ঢাকা মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৫

তুয়া ও মেউ

মিনহাজুর রহমান নয়ন
প্রকাশিত: অক্টোবর ২১, ২০২৫, ০১:১৯ এএম

সকাল সাতটা। স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে তুয়া। প্রতিদিনের মতো আজকেও সে জুতার র‌্যাকের দরজাটা খুলল। জুতাজোড়া বের করতেই ঘটে গেল এক আজব ঘটনা। জুতার র‌্যাকের মধ্যে থেকে ভেসে আসছে বিড়ালের মেউ মেউ শব্দ। একটু পর বেরিয়ে আসল সাদা একটা বিড়াল। আলো পড়তেই ঝকমক করছে।

তুয়া মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। এমন ধবধবে সাদা বিড়াল সে এর আগে কখনো দেখেনি। কিন্তু হঠাৎ চোখের সামনে একটা প্রাণী দেখে তার ছোট্ট বুকটা কেঁপে উঠল। সে ‘আহ্হ্!’ বলে চিৎকার করে দুই কদম পিছিয়ে এলো।

তুয়ার মা রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে বললেন, ‘কী হয়েছে? সকালবেলা এত চিৎকার করছিস কেন?’

তুয়া কাঁপতে কাঁপতে আঙুল দিয়ে ইশারায় সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকা বিড়ালটাকে দেখিয়ে দিল। বিড়ালটা স্থির হয়ে আছে, শুধু এদিক-ওদিক দেখছে।

মা বলল ‘বিড়াল! বিড়াল আবার কোত্থেকে এলো ঘরে? এই বিড়াল, যা যা!’ মা হাত নেড়ে বিড়ালটাকে তাড়ানোর চেষ্টা করলেন। বিড়ালটা একটুও নড়ল না, চুপ করে বসে থাকল জুতার র‌্যাকে।

মা গিয়ে জোরে ধমক দিলেন, যা চলে যা।

এবার বিড়ালটা যেন একটু ভয় পেল। সে বাসা থেকে বের হয়ে সিঁড়ি বেয়ে দু-তিন ধাপ নিচে নেমে গেল, কিন্তু পুরোপুরি চলে গেল না। সিঁড়ির বাঁকে দাঁড়িয়ে সে বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে র‌্যাকের দিকে তাকাতে লাগল। বিড়ালটি শুধু তুয়ার দিকে বারবার দেখছে। মা তুয়াকে প্রায় টেনে নিয়ে এসে বললেন, ‘যাও, জুতা পরে নাও তাড়াতাড়ি। তোমার অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

তুয়া দ্বিধা নিয়ে জুতা বের করার জন্য আবার র‌্যাকের ভেতরে হাত ঢোকাল। সঙ্গে সঙ্গে তার হাতে নরম, উষ্ণ আর তুলতুলে কিছুর স্পর্শ লাগল। তুয়া চমকে উঠল, আবার ভয় পেয়ে গেল তুয়া।

‘র‌্যাকের ভেতরে কী যেন নড়ছে, আম্মু!’ তুয়া ফিসফিস করে বলল।

মায়ের ভ্রু কুঁচকে গেল। তিনি র‌্যাকের দরজা খুলতেই দেখা গেল কাগজের টুকরোগুলোর ওপর, ছোট ছোট নরম মাংসের দলা মতো কয়েকটা বিড়াল ছানা জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে।

‘এ তো দেখছি মহা কা-! জুতার র‌্যাকের ভেতরে বিড়াল বাচ্চা দিয়েছে!’ মা বিরক্তি হয়ে বলল এদের এক্ষুনি সরাতে হবে, নয় তো ঘর নোংরা করে দেবে।

কিন্তু তুয়ার মনের অবস্থা ছিল ভিন্ন। সে তো বিড়াল ভালোবাসে। বিড়াল ছানাগুলোকে দেখে তার মন আনন্দে ভরে গেল। তার মনে হলো এই সাদা বিড়ালটার নাম সে দেবে ‘মেউ’। সে উঁকি মেরে ছানাগুলোকে দেখতে চাইল।

তুয়া বলল ‘এদিকে আস! এদিকে আস।  মা তুয়ার কাঁধ ধরে তাকে পেছনে টেনে আনলেন। তারপর তিনি র‌্যাকের ভেতর থেকে এক এক করে তিনটা ধবধবে সাদা বিড়াল ছানাকে সাবধানে বের করে মেঝেতে রাখলেন। ছানাগুলো এত ছোট যে কাঁপছে, আর ক্ষীণ স্বরে মিউ মিউ করছে।

তুয়া আনন্দে লাফিয়ে উঠল। ‘ওহ্! কী কিউট! আম্মু, আমরা এদের রাখব, প্লিজ!’

মা কথা না বলে পা দিয়ে আলত করে ঠেলে ঠেলে বিড়াল ছানাগুলোকে দরজার সামনে থেকে সিঁড়ির দিকে নিয়ে যেতে শুরু করলেন।

তুয়া ভয়ে কেঁদে ওঠার মতো হলো। ‘আম্মু, কী করছ? ওদের ফেলে দেবে?’

‘না, ফেলব না। ওদের মাকে ডাকছি। বিড়াল মা তার বাচ্চা নিয়ে চলে যাক,’ মা গম্ভীর মুখে বললেন।

তিনি বাচ্চাগুলোকে সিঁড়ির একদম প্রথম ধাপে রেখে সরে এলেন। সিঁড়ির নিচে অপেক্ষারত মেউ নামক সেই বিড়াল মা তার সন্তানদের দেখে মুহূর্তেই সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো। করুণ চোখে একবার তুয়ার মায়ের দিকে তাকাল, তারপর খুব সাবধানে একটা একটা করে বাচ্চা মুখে তুলে নিচে নেমে যেতে শুরু করল। তার চোখে সন্তানের জন্য গভীর মমতা।

তুয়ার মনটা ভরে গেল এক অদ্ভুত ভালোবাসায়। সে বুঝল, মা যাই বলুক, বিড়াল-মা তার বাচ্চাদের নিতে পারায় সে খুশি হয়েছে। কিন্তু মেউ আর তার সন্তানদের জন্য তার মন খারাপ হয়ে গেল।

মা তুয়ার স্কুলের জুতা বের করে দিলেন। ‘তাড়াতাড়ি কর। স্কুলের গেট বন্ধ হয়ে যাবে।’

তুয়া জুতা পরতে পরতে দরজার দিকে চেয়ে রইল। মেউ ততক্ষণে শেষ ছানাটিকে মুখে নিয়ে সিঁড়ি পেরিয়ে বাগানে নেমে গেছে। তুয়া মনে মনে ফিসফিস করে বলল, ‘বাই মেউ। আবার এসো।’ সেদিন সারাদিন তুয়ার স্কুলের টিফিন বক্সের চেয়ে জুতার র‌্যাকের মেউ আর নরম বিড়াল ছানাদের কথাই তার বেশি মনে পড়ল।