মো. ওমর ফারুক খান। দায়িত্ব পালন করছেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে। ১৯৮৬ সালে শরিয়াভিত্তিক এ ব্যাংকটিতে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন তিনি। ব্যাংকিং খাতে তার রয়েছে দীর্ঘ ৩৭ বছরের অভিজ্ঞতা। সম্প্রতি ব্যাংকং আমানত নিয়ে রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিজনেস এডিটর রহিম শেখ
প্রশ্ন : বর্তমানে আপনার ব্যাংকে মোট আমানতের পরিমাণ কত? গত ১-২ বছরে আমানত প্রবাহ কেমন ছিল তা বাড়ছে না কমছে?
উত্তর : বর্তমানে আমাদের ব্যাংকের আমানত প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা যা দেশের ব্যাংকিং খাতে সর্বোচ্চ আমানত। গত ১-২ বছরে তথা ২০২৩ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত যদি বলি ইসলামী ব্যাংকের আমানতের প্রবৃদ্ধি বরাবরের মতোই ইতিবাচক ছিল। ২০২৩ সালের শেষে আমাদের মোট আমানত দাঁড়ায় ১,৫৩,৩০৬ কোটি টাকায়, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৯ শতাংশ বেশি। ওই আমরা বছর সোনালী ব্যাংককে ছাড়িয়ে দেশের সর্বোচ্চ আমানত আহরণকারী ব্যাংকের অবস্থান অর্জন করি। ২০২৪ সালেও প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত ছিল এবং বছর শেষে আমাদের আমানতের স্থিতি ছিল ১,৬১,০০০ কোটি টাকা। আর ২০২৫ এর জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত আমরা নেট প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা আমানত সংযোজন করেছি ফলে আমাদের এখন মোট আমানত দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। আলহামদুলিল্লাহ, বলা যায় ইসলামী ব্যাংকের আমানত ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে।
প্রশ্ন : বাজারে মন্দা বা সংকট থাকা সত্ত্বেও আপনারা কীভাবে আমানতকারীদের আস্থা ধরে রেখেছেন?
উত্তর : সামগ্রিক অর্থনৈতিক বর্তমান প্রেক্ষাপটেও আমরা আমানতকারীদের আস্থা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছি মূলত আমাদের দীর্ঘদিনের বিশ্বাসযোগ্যতা, শরিয়াহভিত্তিক নীতি ও আধুনিক সেবার কারণে। আমরা সর্বদা আমানতকারীদের অর্থের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকি এবং স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তিনির্ভর সেবার মাধ্যমে গ্রাহকদের নিরবচ্ছিন্ন সুবিধা নিশ্চিত করে যাচ্ছি। পাশাপাশি দেশব্যাপী বিস্তৃত শাখা, এজেন্ট ব্যাংকিং ও এটিএম-সিআরএম নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আমানতকারীদের কাছে সহজলভ্য ও নির্ভরযোগ্য সেবা পৌঁছে দিচ্ছি। নিয়মিত মুনাফা বণ্টন, সেবার মানোন্নয়ন এবং সামাজিক দায়বদ্ধতায় সক্রিয় অংশগ্রহণও গ্রাহকদের আস্থা অটুট রাখতে সহায়তা করেছে। ফলে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জিং সময়েও আমরা গ্রাহকদের কাছে একটি নিরাপদ ও বিশ্বস্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত রাখতে পারছি।
প্রশ্ন : অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় আপনার ব্যাংক কীভাবে প্রতিযোগিতামূলক মুনাফার হার অফার করে?
উত্তর : আমাদের লভ্যাংশ সম্পূর্ণ শরিয়াহনীতিতে পরিচালিত হয়। গ্রাহকদের আমানত আমরা বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করি এবং সেখান থেকে অর্জিত আয় ন্যায্যভাবে বণ্টন করি। এ জন্য মুনাফার হার সবসময় বাজারসঙ্গত ও প্রতিযোগিতামূলক থাকে। উদাহরণস্বরূপ, সাম্প্রতিক সময়ে সাধারণ আমানতে প্রাক্কলিত গড়ে ৬.৫ থেকে ৭ শতাংশ এবং দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ আমানতে প্রাক্কলিত ৮ থেকে ৯ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা বণ্টন করা হয়েছে, যা অনেক ক্ষেত্রেই প্রচলিত ব্যাংকগুলোর প্রদত্ত সুদের হারের চেয়ে বেশি। ফলে ইসলামী ব্যাংক গ্রাহকদের কাছে সবসময়ই একটি আকর্ষণীয় ও নির্ভরযোগ্য আমানতকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
প্রশ্ন : আমানত সংগ্রহ বাড়াতে ব্যাংক কী ধরনের নতুন পণ্য বা স্কিম চালু করেছে?
উত্তর : ইসলামী ব্যাংক গ্রাহকদের চাহিদা ও সুবিধা বিবেচনা করে আমানত সংগ্রহ বাড়াতে নতুন নতুন পণ্য ও স্কিম চালু করছে। শুধু একটি সঞ্চয়ী হিসাব নয়, ব্যাংক গ্রাহকদের জন্য বিভিন্ন ধরনের অ্যাকাউন্ট, বিনিয়োগ পণ্য এবং আধুনিক ডিজিটাল সেবা প্রদান করছে। শরিয়াহভিত্তিক নীতির ওপর অটল থেকে ব্যাংক গ্রাহকদের জন্য উদ্ভাবনী স্কিম যেমন উচ্চ মুনাফাসহ সঞ্চয়ী ও স্থায়ী আমানত, স্বল্প-মেয়াদি বিশেষ পরিকল্পনা, শিক্ষার্থী ও কর্মজীবীবান্ধব অ্যাকাউন্ট এবং মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যাংকিং সুবিধাসহ বিভিন্ন ডিজিটাল ফিচার চালু করেছে। এই নতুন পণ্য ও সেবার কারণে গ্রাহকরা ব্যাংকের সামগ্রিক বিশ্বাসযোগ্যতা, সুবিধা ও লাভজনকতা দেখে আরও বেশি আমানত রাখতে আগ্রহী হন।
প্রশ্ন : নারী, সিনিয়র সিটিজেন বা প্রবাসীদের জন্য আলাদা কোনো স্কিম আছে কি?
উত্তর : নারীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বিয়ের মোহর। নারী সমাজের একটি বড় অংশ এ অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। মোহর আদায় সহজ করতে ইসলামী ব্যাংকে মুদারাবা মোহর সেভিংস অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এ ছাড়া, ইসলামী ব্যাংকে নারীদের জন্য রয়েছে পৃথক ক্যাশ কাউন্টার। সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য রয়েছে মুদারাবা সিনিয়র সিটিজেন মাসিক মুনাফা অ্যাকাউন্ট। ৫০ বছরের বেশি বয়সি যেকোনো বাংলাদেশি নাগরিক মুদারাবা সিনিয়র সিটিজেন মাসিক মুনাফা হিসাব খুলতে পারবেন। এক লাখ টাকা কিংবা তার গুণিতক যেকোনো পরিমাণ অর্থ দিয়ে এ হিসাব খোলা যায়। হিসাবের মেয়াদ ১ বছর, ৩ বছর কিংবা ৫ বছর। প্রাক্কলিত হারে মুনাফার অর্থ সরাসরি গ্রাহকের সঞ্চয়ী হিসাবে জমা হয়। প্রবাসীদের জন্য আমানত প্রোডাক্ট হিসেবে মুদারাবা এনআরবি সেভিংস বন্ড (এমএনএসবি) অ্যাকাউন্ট রয়েছে। প্রবাসীরা ৫ বছর কিংবা ১০ বছর মেয়াদি এই বন্ড ক্রয়ের মাধ্যমে বিশেষ সেবা পেতে পারেন। প্রবাসীদের জন্য রয়েছে মুদারাবা এক্সপ্যাট্রিয়েট হাউজিং ডিপোজিট স্কিম- যা ৩ বছর থেকে ১৫ বছর মেয়াদি। একজন প্রবাসী নির্দিষ্ট সময়ের পর বাড়ি করার উদ্দেশ্যে এ বিশেষ ডিপোজিট স্কিমে টাকা জমা করার সুযোগ রয়েছে।
প্রশ্ন : মোবাইল ব্যাংকিং বা ডিজিটাল মাধ্যমে আমানত সংগ্রহের উদ্যোগ আছে?
হ্যাঁ, মোবাইল ব্যাংকিং ও ডিজিটাল মাধ্যমে আমানত সংগ্রহে ইসলামী ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছে। আমাদের সেলফিন অ্যাপ হলো সবচেয়ে জনপ্রিয় ডিজিটাল ব্যাংকিং প্ল্যাটফর্ম। ব্যাংকিং সেবাকে আরও সহজ, দ্রুত ও নিরাপদ করতে আমরা নিয়মিত এই অ্যাপে উন্নত সেবা সংযোজন করছি। পাশাপাশি এমক্যাশকে আরও জনপ্রিয় ও কার্যকর করতে ব্যাপক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে ব্যাংক, যাতে গ্রাহকরা ঘরে বসেই দ্রুত ও সুবিধাজনকভাবে আমানত রাখতে পারেন।
প্রশ্ন : আমানতকারীদের নিরাপত্তা ও অর্থ সুরক্ষায় আপনার ব্যাংক কী পদক্ষেপ নিচ্ছে?
আমাদের ব্যাংক আমানতকারীদের অর্থের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়। এজন্য শক্তিশালী শরিয়াহভিত্তিক অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, নিয়মিত অডিট এবং স্বচ্ছ আর্থিক প্রতিবেদন নিশ্চিত করা হয়। ডিজিটাল লেনদেনে উন্নত এনক্রিপশন, দুই-স্তরের যাচাই প্রক্রিয়া ও ফ্রড মনিটরিং সিস্টেম ব্যবহার করা হচ্ছে, যাতে গ্রাহকের তহবিল সর্বদা সুরক্ষিত থাকে। পাশাপাশি শাখা ও এজেন্ট ব্যাংকিং নেটওয়ার্কেও শক্তিশালী সুরক্ষা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এই সব উদ্যোগের মাধ্যমে ব্যাংক নিশ্চিত করছে যে, সংকটকালেও গ্রাহকের আমানত নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য।
প্রশ্ন : ব্যাংকের নিজস্ব অ্যাপ বা ই-ব্যাংকিং প্ল্যাটফর্মে আমানত ব্যবস্থাপনার কী সুবিধা পাচ্ছে গ্রাহক?
আমাদের নিজস্ব ব্যাংকিং অ্যাপ সেলফিন ও আই-ব্যাংকিং প্ল্যাটফর্ম গ্রাহকদের আমানত ব্যবস্থাপনায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। গ্রাহকরা যেকোনো সময় ব্যালেন্স চেক, ফান্ড ট্রান্সফার কিংবা বিল পরিশোধ করতে পারছেন, ফলে সময় ও খরচ দুটোই সাশ্রয় হচ্ছে। উন্নত সাইবার সিকিউরিটি ব্যবস্থার কারণে আমানত থাকছে নিরাপদ, আবার প্রতিটি লেনদেনের স্ট্যাটমেন্ট হাতে পাওয়া যাচ্ছে। রিয়েল-টাইম নোটিফিকেশন ও ডিজিটাল স্টেটমেন্টের কারণে আর্থিক নিয়ন্ত্রণ সহজ হচ্ছে, যা গ্রাহককে সঞ্চয় ও খরচের পরিকল্পনায় সহায়তা করছে। এ ছাড়া আমাদের সেলফিন অ্যাপ ব্যবহার করে গ্রাহক সঞ্চয়ী হিসাব ও ফিক্সড ডিপোজিট খোলা এবং বিনিয়োগ সমন্বয়সহ ব্যাংকের বহুমাত্রিক সেবা সংযুক্ত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে, আমাদের সেলফিন ও আই-ব্যাংকিং গ্রাহকদের জন্য ব্যাংকিংকে করেছে সহজ, নিরাপদ ও নিরবচ্ছিন্ন, যেখানে ২৪ ঘণ্টাই তারা নিজের আমানত ব্যবস্থাপনায় স্বাধীনতা পাচ্ছেন।
প্রশ্ন : আগামী ১ বছরে দেশের ব্যাংকিং খাতে আমানতের প্রবণতা কেমন থাকবে বলে মনে করেন?
আগামী এক বছরে দেশের ব্যাংকিং খাতে আমানতের প্রবণতা মূলত ইতিবাচক থাকার সম্ভাবনা বেশি। এক সময় ব্যাংক সাধারণ মানুষ ততটা ব্যাংকিং লেনদেনে অভ্যস্থ ছিল না। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি বদলে গেছে। ব্যাংক দিন দিন গ্রাহক-বান্ধব হয়ে উঠছে। এজেন্ট ব্যাংকিং, উপ-শাখা এবং ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবার কারণে ব্যাংকের বিস্তার গ্রামের আনাচে কানাচে পৌঁছে যাচ্ছে। ফলে প্রান্তিক মানুষও ঘরে টাকা না রেখে ব্যাংকেই রাখতে আগ্রহী হচ্ছে। হুন্ডি প্রবণতা কমে আসায় বৈদেশিক রেমিট্যান্সও এখন প্রধানত ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে আসছে। এ ছাড়া ব্যাংকের সুদ হার, গ্রাহকের আস্থা এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনা সব মিলিয়ে আগামী এক বছরে আমানতের প্রবাহ ধীরে ধীরে বাড়বে। তবে এটি টেকসই ও স্থিতিশীল রাখতে সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন রয়েছে।
প্রশ্ন : আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে আপনার ব্যাংক কী ভূমিকা রাখছে? প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমানত সেবা কীভাবে পৌঁছাচ্ছে?
আমার ব্যাংক আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। আমরা গ্রামীণ এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষের জন্য সহজ, সাশ্রয়ী এবং নিরাপদ ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। সারা দেশে ২৭১টি উপ-শাখা ও ২৭৭১টি এজেন্ট আউটলেটের মাধ্যমে আমরা প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের সহজে আমানত জমা দেওয়ার সুযোগ দিচ্ছি। সারা দেশে পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে কাজ করে যাচ্ছি। এ প্রকল্প ৩৪ হাজার গ্রামে জামানতমুক্ত বিনিয়োগের মাধ্যমে ১৭ লাখ পরিবারকে দেশের অর্থনীতির মূলধারায় নিয়ে এসেছে। এ প্রকল্পের সদস্যদের মধ্যে ৯২ শতাংশই নারী। নারীর কর্মসংস্থান এবং তাদের ক্ষমতায়নেও এ প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ ছাড়াও ইসলামী ব্যাংক দেশের কৃষি খাতের উন্নয়নে কাজ করছে। পাশাপাশি গ্রাহকদের আর্থিক শিক্ষা প্রদান করে তাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত করছি যাতে তারা আরও স্বাচ্ছন্দ্য এবং আস্থা নিয়ে ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করতে পারেন। ফলে এখন গ্রামের মানুষও ব্যাংকের মূল সেবার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে এবং তাদের অর্থ নিরাপদভাবে ব্যাংকে রাখার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মো. ওমর ফারুক খান
ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি