বিকল্প হলো আইআরজিসির সামরিক অভ্যুত্থান অথবা সামরিক একনায়কত্বে পরিবর্তন।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিংকট্যাঙ্ক সৌফান সেন্টারের বিশ্লেষকরা বলেন, ইরানি শাসনব্যবস্থার টিকে থাকাকে এখন 'কৌশলগত ব্যর্থতা' হিসেবে দেখা হচ্ছে, তাই 'ইরাক ২.০'-এর সম্ভাবনা ক্রমশ বাড়ছে। যদি এই শাসনের পতন হয়, তাহলে তারপর কী হবে তা এখন অনিশ্চিত। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ইরাকের চেয়েও বড় পরিসরে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে, যার প্রভাব পড়বে বিশ্বব্যাপী।'
