মধ্যপ্রাচ্যে নতুন একটি যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়ছে। আর যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ইরান-ইসরায়েল। রুশ সংবাদমাধ্যম আরটির বিশ্লেষণে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় দিক থেকেই তেহরানের ওপর চাপ বাড়ছে। শত্রু দেশগুলো একে ইরানের দুর্বলতা হিসেবে দেখছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। পারমাণবিক কর্মসূচি ইস্যুতে সেপ্টেম্বরে ৩ ইউরোপীয় দেশ যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানির অনুরোধে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করে জাতিসংঘ। দেশগুলোর অভিযোগ, ২০১৫ সালের চুক্তি লঙ্ঘন করে পরমাণু অস্ত্র তৈরির প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে তেহরান। এ ছাড়া, ইরানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে অস্থিতিশীল করার অভিযোগ পশ্চিমা বিশ্বের। এসব কারণে ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক উপস্থিতি ক্রমেই বাড়াচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো। আরটির প্রতিবেদনে বলা হয়, তেহরানও তার আঞ্চলিক কার্যকলাপ বাড়িয়েছে। সিরিয়া, লেবানন, ইরাক এবং ইয়েমেনে অংশীদারদের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তার করতে চাচ্ছে দেশটি।
অন্যদিকে, ইরানের অভ্যন্তরে, অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপ আরও তীব্র হচ্ছে। নিষেধাজ্ঞার প্রভাব, মূল্যস্ফীতি, জীবনযাত্রার মান হ্রাস করছে এবং বেকারত্ব দেশটির জনসংখ্যার বড় অংশকে ক্ষুব্ধ করে তুলছে। এমন পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ইরান ও পশ্চিমা বিশ্বের উত্তেজনা এখন ধীরে ধীরে কূটনৈতিক সমাধানের বাইরে ছড়িয়ে পড়ছে, প্রকাশ্য হুমকির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া, ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে দ্বিতীয় দফা প্রকাশ্য সংঘাতের পূর্বাভাস দিচ্ছেন অনেকে। এদিকে, নতুন একটি যুদ্ধের বিষয়ে ইরানও জোরেশোরে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর আগে আগস্টে, এক বক্তৃতায় ইরানের সংসদীয় স্পিকার মোহাম্মদ বাঘের গালিবাফ জানান, যেকোনো সময় যুদ্ধ শুরু হতে পারে, তাই দেশকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল আব্দুর রহিম মুসাভি বলেছেন, সেনাবাহিনীকে সর্বোচ্চ প্রস্তুত অবস্থায় থাকতে হবে এবং প্রতিদিন নিজেদের সক্ষমতা আরও শক্তিশালী করতে হবে। সিনিয়র কমান্ডারদের উপস্থিতিতে আয়োজিত সেনা কর্মকর্তাদের সমাপনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে মেজর জেনারেল মুসাভি নবীন কর্মকর্তাদের অভিনন্দন জানান এবং তাদের ‘প্রতিরোধ ফ্রন্টের অফিসার’ ও ভবিষ্যৎ সেনা নেতৃত্ব হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আজ ফিলিস্তিন বিশ্বের প্রিয়তম নাম, আর গাজা দৃঢ়তা ও তলোয়ারের ওপর রক্তের বিজয়ের প্রতীক। ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান বলেন, আল-আকসা স্টর্ম অভিযানের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে, যা বৃহত্তর আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরিবর্তনের সূচনা করেছে।
জাতিসংঘের পরমাণু কর্মসূচিবিষয়ক পর্যবেক্ষক সংস্থা আইএইএর মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি বলেছেন, ইরানের ক্ষতিগ্রস্ত পারমাণবিক স্থাপনাগুলোয় প্রায় ৪০০ কিলোগ্রাম ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুত রয়েছে, তেহরানের পূর্ণ সহযোগিতা ছাড়া সেখানে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। আইএইএ প্রধান গত সপ্তাহে এই তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, সংস্থাটি বিশ্বাস করে জুনে ইসরায়েলের সঙ্গে ১২ দিনের যুদ্ধের পরেও ইরানের বেশির ভাগ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের সরবরাহ অক্ষত রয়েছে এবং সেটি এখনো ক্ষতিগ্রস্ত পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোর ভেতরেই মজুত আছে। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে নতুন করে আরও ভয়াবহ সংঘাতের আশঙ্কা করছেন ইসরায়েলের সাবেক সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ড্যানি সিট্রিনোভিচ। তার মতে, তেহরান আগের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েছে এবং দ্রুত ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। ফলে ভবিষ্যৎ সংঘাত আগের চেয়ে অনেক বেশি সহিংস ও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ইরান ইন্টারন্যাশনালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।
নতুন যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরিতে ইরানের ওপর ক্রমাগত চাপ বাড়াচ্ছে আমেরিকা, ইসরায়েল এবং বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ। নিষেধাজ্ঞা কঠোর করা এবং মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধির মাধ্যমে এই চাপ প্রতিফলিত হচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলো ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধে উঠে পড়ে লেগেছে। পাশাপাশি, ইরানের প্রতিবেশী দেশগুলোকে অস্থিতিশীল করে তুলছে।এর প্রতিক্রিয়ায় সিরিয়া, লেবানন, ইরাক এবং ইয়েমেনে প্রভাব বিস্তারে আঞ্চলিক কার্যকলাপ জোরদার করেছে ইরান।
এখন উত্তেজনা ধীরে ধীরে কূটনীতির গ-ি ছাড়িয়ে প্রকাশ্য হুমকির কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে। ইরান যে নতুন যুদ্ধের আঁচ করতে পেরেছে, তা দেশটির অভ্যন্তরে তাকালে টের পাওয়া যায়। গত জুন মাসের ১২ দিনের সংঘাতের পর ইরানের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য কাঠামোতে শুরু হয়েছে ব্যাপক শুদ্ধি অভিযান। বিদেশী প্রভাব দূর করতে চালানো হয়েছে বেশ কয়েকটি গোপন অভিযান।এই অভিযানগুলোতে এমন ব্যক্তিদের ধরা হয়েছে যারা শত্রুভাবাপন্ন বিদেশী পক্ষগুলোর সাথে সম্পর্ক এবং বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার সাথে যোগাযোগ রেখেছিলেন। আটককৃতদের মধ্যে এমন ব্যক্তিরা ছিলেন যাদের সঙ্গে ইসরায়েলি সংস্থাগুলোর দীর্ঘদিনের সংযোগ ছিল বলে জানা গেছে।
গত ৩ আগস্ট ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ ‘প্রতিরক্ষা পরিষদ’ নামে একটি নতুন কৌশলগত সংস্থা গঠনের ঘোষণা দেয়। এর নেতৃত্বে থাকবেন ইরানের প্রেসিডেন্ট। এছাড়া বিচার বিভাগের প্রধান, পার্লামেন্টের স্পিকার, সামরিক কমান্ডার এবং মূল মন্ত্রীরা এতে যুক্ত থাকবেন। এই পরিষদের ম্যান্ডেট হলোÍ জাতীয় প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা তৈরি করা, সশস্ত্র বাহিনীর পরিচালন ক্ষমতা বাড়ানো এবং চলমান আঞ্চলিক অস্থিরতায় একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রতিরক্ষা কৌশল প্রণয়ন করা। এদিকে প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেসকিয়ান আলী লারিজানীকে সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের নতুন সচিব হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা লারিজানী এই প্রেক্ষাপটে বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব।
জুলাই মাসের শেষের দিকে তিনি মস্কো সফর করেন এবং প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনসহ শীর্ষ রুশ কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করেন।ইরানের সামরিক প্রস্তুতিও নতুন যুদ্ধের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী আজিজ নাসিরজাদে বলেন, ১২ দিনের সংঘাতের সময় ইরান তার সবচেয়ে উন্নত অস্ত্র ব্যবহার করা থেকে বিরত ছিল। এর মধ্যে রয়েছে কাশেমবাসীর মিসাইল। তিনি সতর্ক করে বলেন, যদি আবার আক্রমণ করা হয়, তবে তার প্রতিক্রিয়া হবে অপ্রত্যাশিত এবং জোরালো।
ইরান, রাশিয়া ও চীন যৌথভাবে জাতিসংঘকে শনিবার জানিয়েছে, ২০১৫ সালে তেহরানের সঙ্গে ছয় বিশ্বশক্তির হওয়া পারমাণবিক চুক্তিটি আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়েছে। এর মাধ্যমে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বিবেচনার সমাপ্তি ঘোষিত হল বলে খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের। আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থাগুলোর বরাত দিয়ে সৌদি গেজেট জানিয়েছে, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ও নিরাপত্তা পরিষদের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে ওই তিন দেশ বলেছে, “২২৩১ প্রস্তাবের অধীনস্থ সব বিধানের মেয়াদ ১৮ অক্টোবর, ২০২৫ এ শেষ হয়েছে।
ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের হয়ে তথ্য সরবরাহের দায়ে দোষী সাব্যস্ত এক ব্যক্তির মৃত্যুদ- কার্যকর করেছে ইরান। রোববার মধ্য ইরানের কোম প্রদেশে এই সাজা কার্যকর হয় বলে দেশটির বিচার বিভাগ পরিচালিত সংবাদমাধ্যম মিজান-এর প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।